সোনার বাংলার সংকল্পপত্রে কি কোন ফাঁক থেকে গেল? 

0
873

 

– কৌটিল্যের অর্থ অনর্থ 

 

গোড়ার কথা

গোড়াতেই বলে নিই যে ইস্তেহার ব্যাপারটা অনেক সময়ই মানুষ খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। যেমন বিজেপির নির্বাচন-পূর্ব ইস্তাহারে থাকা সত্ত্বেও ভারতের সেকুলারিষ্টরা গণতান্ত্রিকভাবে আনীত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) লাগু করা নিয়ে যে বিশ্বনাটক করেছেন, তার কলঙ্ক কোনদিনই মিটবে না। আর শাসক দল তৃণমূলের ইস্তাহারটির সঙ্গে হয়তো একমাত্র আরব্য রজনীরই তুলনা হতে পারে। 

সোনার বাংলা গড়তে যে পার্টির উপর বাঙ্গালী ভরসা করতে পারে, সেই ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনী সংকল্প পত্রে কিছু জায়গা বাদ পড়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। বিভিন্ন আলোচনা সভা ও পত্রপত্রিকা পড়ার পর এই ইস্তেহার দেখে মনে হচ্ছে, যাঁরা রাজ্যের অর্থনীতি,  বাঙ্গালী অর্থনীতি এবং দ্রুতহারে পরিবর্তন হওয়া জনবিন্যাস নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন, তাঁদের চিন্তা ভাবনা ইস্তাহারের প্রস্তুতকারকদের কাছে পৌছায় নি।

 

বাঙ্গলার সমস্যা

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জনবিন্যাস এই রাজ্যের একটা বড় সমস্যা এবং এর কারণ শুধুমাত্র কাঁটাতার টপকে আসা মানুষ নয়। বাংলাদেশে কাজের সুযোগ এবং বেতন পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এমন কিছু কম নয় যে, তারা দলে দলে এই রাজ্যের জনসংখ্যা বাড়াবে। সেক্ষেত্রে তারা যেমন ডাক্তার দেখাতে চেন্নাই যায়, তেমনি কাজের জন্য মহারাষ্ট্র বা গুজরাট যেত। পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাস পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বাঙ্গালীর জন্য উপযুক্ত কাজের অভাব এই রাজ্যে। অধিকাংশ আইরিস যেমন আয়ারল্যান্ড ছেড়ে জীবন ও জীবিকার জন্য আমেরিকায় চলে গেছে, তেমনই বাঙ্গালীদের বড় অংশ আজ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। সল্টলেক থেকে চাকদা থেকে আলিপুরদুয়ার আজ বৃদ্ধাশ্রম। ভোটার লিস্টে নাম থাকলেও এদের একটা বড় অংশ ভোটের দিন টিকিট কেটে বাড়ি এসে ভোট দেবার মত অবস্থায় থাকে না। আর এর মূলে আছে রাজ্যের অর্থব্যবস্থায় সঠিক পরিকল্পনার অভাব। 

আর্থিক পরিকল্পনার সময় শাসক দলকে প্রথমে ভাবতে হয়, তার প্রজাদের দক্ষতা ( Skill ) কোথায়? সেই অনুযায়ী তাকে তার পরিকল্পনা করতে হয়। WTO যুগে আমেরিকা তার উৎপাদন ( Manufacturing ) চীনে পাঠিয়ে দেয়, কারণ সে জানে তার প্রজারা ভাল উৎপাদক নয় এবং সেই উৎপাদিত দ্রব্যের দাম এতো বেশি হবে, তাতে সে বাজার পাবে না। জাপানও তাঁদের উৎপাদন দেশের বাইরে করে।

 

বাঙ্গালীদের সামর্থ্য ও দুর্বলতা

কলকাতার বাঙ্গালীকে অনেকেই দোষ দেয় তারা অলস বলে। কারখানায় কাজ না করে বাঙ্গালী ইউনিয়নবাজি করে। কিন্তু প্রথম প্রশ্ন বাঙ্গালী কি উৎপাদন শিল্পের যোগ্য কর্মী? বাঙ্গালী ডাক্তার, শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী যদি ভাল. কাজ করে তবে এখানে কারখানা চলে না কেন? এই বিষয়টি প্রকৃত অধ্যয়নের স্বার্থে বেসরকারী ক্ষেত্রকে মূলতঃ চারটি বিভাগে ভাগ করব।

