নতুন এক মরীচিকার নাম কমলা হ্যারিস

বিতান চক্রবর্তী

যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। বর্তমান রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছেন সেদেশের ডেমোক্রাট দলের জো বিডেন। আর বিডেনের সহকারী উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সামনে এনেছেন এক বিতর্কিত নেত্রীকে যার নাম কমলা হ্যারিস। প্রথমবার কমলা নাম শুনে ভারতের সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এই নেত্রী হয়তো ভারতের বিদেশনীতির সহায়ক হবেন। ভারত আমেরিকা সম্পর্কে হয়তোবা এক নতুন মাত্রা যোগ হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন একেবারেই অন্য তথ্য। তাদের মতে সাধারণ ভারতীয়রা একপ্রকার মরিচীকা দেখছেন।

কমলার পিতা একজন জামাইকান আফ্রিকান ব্যাক্তি। ডোনাল্ড হ্যারিস। কমলার মাতা ড. শ্যামলা গোপালন জন্মসূত্রে হিন্দু। ডোনাল্ড হ্যারিস ছিলেন একজন মার্কসবাদী অর্থনীতি শিক্ষক। কিন্তু কমলার ৭ বছর বয়সে কিন্তু তার বাবা ও মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তিনি ওকল্যান্ড এবং বার্কলেতে বড় হয়েছিলেন প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গদের গীর্জাগুলিতে যোগ দিয়ে। তার নীচের প্রতিবেশী রেজিনা শেলটন প্রায়শই কমলা এবং তার বোন মায়াকে ওকল্যান্ডের ২৩ অ্যাভিনিউ চার্চ অফ গডে নিয়ে যেতেন। কমলাদেবী একজন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টান হিসেবেই নিজেকে মনে করেন।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হেস্টিংস আইন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে হ্যারিস তরুণ প্রসিকিউটর হিসাবে যৌন অপরাধ ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে বিশেষত্ব অর্জন করেছিলেন। তবে দ্য ইন্টারসেপ্ট এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের দুটি তদন্তে দেখা গেছে যে ক্যাথলিক চার্চের শিশু নিগ্রহ এবং কেলেঙ্কারী নিয়ে হ্যারিস রীতিমতো নীরব ছিলেন – প্রথমে সান ফ্রান্সিসকো জেলা অ্যাটর্নি এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে।

যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা বলছেন যে তাদের সুবিচার পাওয়ার জন্য তারা বারবার লিখিত অনুরোধ ও ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও হ্যারিস সেগুলিকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিহত করেছেন। তারা এবিষয়ে তার পূর্বসূরি টেরেন্স হ্যালিনান এর তদন্ত করা ও জোগাড় করা সমস্ত তথ্য প্রমাণ রেকর্ড প্রকাশ করতে অনুরোধ করলেও কমলা অস্বীকার করেছিলেন। অভিযোগ ছিলো পাদ্রীদের বিরুদ্ধে। বিগত রাষ্ট্রপতির হয়ে প্রার্থী হওয়ার সময়, তিনি প্রায়ই “দি গুড সামেরিটান” এর নিউ টেস্টামেন্টের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছিলেন। তার কর্মজীবনে তিনি সেদেশের অ্যাটর্নি হলেও তার বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠছে মিশনারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চাপা দেওয়ার, অনৈতিক অর্থ লেনদেনের। ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে, তার প্রচারের সময় হ্যারিস একটি ফর্ম স্বাক্ষর করে বলেছিলেন যে তিনি এই নির্বাচনী অভিযানের জন্য (সান ফ্রান্সিসকো জেলা অ্যাটর্নি নির্বাচনের জন্য) শহরের ২ লক্ষ ১১ হাজার ডলার পর্যন্ত তার ব্যয়কে সীমিত রাখবেন। হ্যারিস এই প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন কিন্তু তার ব্যয় সীমা বাস্তবে ছিলো আকাশচুম্বী। নভেম্বরের শেষ দিকে তিনি ৬ লক্ষ ২১ হাজার ডলার সংগ্রহ করেছিলেন। এজন্য হারিসকে জরিমানা করার ক্ষেত্র সান ফ্রান্সিসকো এথিক্স কমিশন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার প্রচারে ৩৪,০০০ ডলার জরিমানা দিতে হয়েছিল, এবং এটি ছিলো একটি রেকর্ড জরিমানা। “Profiles in Corruption: Abuse of Power by America’s Progressive Elite” বইতে Govt Accountability Institute এর লেখক পিটার স্কুইজার তার এই পাদ্রীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ লুকানো এবং চার্চের সংস্থাগুলি থেকে বেআইনি অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পর্কে নির্দিষ্ট প্রমাণগুলি তুলে ধরেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে আমেরিকার রাজনৈতিক পটভূমিতে হ্যারিসের সাফল্য তার পিতৃতান্ত্রিক বংশের উপর জোর দেওয়ার উপরেই নির্ভর করে আছে। সেদেশের আফ্রো-আমেরিকান এবং বাম-উদারপন্থীদের সাথে ভালভাবে মেলে তার পিতৃবংশের পরিচয়। মূলত আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের বিভেদই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মূল সমর্থনের ভিত্তি। এ কারণেই এমনকি তার বোনও তাদের মায়ের তরফে থাকা হিন্দু শিকড়কে জোর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। কমলা নিজেকে ব্ল্যাক ব্যাপটিস্ট হিসাবে দেখেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে ডেমোক্র্যাটিক দলকে ৭৭ বছর বয়সী রাষ্ট্রপতির প্রার্থী খুঁজে আনতে হয়েছে। বিডেনকে এখন পর্যন্ত প্রবীণ আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হিসাবে বেছে নিয়েছেন তারা (২০২১ সালের জানুয়ারিতে তিনি যদি জেতেন, ততক্ষণে তিনি 7৮ বছর বয়সী হবেন), সেজন্যই ডেমোক্রাট দলটিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের একটি ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন ছিল। একটি কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা পুরোপুরি তাদের প্রয়োজন পূরণ করে। কমলা হ্যারিসকে টিকিটের ভারসাম্যের বাইরে অন্য কোনও কারণে বেছে নেওয়া হয়নি।

ডেমোক্র্যাটরা যদি সত্যিই সংখ্যালঘু বংশোদ্ভূতকেই গুরুত্ব দিতে চাইতেন, তাহলে শুধু শীর্ষ পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য কৃষ্ণাঙ্গ টোকেন ব্যক্তিকে খুঁজতেন না, তারা তুলসী গ্যাবার্ড কেও প্রার্থী করতে পারতেন। কিন্তু তাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রার্থী হলেও কোন হিন্দুকে খ্রিস্টান আমেরিকা কখনোই ভালো চোখে দেথে না। হিন্দুদের প্রতি অনেক সময়ই তারা বিভিন্ন ভ্রান্ত প্রচার করে যেমন চার্চের তরফ থেকে তাদের অনেক ক্ষেত্রে “শয়তানের উপাসক”, “আমেরিকা বিরোধী” ইত্যাদি বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকায় ডানপন্থী বা বামপন্থী দুই ক্ষেত্রেই গভীরভাবে হিন্দু-বিরোধী ধর্মীয় গোঁড়ামি এখনও প্রবল। এই কঠিন সত্যের সামনে তাই, কমলা হ্যারিস একটি মরীচিকা মাত্র। হ্যারিস ভারতীয়দের জন্য আলাদা কোনো গুরুত্বের বা পরিচয়ের দাবি রাখেনা। ভারতীয়দের আমেরিকার বিদেশনীতিতে প্রবেশর এখনও অনেক পথ বাকি।