ট্যুইটারের যা এক্তিয়ার, তার বাইরে কেন কাজ করছে?

0
578

সম্প্রতি ভারতীয় সরকারের ট্যুইটারের বিরুদ্ধে নেওয়া কঠোর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মন্তব্য এবং কেন এই পদক্ষেপ অত্যন্ত স্বাগত?

এই গল্পটি শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র চার মাস পূর্বে যখন ট্যুইটার সিইও জ্যাক ডরসে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ভারত পরিদর্শনে এসেছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মূলত দুটি প্রধান কারণের জন্য কলঙ্কিত হয়ে ওঠেন। প্রথমত,তাঁর ভারতের কট্টর অতি-বামদের সঙ্গে রোগস গ্যালারির বৈঠক, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বরখা দত্ত এবং যেখানে “ব্রাহ্মণ্য পিতৃতান্ত্রিকতা ধ্বংস করে দাও” প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দ্বিতীয়ত, “ভুয়ো খবরকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে” এই বিষয়ে চূড়ান্তভাবে অকর্মণ্য রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক।

২০১৯ সালের সাধারন নির্বাচনের সময় ট্যুইটার তাঁর কদর্য কৌশলগুলির জন্য বিশাল সমালোচনার মুখে পড়েছিল এবং এই অভিযোগটি কংগ্রেস পার্টির নিজস্ব সংবাদপত্র ন্যাশনাল হেরাল্ড খণ্ডিত করার চেষ্টা করেছিল। ট্যুইটার ছাড়াও ফেসবুকও বিজেপি, আরএসএস, নরেন্দ্র মোদী এবং সাধারণভাবে হিন্দু স্বার্থ রক্ষাকারী শত শত জনপ্রিয় পৃষ্ঠা ট্যুইটারের একতরফা ভাবে সরিয়ে দেওয়ার তীব্র ভাবে নিন্দিত হয়েছিল।

দুই বছর পরে, বিশেষত সম্প্রতি শেষ হওয়া মার্কিন নির্বাচনের শেষের দিকে ট্যুইটার প্রায় স্পষ্টই করেছে যে তারা বিশ্বজনীন অতি-বামে বিরাট টেক কোম্পানিগুলির চক্রান্তের অংশীদার হিসাবে স্বেচ্ছায় ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। এর ফলে টুইটার  এখন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন তদন্তের অধীনে এসেছে।

এবং যখন নরেন্দ্র মোদীর সরকার ট্যুইটারকে আইনী নির্দেশ পাঠিয়ে উগ্র খালিস্তানিপন্থী এবং অন্যান্য বিপজ্জনক প্রচারের জন্য যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে বলেছিলেন, সেই পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। আর জগন্নাথনের বক্তব্য অনুসারে, ইতিমধ্যে ট্যুইটারকে পায়ের কাছে এনে রাখার সময় হয়ে গেছে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য টেক প্ল্যাটফর্মগুলি, বিশেষত যেগুলি বিদেশী শক্তির মালিকানাভুক্ত, তাদের ভারতের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে কোন মতামত প্রদান করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ট্যুইটারের নির্লজ্জতা বিশেষত তথাকথিত কৃষকদের ‘প্রতিবাদ’ এর জন্য আরো গভীর হয়েছে- এটি যে কেবল নিজেকে ভারতের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক প্রচার করার জন্য একটি মঞ্চ হিসাবে তৈরি করেছে তা নয়, বরং এর জটিলতা আরো বৃদ্ধি করেছে। প্রসার ভারতীর প্রধানের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া ভারতীয় সরকারের কাছে স্পষ্টত একটি চ্যালেঞ্জ। হয়ত, ট্যুইটারের ভূমিকায় এই নতুন ধারার স্বৈরাচারী আত্মবিশ্বাস এসেছে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টুইটার থেকে চিরকালের জন্য বিতাড়নের থেকে। ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনী প্রচারের সময় ডোনাল্ডকে পরাজিত করার জন্য এটি কীভাবে প্রায় একটি ক্রুসেড সংগঠিত করছিল এবং কীভাবে এর নানা অ্যালগোরিদম ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে আরো কঠোর করছিল, তা তো একেবারেই স্পষ্ট।

“বাকস্বাধীনতা”র অজুহাতে ভারতের শক্তি নষ্ট করার প্রকাশ্য প্রচার ও কিছু বিপজ্জনক হ্যাশট্যাগ যেমন “মোদীকৃষকদেরহত্যাকরারপরিকল্পনাকরছেন” ইত্যাদিতে ট্যুইটার আপন মস্তিষ্কবিজ্ঞানটিকে যে চালনা করছে তা হল বস্তুত ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে তাদের কতটা ঠেলা যায় ও পরিকল্পনা করা যায় তারই মহড়া মাত্র। কোনো ভুল হয় না: ট্যুইটার বা জ্যাক ডোরসে কেউই নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি বা হিন্দু সংস্কৃতির আদর্শের বন্ধু নয়। বিপরীতে, এটি বিশ্বব্যাপী সেইসব শক্তির সঙ্গে পুরোপুরিভাবে জড়িত যারা এই ভারতীয় আদর্শকে ধ্বংস করতে অক্লান্ত যুদ্ধ শুরু করেছে। অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা এবং এই প্রচার অভিযান দীর্ঘমেয়াদি খেলার নিছক স্ফুলিঙ্গ মাত্র।