(১)  কৃষি ও পশুপালন, (২) উৎপাদন (Manufacturing), (৩) পরিষেবা ( Service Sector ) এবং (৪) গবেষণা (Research and Develoment)। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চরিত্র এবং দক্ষতার সঙ্গে মানানসই নয় এখানে একমাত্র উৎপাদন। এখানে চাই মূলতঃ কৃষি, পশুপালন, মৎস্যচাষ এবং পরিষেবা। আর এই জায়গাটাই ভুলে যাচ্ছে প্রকাশিত সংকল্পপত্রটি। বেশী দূর যেতে হবে না। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রিসার্চ ফাউণ্ডেশনের ডঃ অনির্বাণ গাঙ্গুলী এবং বিপুল চ্যাটার্জী তাঁদের গবেষণা পত্রে প্রতিটি জেলার জন্য পৃথক পৃথক ভাবনা নেওয়ার কথা বলেছিলেন।  সংকল্প পত্রে এরকম কোন বড়ো রূপরেখা দেখতে পেলাম না। 

যে ভুল জ্যোতিবাবুরা করেছেন, যে ভুল মমতা করলেন, আশঙ্কা সেই ভুল আগামী দিনে রাজ্যের শাসক করবে না তো? জ্যোতি বসুরা কম্পিউটারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। মমতা ২০১১-র ইস্তেহারে ঘোষণা করলেন এসইজেড (SEZ) দেবেন না। ফলে পরিষেবা শিল্প চলে গেল ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, পুনে। সঙ্গে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালী সল্টলেক, রাজগঞ্জ ছেড়ে চলে গেল সেই শহরগুলিতে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ক্ষুদ্র শিল্পজাত উৎপাদনে (MSME) বেশ সাফল্য পান। কিন্তু যে রাজ্যে প্রতি বছর ১১ লক্ষ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে এবং প্রত্যন্ত গ্রাম ময়না কিংবা আমতায়ও ৮০% মহিলা স্নাতক, সেখানেই ক্ষুদ্র শিল্প বেকার সমস্যার সমাধান নয়।

কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থান সিঙ্গাপুর, দুবাই, কিংবা লন্ডনের সঙ্গে তুলনীয়। আর ঠিক সেই কারণে চাঁদ সওদাগর থেকে জব চার্ণক থেকে  ক্লাইভ এই শহরে এসে ছিলেন। সেই কারণে স্বাধীন ভারতের প্রথম আই আই টি (IIT) ও আই আই এম (IIM) এই রাজ্যকে দেওয়া হয়। অথচ আজ আই আই টি ও আই আই এম থেকে পাশ করা স্নাতকদের এক শতাংশও কলকাতায় চাকরি পায়না। কারণ ভুল পরিকল্পনা।

 

বিজেপির সংকল্প পত্রে কি দেখতে পেলাম না?

বিজেপির ইস্তেহারে পুনরুজ্জীবনের দাওয়াই আছে l তা হল সড়ক, বিমান বন্দর, সেচ, মেট্রো ইত্যাদি পরিকাঠামোর উন্নয়ন l কিন্তু কিছু ফাঁক থেকে গেছে l একটা তালিকা বানানো যাক: 

১। গভীর সমুদ্র বন্দর : ১৯৬৭-র পর এই রাজ্যে কোন বন্দর হয়নি l ২০১৬তে কেন্দ্র সরকার সাগরে গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রস্তাব পাশ করলে, মমতা ব্যানার্জী তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ঘোষণা করেন যে তাজপুরে নতুন বন্দর বানাবেন l কিন্তু সাগর বন্দর যেখানে পুরো গঙ্গা অববাহিকাকে শিল্পায়নের দিশা দেখাতে পারে, সেখানে তাজপুর পারে শুধু মেদিনীপুরের কিছু অংশকে l বিজেপির উচিৎ ছিল সাগরের বন্দরের ঘোষণা করেই তৃণমূলকে কোণঠাসা করা l মোদীজি কিছুদিন আগেই এই বন্দরের ঘোষণা করার পরেও ইস্তেহার থেকে কিভাবে তা বাদ পড়ে? 

