শেখ মুজিবুর রহমানঃ পাকিস্তান আন্দোলনের এক পুরোধা

0
1698


শৈলেন দত্ত

শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজীকে পিছনে ফেলে “হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী”। এবং ওপার বাঙ্গালার তো বটেই,এপার বাঙ্গালার অনেক বামপন্থী লিবারেলদের নয়নমণি।

কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান কতটা ধর্মনিরপেক্ষ?

নিজের আত্মজীবনীতে মুজিবুর রহমান নিজেকে ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ বংশের উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিয়েছেন। বহুপূর্বে শেখ বোরহানউদ্দিন নামক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। বোরহানউদ্দিন কোথা থেকে এসে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন তা জানা নেই। অন্যদিকে কালিদাস বৈদ্য মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব গ্রন্থে লিখেছেন চার পাঁচ পুরুষ আগেও মুজিবুর রহমানের পরিবার নমঃশূদ্র সমাজের অন্তর্ভূক্ত ছিল। কোনো কারণে তারা জাতিচ্যুত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। নিজেদের নামের আগে “শেখ” উপাধি জুড়ে দেওয়া হয়তো এক হীনমন্যতা বোধ কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। ঐ অঞ্চলের মুসলমানদের আচার ব্যবহার, খাওয়া দাওয়া,, ভাষা এবং মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে মিলে যায় নমঃশূদ্রদের সঙ্গে।

জাতিচ্যুত হ‌ওয়ার ফলে মুজিবের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যে তীব্র হিন্দুবিদ্বেষ সৃষ্টি হয় তা বংশপরম্পরায় বয়ে এসেছিল মুজিবুর রহমানের মানসিকতায়। যদিও মুজিব নিজের স্বার্থে হিন্দুদের ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি।

টুঙ্গিপাড়ার মুসলমানরা দাঙ্গাবাজ বলে প্রসিদ্ধি ছিল। এই দাঙ্গায় হিন্দু খুন করার শিক্ষা মুজিব নিজের গ্রাম থেকেই পেয়েছিলেন।

১৯৩৬ সালে মুজিবের আব্বা মাদারীপুর মহকুমায় বদলী হয়ে যান। ঐ সময় মুজিবের চোখে গ্লুকোমা দেখা দিলে একবছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে। ১৯৩৭সালে আবার গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন।ঐসময় মুজিবের গৃহশিক্ষক কাজী আব্দুল হামিদ “মুসলিম সেবা সমিতি” নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন,তার উদ্দেশ্য সকল মুসলমান পরিবার থেকে চাল সংগ্রহ করে তারপর তার বিক্রি করে গরীব ছেলেদের পড়াশোনায় সাহায্য করা। মুজিব এই সমিতির সম্পাদক ছিলেন। যেসব পরিবার চাল দিতে অস্বীকার করত তাদের বাড়িতে রাতে ইট মারা হতো এবং তাদের বাধ্য করা হতো। অর্থাৎ ঐ সময়তেই মুজিবের গুন্ডামীতে হাতখড়ি।

১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং ফজলুল হক একটি এগজিবিশন প্রদনে আসেন এবং এখানেই গুরু সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শিষ্য মুজিবুর রহমানের প্রথম পরিচয়। সারাজীবনে মুজিবের গুরুভক্তিতে টান পড়েনি। মুজিবের আত্মজীবনী পড়লে সোহরাওয়ার্দীকে একজন সরল দেবতুল্য মানুষ বলে মনে হতে পারে।

ঐ বছরই একদল হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে মারামারি করার ফলে মুজিব পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন। পুলিশের বয়ান অনুযায়ী মুজিব রমাপদ নামের একটি ছেলেকে ছোরা মারেন, যদিও মুজিব নিজের আত্মজীবনীতে তা অস্বীকার করেছেন। (মনে রাখতে হবে তখন বাঙ্গালায় মুসলিম লীগ শাসন শুরু হয়ে গিয়েছে। পুলিশ মুসলিম লীগের অধীনে। তারা একটা মুসলিম ছাত্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলবে মনে হয় না ) সোহরাওয়ার্দী আর হক সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম যায়। পনেরশ টাকা জামিনে মুজিব মুক্তি পান।

১৯৩৯ এ মুজিব কলকাতায় সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগ গঠন করার অনুমতি চান। সোহরাওয়ার্দী ইতিমধ্যেই মুজিবকে নিজের মুরিদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অনুমতি পেতে অসুবিধা হয় না। মুজিব গোপালগঞ্জ ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের সেক্রেটারি একজন মোক্তার সাহেব হলেও আসল কাজ মুজিব‌ই করতেন। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটির (খুব সম্ভবত এদের উদ্দেশ্য ছিল গুন্ডামি করা) সেক্রেটারি ছিলেন মুজিব। অর্থাৎ মুজিবের হিন্দুবিদ্বেষ এতদিনে একটি সঠিক রাস্তা খুঁজে পায়।