উপরোক্ত অংশে আর জগন্নাথনের যুক্তিমত, ট্যুইটার ও অনুরূপ সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির জন্য একটি দেশীয় বিকল্প গড়ে তোলার এখন উপযুক্ত সময় হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে বৈদ্যুতিন ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এবং এর সহকারী সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে ‘কু’ নামে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া নতুন করে শুরু করার দিকে ঝুঁকেছেন। যাইহোক, ট্যুইটার থেকে সরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর এরূপ একটি পরিবর্তনের কাজ খুব অল্প সময়ে হবে না, এবং একে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পিত উপায়ে করা প্রয়োজন। প্রথম দিকে এসে পড়া এখনো ট্যুইটারের পক্ষে লাভ হচ্ছে এবং এটি চারপাশে উদ্দেশ্যসাধনের নানা উপায় ভাল করেই বোঝে। অপর পক্ষে, নরেন্দ্র মোদীর ট্যুইটার থেকে শেষ প্রস্থান ঠিকঠাক ভাবে করা গেলে তাদের প্রচণ্ড ক্ষতি হবে এবং এর জন্য চোখের নিমেষে একবারে লাখ লাখ ভারতীয় ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে যাবে। ট্যুইটার ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির তাদের সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা আসল ব্যবহারকারীদের ছাড়া কোন কার্যকারিতাই নেই।

ট্যুইটারের বিরুদ্ধে মোদী সরকার যে হাল্কা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে এবং তাঁর প্রস্তাবিত প্রস্থানটি আরো ন্যায়সঙ্গত হয়ে ওঠে কারণ দুটি নির্দেশনামা। একটি গোটা সপ্তাহ কেটে গেছে এবং ট্যুইটার এখনো তার একবগগা অবস্থানে অটুট থেকে প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেছে।

দেশীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার ক্ষেত্রে সরকার ও সমগ্র প্রযুক্তিবিদ সমাজকে কতগুলি মূল বিষয়ের উপর মনোযোগ দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৃহৎ প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলি তৈরি হয়েছিল কারণ সরকার তাদের ব্যর্থ হবার সাথে সাথে নতুন করে শুরু করতে সুযোগ দিয়েছে। ফেসবুক বা ট্যুইটারের সাফল্যের রঙিন ঝাঁ চকচকে গল্পের পশ্চাতে আছে বহু করুণ ব্যর্থতা। দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে ব্যর্থতাই সাফল্যের প্রথম পদক্ষেপ। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে ভারতে ব্যর্থতাকে এখনো ঘৃণা চোখেই দেখা হয় এবং তাদের অক্ষম বা অপারগ বলে অভিহিত করা হয় কিংবা আরো খারাপ ভাবে বলা হয় , “আমি তো তোমায় বলেছিলাম!” যখন এটি আস্তে আস্তে উন্নতির দিকে পা বাড়াচ্ছে, ব্যবহারের একটি মৌলিক পরিবর্তন এনে এই পদ্ধতিকে আরো ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। এই দিকের একটি নির্দেশক হল যে মোদী স্টার্ট আপ পুনর্নবীকরণের জন্য একটি ১০০০ কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছেন। যাইহোক, নিজে নিজে এই তহবিলটি কখনই সাফল্য লাভ করতে পারে না, যদি না তাদের ব্যবহারিক দিকে কিছু পরিবর্তন হয়।

আর তবে এটি পূর্বোক্ত কু’এর মত সোশ্যাল মিডিয়া স্টার্টআপ গুলির নিজেদের পরিকাঠামো উন্নত করার জন্য ভাল সময় কারণ তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক তাঁদের হঠাৎ করে জোরালো শক্তির জোগান দিয়েছে।

এমনকি আরো মৌলিক ভাবে ট্যুইটারের যেরকম গুণিতক আকারে ভারতে (তৃতীয় স্থান) বৃদ্ধি ঘটেছে, তার জন্য তাঁরা কেবলমাত্র একটি শব্দের কাছে ঋণী: বিশ্বাস। ভারতবাসীরা বিশ্বাস করেছিল যে ট্যুইটার মুক্ত হবে, যথাযথ হবে, স্বচ্ছ হবে এবং সংস্কৃতির প্রতি স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি রাখবে, কিন্তু পরিবর্তে তাঁরা পেয়েছে নিষেধাজ্ঞা, স্থগিতাদেশ, ভারতভঙ্গকারী প্রচান অভিযান ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কুৎসিত গালাগালি। ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা নষ্ট করার চেষ্টা করার সময় একই সঙ্গে ট্যুইটার মুক্ত বাক-স্বাধীনতার আড়ালে লুকোতে পারে না।

অন্যান্য জিনিসের মধ্যে আত্ম নির্ভর ভারতের প্রকৃত অর্থ নিহিত আছে একটি দেশীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যা স্বীকার করে যে স্ব-নির্ভরতাও এক প্রকার আত্মসম্মান।

মূল লেখাটি ধর্ম ডিস্প্যাচ পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন সন্দীপ বালকৃষ্ণ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা। ছবি ঋণ ধর্ম ডিস্প্যাচ।