অযোধ্যার রামমন্দির: ভারতীয় সভ্যতার পুনর্জাগরণ

লিখেছেন

  • অভীক মুখোপাধ্য়ায়
  • রুদ্র প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • রাজর্ষি মুখোপাধ্যায়
  • প্রতীক্ষা ও অর্ণব
  • কে কে মুহম্মদ
  • ডঃ শঙ্কর শরণ
  • কল্যাণ গৌতম
  • ডঃ স্বপন ঠাকুর
  • বিতান চক্রবর্তী
  • শেখর ভারতীয়
  • সন্দীপন মণ্ডল

সংগ্রহ করুন এই পুস্তকটি।

ভূমিকা

অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণ শুধু ভারত নয়, সমগ্র পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আজ সমস্ত পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ ধিক্কৃত হচ্ছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ যাবৎ অটুট থাকা দাসপ্রথার সমর্থকদের মূর্তি ধ্বংস করা হচ্ছে। অযোধ্যায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সাফল্য সেদিক দিয়ে আরও বেশি উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি এক দুই বছর নয়, দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দী।  এই পুস্তকের প্রথম ভাগ এই আন্দোলনের সুবিস্তৃত ইতিহাসকে নিয়ে যাকে সুখপাঠ্য ভাষায় প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অভীক মুখোপাধ্যায় তাঁর রাম কে নাম রচনায়। রচনাটি তথ্যের ভারে জর্জরিত নয়, বরং তার স্বাদু পরিবেশনে মনোগ্রাহী। এই ভাগে আরও দুটি লেখা আছে, একটি এই আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা রুদ্র প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজর্ষি মুখোপাধ্যায়ের কলমে। পরেরটি প্রতীক্ষা ও অর্ণবের লেখা এই আন্দোলনের সুদীর্ঘ বৎসর ভিত্তিক বিবরণ, তথ্যপঞ্জি ও টীকা সহ। প্রথমটি দেখে নিতে সাহায্য করে কি হয়েছিল, কেন হয়েছিল। পরেরটি এনিয়ে কোন বিতর্ক উঠলে যুক্তির অমোঘ হাতিয়ার।

ভারতের সভ্যতার উপর যে বর্বর আক্রমণ আগে হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে, তার মূর্ত প্রতীক হচ্ছে অযোধ্যার রাম মন্দির। মধ্যযুগে এই আক্রমণের নিধান দিয়েছিল আব্রাহামীয় মতবাদের গোঁড়ামি। বর্তমান দুনিয়ায় তা দিচ্ছে মার্ক্সবাদীয় বিশ্বাসবাদ। মধ্যযুগে আক্রমণকারীদের হাতিয়ার ছিল অস্ত্রশস্ত্র, বর্তমান দুনিয়ায় হাতিয়ার বাম ইতিহাস-প্রবক্তাদের বলা মিথ্যা ইতিহাস। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ্ কে কে মুহম্মদ তাঁর আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন কিভাবে তিনি রাম জন্মভূমি বিতর্ক শুরু হবার বহু আগেই ছাত্র হিসাবে বাবরি মসজিদের নীচে প্রাচীন মন্দিরের প্রমাণ দেখেছিলেন। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করে বলি,

ভারতের সঙ্গে অযোধ্যার পরিচয় হয় ১৯৯০ সালে। অযোধ্যার বিতর্কিত জমির স্বত্বাধিকার নিয়ে জাতীয় বিতর্ক তখন তুঙ্গে। আমার সঙ্গে অযোধ্যার পরিচয় কিন্তু এর অনেক আগেই। ১৯৭৬-৭৭ সালে আমার সুযোগ এসেছিল অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করার। সে সময় আমি দিল্লী স্কুল অফ আর্কিওলোজিতে এক ছাত্র ছিলাম। অধ্যাপক বি. বি. লালের নেতৃত্বে অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের জন্য এক গবেষকদল প্রেরিত হয়েছিল। দিল্লী স্কুল অফ আর্কিওলোজির ১২ জন ছাত্র সেই দলে সামিল হয়েছিল। আমি ছিলাম তার মধ্যে একজন। আমরা অযোধ্যায় সে সময় প্রায় দুইমাস ছিলাম।

সেই সময়ই, মন্দিরের স্তম্ভের নীচে আমি ইঁটের এক প্লাটফর্ম দেখেছিলাম। তখন আমরা এই আবিষ্কারকে এক প্রত্নতাত্ত্বিকের ইতিহাস সমীক্ষা হিসাবেই নির্মোহ দৃষ্টিতেই দেখেছিলাম। যখন আমরা সেখানে গেলাম, দেখলাম বাবরি মসজিদের দেওয়ালে মন্দিরের স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভগুলি কালো আগ্নেয় শিলানির্মিত। স্তম্ভের নীচের দিকে পূর্ণকলস খোদাই করা ছিল। মন্দিরের স্থাপত্যরীতিতে পূর্ণকলস সম্বৃদ্ধি সূচিত করার আটটি উপায়ের একটি। এই ভাবে খোদাই করা পূর্ণকলস সাধারণ ভাবে খ্রীষ্টীয় একাদশ এবং দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্যেই দৃষ্ট হত। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার আগে, আমরা এরকম একটি দুটি নয় চৌদ্দটি স্তম্ভ দেখেছিলাম। মসজিদ তখন পুলিশের কড়া প্রহরায় ছিল এবং সাধারণ মানুষের জন্য প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আমাদের উপর অবশ্য কোন বিধিনিষেধ ছিল না। আমি সতর্কভাবে কাছ থেকে বহুবার এই স্তম্ভগুলিকে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম।

