বিধাতার হাতে লেখা গান – ৪৬

অভীক মুখোপাধ্যায়

(পঞ্চচত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪৬

‘কয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে ১৯৪৫ সালের পর থেকে কিন্তু কোনও দেশ অন্য দেশ দখলের জন্যে তাদের আক্রমণ করেনি।’ – ইউভাল নোয়া হারারি।

আজকাল যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ – যুদ্ধ খেলা হয়। এই মেরে দেব, এই মিসাইল ছেড়ে দেব…এসব হয়। তারপর থেমে যায়। যদি এতেও না – থামে তাহলে সারজিক্যাল স্ট্রাইক হয়। তাতেও না – মানলে বোমা টোমা পড়ে। কিন্তু কেউ কাউকে দখল করতে যায় না। যুদ্ধের নাম করে ডিল হয়ে যায়। কোনওটা শুধুই দুদেশের ওপরে প্রভাব ফেলে, কোনটা সারা বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে এই যে কিউবা – ক্রাইসিসের সময় সোভিয়েত পিছু হটল, কিংবা ভারত – চিন যুদ্ধের সময়ে চিন সরে দাঁড়াল, এতেও কি ডীল হয়েছিল?

আলবাত হয়েছিল।

সোভিয়েতদের ডিল হয়েছিল সেকথা লিখেছি আগেই। কিন্তু চায়না? তারা কী ডিল করল?  

চিন যুদ্ধ জিতে দেখিয়ে দিয়েছিল তারাই এশিয়ার দাদা। তাই কথা বলতে হলে তাদের সাথে বলতে হবে। ভারতের সঙ্গে নয়। কমিউনিস্ট হলেই বা কী হয়েছে? বস ইজ বস! ওই যে হয় না, পরিবারে বিয়েশাদির নেমন্তন্ন করতে এলে বাড়ির বড়র সঙ্গেই কথা বলতে হয়।

প্রথমেই আয়ুব খান অর্থাৎ পাকিস্তান বুঝে গেল পাড়ার দাদার সঙ্গে মনোমালিন্য করে টিকে থাকা যাবে না। অতএব, চলো দিলদার চলো, চিন কে পার চলো। যখন ইউনাইটেড নেশনস –এ চিনের স্থায়ী সিটের কথা উঠল, তখন আমেরিকা মানা করা সত্ত্বেও পাকিস্তান চিনকে সমর্থন করল। চিন খুশি হয়ে পাকিস্তানকে কিছুটা ভূখণ্ড দিয়ে দিল। অবশ্য এমনিতে দেয়নি, পাকিস্তান অধিগৃহীত কাশ্মীরের কিছুটা নিয়েও নিল তার পরিবর্তে। ১৯৬৫ সালে চিনের সহযোগীতাতেই পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করার সাহস দেখিয়েছিল।

আমেরিকার মেসেজ পেয়েই যেহেতু চিন পিছু হটেছিল, তাই আমেরিকাও খুশি হয়েছিল। পারস্পরিক সমঝোতার অবকাশ প্রশস্ত হচ্ছিল। শত্রুতা ভুলে দুদেশে মধ্যে বাণিজ্য আরম্ভ হল। এরপর থেকেই চিন কৃষি – নির্ভর অর্থনীতি থেকে শিফট করল উদ্যোগ – নির্ভর অর্থনীতির দিকে। চিন সোভিয়েতের মতো কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হলেও তার অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলতে কিন্তু আমেরিকার অবদান সর্বাধিক। পরবর্তীকালে রিচার্ড নিক্সনের সময়ে নিক্সন আর কিসিঞ্জার মিলে চিন আর পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে ভারতকে প্রায় আইসোলেটেড করে ফেলেছিল।  

সবই বুঝলাম, কিন্তু এখন প্রশ্ন হল চিন কি এসব ভেবেই কেনেডির কথা মেনে নিয়েছিল? একটা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এত সহজে একটা ক্যাপিট্যালিস্ট কান্ট্রির কথা শুনবে? মানবে? বিশ্বাস হয়?