২। সফটওয়্যার শিল্প তথা পরিষেবা : শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর অন্যতম প্ৰিয় কাজ অউটসোউর্সিং l ইনফোসিসের প্রাক্তন কর্ণধার মোহনদাস পাই বলেছেন, বাঙ্গলার পতনের জন্য ব্যাঙ্গালোর IT তে বাঙালী ইঞ্জিনিয়ার পেয়ে নিজেকে পৃথিবীর সফটওয়্যার ক্যাপিটাল বানিয়েছিল। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে জমির পরিমাণ কম, শিক্ষিত কর্মী প্রচুর। কম জমিতে বেশি কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের পরিষেবা এবং ট্রেডিং এর উপর জোর দেয়া উচিৎ। যেমনটি সিঙ্গাপুর, হংকং করেছে।

অথচ, রাজ্য বিজেপির ইস্তেহারে ক্ষুদ্র শিল্পের জয় জয় কার। এই রাজ্যের বেকারদের যে ম্যানুফ্যাকচারিং এর প্রতি কোন আগ্রহ নেই তার সবচেয়ে প্রমাণ টাটা চলে যাবার পরেও মমতার নাটকীয় সাফল্য। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালী টাটার ওই কারখানায় নিজের কোন জায়গা খুঁজে পায়নি।

৩। হাই স্পীড রেল: আজকের এই বিকেন্দ্রীকরণ এবং ইন্টারনেটের যুগে কলকাতাকে বড় করার থেকে বেশী আবশ্যক রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন। চাই কয়েকটি হাই-স্পীড রেল করিডোর:

(ক) কল্যাণী থেকে কোচবিহার
(খ) শ্রীরামপুর থেকে বর্ধমান থেকে অন্ডাল থেকে রঘুনাথপুর থেকে চিত্তরঞ্জন
(গ) ধুলাগড় থেকে হলদিয়া
(ঘ) গড়িয়া ( বৃজি ) থেকে বারুইপুর হয়ে গঙ্গাসাগর

৪। নিরর্থক ডোল রাজনীতি : তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলকভাবে ডোল রাজনীতির কোন দরকার ছিল না l  ডোল রাজনীতি মুড়ি মিছরিকে একদর করে দেবে l মহিলাদের জন্য ভাড়া না থাকলে অন্যদের বাসভাড়া বাড়বে বা সরকারের বাস চালানো কঠিন হবে। পুরোহিতদের সঠিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, কোন মাসিক ডোল নয়।   

উপসংহারে বলা যায়, বহুদিন পর এমন এক ইস্তেহার বাংলা দেখলো, যা মার্ক্সীয় অর্থব্যবস্থার মায়াজাল থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে পারবে l কিন্তু গুজরাট বা মধ্যপ্রদেশের মডেল পশ্চিমবঙ্গ বা আসামে চলবে না l ডিফারেনশিয়াল ইকোয়েশন এর সমাধান যেমন তার আপার ও লোয়ার লিমিটের উপর পরিবর্তিত হয়, তেমনই আর্থিক পরিকল্পনা সমাজের শিক্ষা, স্বভাব ও দক্ষতার উপর নির্ভর করে l তাই সিঙ্গাপুর উৎপাদন করে না আর চীনের শক্তি বিপুল উৎপাদন l পশ্চিমবঙ্গকেও আমাদের নিজস্ব ‘লিমিটিং কন্ডিশন’ বুঝে মডেল বানাতে হবে l নাইলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা ব্যানার্জীর মত ব্যর্থতা নিশ্চিত l বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ম্যাকেঞ্জিকে নিয়োগ করেন এবং মমতা ব্যানার্জী অমিত মিত্রকে l ফলে উন্নয়নের সদিচ্ছার প্রমাণ তাঁরা যে একেবারেই দেননি, তা বলা যাবে না। কিন্তু মডেল ভুল ছিল l তাই ব্যর্থতা নিয়ে তাঁদের মাঠ ছাড়তে হল l 

বাঙ্গালী আর ব্যর্থতার বিলাসিতা দেখানোর অবস্থায় নেই।