বাবরের  সেনাপতি মীর বাকি যে মন্দিরটি ধ্বংস করেন সেটির মশলা দিয়েই বাবরি মসজিদ নির্মিত। উপরিভাগে বর্ণিত কালো আগ্নেয় শিলানির্মিত স্তম্ভগুলি এবং স্তম্ভের নিম্নভাগে প্রাপ্ত ইঁটের কাঠামোগুলি মসজিদের কাছে এবং মসজিদের পিছনে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় দৃষ্ট হয়েছিল। এই প্রমাণের ভিত্তিতে আমি বাবরি মসজিদের নীচে পূর্বতন একটি মন্দিরের অস্তিত্বকে সাব্যস্ত করেছিলাম।  

কে কে মুহম্মদের আত্মজীবনীর ঐ অংশটি এখানে সন্নিবিষ্ট হল যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরা যে সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হওয়ার পথকে বানচাল করে ভারতকে রক্তাক্ত করেছেন। এর পাশাপাশি ইতিহাসবিদ্ ডঃ শঙ্কর শরণের লেখা যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক নামধারী মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডাবাদীদের নষ্টামি। এঁরা ইতিহাসকে বিকৃত করে এক প্রাচীন সংস্কৃতির ধ্বংস করতে আগ্রহী। তাঁদের এই গোঁড়ামির মূলে আছে মার্ক্সীয় মতবাদ।

রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ ভারতীয় জনগণের আধ্যাত্মিকতার বিজয়। আর শুধু ভারতই বা বলি কেন, রামচন্দ্র তো শুধু ভারতের নন। তাঁর গাথায় মুগ্ধ নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া থেকে মঙ্গোলিয়া,  জাপান থেকে ভিয়েতনাম। মজার কথা তবু একটা নতুন মীথ বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, রাম নাকি বাংলার নন। এ কাজ যে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার “স্বদেশো ভুবনত্রয়ম্”-এর পরিপন্থী, তাতে কোন সন্দেহ আছে কি? 

তথ্যের নিরিখে এ এক বড়ই দুর্বল কথা। বাংলার গ্রামের চালচিত্র ফুটিয়ে তুলতে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর পথের পাঁচালীতে আছে রাম নবমীর মেলার কথা। পুস্তকের তৃতীয় ভাগে আমরা তুলে ধরেছি রামের সঙ্গে বাঙালী সংস্কৃতির ওতোপ্রোতঃ সম্বন্ধের এক ঝলক। এই ভাগটি সবচেয়ে দীর্ঘ। অধ্যাপক কল্যাণ গৌতম দেখিয়েছেন বাঙালীর দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে রামচন্দ্রের নিবিড় যোগ। এই যোগের উৎস শুধু কৃত্তিবাসের রামায়ণ নয়, বরং আরও অনেক কিছু। এর পরে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ডঃ স্বপন ঠাকুরের সাক্ষাৎকারের কিয়দংশ পরিবেশিত হয়েছে। তিনি ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে দেখিয়েছেন রাম গ্রামবাংলার কত আপনজন।  স্বপন ঠাকুরের পাণ্ডিত্য যে কথাকে ব্যক্ত করেছে সেকথাকেই তথ্যনৈপুণ্যে স্পষ্ট করেছেন বিতান চক্রবর্তী। সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজা তো শ্রীরামচন্দ্রের অকাল বোধনকেই স্মরণ করে নয় কি? সারা বাংলা ব্যাপী কিছু প্রসিদ্ধ রাম মন্দিরের বিবরণও আছে। সাংবাদিক শেখর ভারতীয় তাঁর লেখনীতে দেখিয়েছেন যে রাম বিরোধিতা একটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক প্রকল্প। এর মধ্যে কোন সাংস্কৃতিক ভিত্তি নেই। আর তাঁর এই কথাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শ্রীসন্দীপন  মণ্ডল। তিনি রামমন্দির বিরোধিতার প্রতিটি যুক্তিকে তুলে ধরে প্রতিযুক্তির দ্বারা ছিন্নভিন্ন করেছেন।

শেষে বলি, শ্রীরামের মাহাত্ম্য এখানেই যে তিনি অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মবিজয়ের প্রতীক। তাঁর শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ছিল সত্য ও ত্যাগ। আজ বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনে এই দুই মূল্যবোধ আরও বেশি করে প্রস্ফুটিত হোক, এই কামনাই করি। যাঁর মধ্যে এই দুই বোধ ফুটেছে, তিনিই কবি। সেই কবির মানসভূমির দিকে কবিগুরুর মতোই নমস্কার জানাই।

সংগ্রহ করুন এই পুস্তকটি।