আমরা শুধু খেলা হবে-তে বিশ্বাসী। খেলা হতেও দেখি। রেজাল্ট দেখি। কিন্তু ভুলে যা্‌ খেলাটা শুরু কোন বিন্দু থেকে হল। ভুলে যাই, ওপেনার কে ছিল। চিন ভারতের সঙ্গে লড়তে নামার আগে যেখানে ফোন করেছিল, শেষে অস্ত্র তুলে রাখার আগেও কি সেখানে একটিবার ফোন করেনি? কিউবা – ক্রাইসিসের শেষে কেনেডি সাহেব যখন ভারত আর চিনের দিকে নজর রাখছিলেন, তখন সোভিয়েতে বসে ক্রুশ্চেভ কি ঘাস ছিঁড়ছিলেন? তাঁর কাছে কেজিবি ছিল। কেজিবি প্রত্যেক মুহূর্তের খবর দিয়ে তাঁকে আপডেট করছিল। শুধু তা-ই নয়, কেজিবি মাস্টারপ্ল্যান কষছিল।

মিত্রোখিন আর্কাইভ অনুসারে, সোভিয়েতের নির্দেশ মতো কেজিবি ১৯৬২ সালের মে মাস থেকেই মেননকে নেহরুজির উত্তরাধিকারী রূপে প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাব্য সকল প্রয়াস আরম্ভ করে দেয়। সোভিয়েতের সঙ্গে মিগ বিমান নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, তাঁর পেছনে এই মেননই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু যা কিছু হয়েছিল সব হয়েছিল চিন – ভারত যুদ্ধের আগে। অক্টোবরে যুদ্ধের পর থেকেই মেননের ভাগ্য লেখা হয়ে গেল। তিনি আর যাই হন, নেহরুজির উত্তরাধিকারী হচ্ছিলেন না।

মিত্রোখিন আর্কাইভ কিন্তু কোনও রাষ্ট্রের সরকারি নথিপত্রের পর্যায়ে পড়ে না। তাসত্ত্বেও এই নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। পরে স্নোডেনের খবর, পানামা পেপারস এরকম হইচই ফেলেছে। তবে এটুকু মানতেই হবে যে, যদি মিত্রোখিনের খবর সত্যি হয়, একটা সময়ে যদি সত্যিই সোভিয়েত মেননের ইমেজ বানাতে উদগ্রীব হয়ে থেকে থাকে, তাহলে সোভিয়েত অবশ্যই চিনকে যুদ্ধ থামানোর জন্যেও বলেছিল। সোভিয়েতই চিনকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি দিয়েছিল। সেই চিন ভারতকে আক্রমণ করছিল। তাই নিজের প্রভাবে যুদ্ধ থামাতে পারলে ভারতে সোভিয়েতের হাত শক্ত করার প্রভূত সুযোগ থাকার কথা।

মিত্রোখিনের সূত্র থেকে জানা যায়, ভারত চিনের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর নেহরুজি মেননের কাছে ইস্তফা দাবী করেন। তখন কেজিবি একটি বিখ্যাত ভারতীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে মেননের জন্যে সমর্থন জড়ো করছিল।    

সোভিয়েত ভারত – চিন যুদ্ধের সময়ে মিগ বিমানগুলোকে না – পাঠালেও যুদ্ধের পরে কিন্তু পাঠিয়েছিল। সেই বিমান পরে ভারত – পাক যুদ্ধে কাজে লাগে। একবার নয়, দু – দুবার। এবং মনে রাখার মতো বিষয় হল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে যে ভারত – পাক সন্ধি হয়েছিল, তা হয়েছিল সোভিয়েতের বুকে। তাসখন্দে।  

কে কার কাছে আসছিল বলা ভারী মুশকিল। আর আমেরিকা? আমেরিকা কী করছিল?

আমেরিকা হ্যারিম্যান মিশন পাঠাল ভারতে। তিনটি পরিকল্পনা ছিল —

১. ভারতের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করা

২. কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত – পাক সমঝোতা করানো (এক্ষেত্রে অবশ্য লাভ পাকিস্তানের হতো, আয়ুব খানকে কাশ্মীর পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন কেনেডি)

৩. ভারতে তিব্বতীয় গেরিলাদের প্রশিক্ষণের জন্যে একটা যুগ্ম ব্যবস্থার আয়োজন করা।  

প্রথম বিন্দুর দাবী মেনে কিছু জয়েন্ট এক্সারসাইজ হল। বোঝানো গেল, আশা করি। এখনো মাঝেমধ্যে দেখবেন ‘বঙ্গোপসাগরে হল ভারত – মার্কিন জয়েন্ট ড্রিল’ গোছের খবর। এরই সূত্রপাত ঘটেছিল তখন। দ্বিতীয় পয়েন্টের মান রক্ষা করতে ছ’বার ভারত – পাক বাক্যালাপ হল। কিন্তু নেহরুজি কোনভাবেই কাশ্মীর ছাড়লেন না। তৃতীয় বিন্দুকে সফল করার জন্যে আমেরিকার সি আই এ আর ভারতের আই বি একযোগে তিব্বতীয় গেরিলাদের প্রশিক্ষিত করে তুলছিল। এর ফলে চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৬৪ সালে চিন প্রথম পরামণু পরীক্ষণ করল। নেহরু চলে গেলেন। চলে গেলেন কেনেডিও। আমেরিকার ভারত – প্রীতিতে ভাটা পড়ে গেল। ’৭১-এর যুদ্ধে একটা সময় পর্যন্ত আমেরিকা পাকিস্তানকে মদত দিয়েছিল। তখন জন এফ কেনেডির এক ভাই টেড কেনেডি ভারতে আসেন। সেনেটর টেড বলেন, ‘আমি আমার দাদার অধরা স্বপ্নটাকে পূর্ণ করতে চাই। আমেরিকা আর ভারতের সম্পর্ক আবার সুদৃঢ় করতে চাই।’ তখন তাঁকে এক ভারতীয় বিপক্ষ – দলনেতা নিজের স্বভাবসিদ্ধ ওয়ান – লাইনার ছুঁড়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সেনেটর কেনেডি, একটা কথা বলুন তো, আপনি কবে রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন?’ চিনতে পারলেন আশা করি, সেই মহান নেতাকে। পরবর্তীতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাঁর সময়ে শক্তি পরীক্ষা হবে। বুদ্ধ আবার হাসবেন। পোখরানের বিস্ফোরণে সারা বিশ্ব কাঁপবে। আমেরিকা ভারতকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেবে। আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি হলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।

জন এফ কেনেডির ভারত – প্রীতিতে বিশেষ একটি সংস্থা ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল। সি আই এ। কারণ ভারতকে ভালোবাসতে গিয়ে পাকিস্তানের মতো মজবুত ঘাঁটি ক্রমশ পিছলে চিনের দিকে চলে যাচ্ছিল। পাকিস্তান চিনের সাহায্য পেতে – পেতে সাহসী হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট কথোপকথন বলি। তাহলেই আপনারা আন্দাজ করতে পারবেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো তখন সদ্য পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী হয়েছেন। আমেরিকায় গেছেন। জন এফ কেনেডি তাঁকে দেখে খুব ইমপ্রেসড। তিনি ভুট্টোকে বললেন, ‘আপনার মতো লোক যদি আমেরিকার নাগরিক হতেন, তাহলে আপনাকে আমি আমার ক্যাবিনেটে জায়গা দিতাম।’

ভুট্টো বলেছিলেন, ‘না, মিস্টার কেনেডি। তখন আমি হতাম রাষ্ট্রপতি, আর আপনার মতো ব্যক্তিদের আমার ক্যাবিনেটে জায়গা দিতাম।’ একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একজন পাকিস্তানির এধরণের মন্তব্য করতে গেলে দম লাগে। পাকিস্তান সত্যিই সাহসী হয়ে উঠেছিল। অবশ্য ভুট্টো ছিলেনও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

আসলে কেনেডি সব অঙ্কই নিজের ফরমুলাতে কষতেন। সমীকরণ বদলে দিতেন। আর তাতেই সমস্যা বাড়ছিল। অনেকেই রেগে উঠছিল। যেমন তিনি সি আই এ – কে খেপিয়ে দিয়েছিলেন ভারতকে ভালোবেসে তথা পাকিস্তানকে চিনের দিকে ঠেলে দিয়ে। মাফিয়াদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের দীর্ঘ যোগসূত্র এবং সম্পর্কের সমীকরণ বদলে দিয়েছিলেন জিমি হোফফাকে রাগিয়ে দিয়ে। কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলে চটিয়ে দিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গদের। তাঁর সময়ে মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবার আলাবামার একটি ইউনিভার্সিটিতে দুজন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র ভর্তি হতে যাচ্ছিল। অবশ্য যতটা সহজে লিখে দিলাম, এই ঘটনাটা কিন্তু তত সোজা ভাবে ঘটেনি। শ্বেতাঙ্গরা এসব সহ্য করবে না বলে হুমকি দিচ্ছিল।

অনেকেই অনেক কিছু সহ্য করবে না বলছিল। কালো মেঘ জমছিল। যে মেঘে বাজ পড়ে, তেমন মেঘ। কেনেডিকে হত্যা করার চক্রান্ত শুরু হচ্ছিল।    

(ক্রমশ)