১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে (এখনকার মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলে থাকা শুরু করেন। মুজিবের নিজের ভাষায় “তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ,আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।”

ইসলামিয়া কলেজটি সহ কয়েকটি ছাত্রাবাস এবং কলকাতা মাদ্রাসা তখন ছিল ইসলামী শিক্ষা আর প্রচারের প্রধান কেন্দ্র। সুতরাং মুজিব সঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।

এইসময় তৎকালীন বাঙ্গালার রাজনীতির দিকে একটু তাকানো যাক। ফজলুল হকের সঙ্গে জিন্নাহর মনোমালিন্য হ‌ওয়ায় ফজলুল হক জিন্নাহর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছেন। ১৯৪১ এর ২৭ এ নভেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের নেতা যোগেশ চন্দ্র গুপ্তের বাড়িতে মুসলিম লীগ বিরোধী সব দলের নেতারা একত্রিত হন। শরৎচন্দ্র বসু শেষ পর্যন্ত যোগ দিতে পারেননি, কেননা ১১ই ডিসেম্বর , শপথ নেওয়ার ঠিক আগের দিন শরৎ বসু গ্রেফতার হন।

হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কোয়ালিশনের তীব্র বিরোধিতা মুসলিম লীগ , এবং তাদের সম্পূর্ণভাবে সাহায্য করে কমিউনিস্ট পার্টি, যদিও কমরেডগণ এই ইতিহাস চেপে গিয়েছেন। এই ব্যাপারে কমিউনিস্টদের তুরুপের তাস ছিলেন আবুল হাশিম।

বঙ্কিম মুখার্জি, আবদুর রাজ্জাক আর ভূপেশ গুপ্ত, এই তিন কমিউনিস্ট নেতা মুসলিম লীগের সঙ্গে চুক্তি করেন যে কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগ, যৌথভাবে শ্যামা হক মন্ত্রীসভার বিরোধিতা করবে। কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে মুসলিম লীগকে দেওয়া উপহার ছিলেন আবুল হাশিম। হাশিমকে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি করা হয়।

কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লীগকে ” প্রগতিশীল” বলে দাবি করলেও মুসলিম লীগ আসলে ছিল মুসলিম জমিদার,নবাব এবং অভিজাতদের রাজনৈতিক দল। বাঙ্গালার মুসলিম জনতার মধ্যে মুসলিম লীগের থেকেও বেশি জনপ্রিয়তা ছিল ফজলুল হকের। এমনকি শেখ মুজিবের মা পর্যন্ত একবার তাঁকে বলেছিলেন “বাবা যাই কর ,হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলিও না।” এমনকি মুজিব নিজের আত্মজীবনীতে লিখে গিয়েছেন , তাঁর দাদার (ঠাকুরদা) ভক্ত এক বৃদ্ধ বলছেন,” হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কেন,তার নাম‌ও তো শুনি নাই। আমাদের গরীবের বন্ধু হক সাহেব।”

সুতরাং শুধু মুজিবুর রহমান নয়, পুরো মুসলিম লীগের কাছে আসল চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রামবাঙ্গালার মুসলমানদের কাছে মুসলিম লীগকে ছড়িয়ে দেওয়া। এবং এই ব্যাপারে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।

১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে মুসলিম লীগের মৌলানা আক্রম খান আর তাঁর পুত্র খাইরুল আলম হাশিমের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভিন্সিয়াল অফিসে গিয়ে পি সি যোশীর সঙ্গে দেখা করেন। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পর ঠিক করা হয় মুসলিম লীগকে সাধারণ বাঙ্গালাভাষী জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হবে আবদুল হাশিমকে। হাশিম ব্যগ্রভাবে সম্মতি জানান।

কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনের পদ্ধতি হাশিম নিয়ে আসেন মুসলিম লীগের মধ্যে। প্রতিটি জেলায় লীগের পার্টি অফিস তৈরী করা হয় । হাশিম নিজে কলকাতার পার্টি অফিসে থাকতে শুরু করেন।

হাশিম আর মুজিব,এই দুজনেই ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত। তাই দুজনের কাছাকাছি আসতে বেশি সময় লাগেনি। হাশিম মুজিব সহ কিছু সংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়ে রাতের দিকে কলকাতার মুসলিম লীগ অফিসে কমিউনিস্ট পার্টির ধাঁচে হাশিম নিয়মিত ক্লাস নিতে শুরু করেন, যেখানে তিনি মুসলিম যুবকদের ইসলামের মূল তত্ত্ব, ইসলামিক দর্শন, সমাজতত্ত্ব এবং পার্টির সংগঠন সম্পর্কে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। তিনি একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার কথা বলেন । তিনি আরও বলেন হিন্দুদের গালাগালি দিলে হবে না, বরং যুক্তি দিয়ে হিন্দুদের বোঝাতে হবে পাকিস্তানের দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয় , বরং হিন্দু মুসলমান ,এই দুই সম্প্রদায়কে বোঝানোর জন্য। তিনি জমিদারদের পকেট থেকে মুসলিম লীগকে বের করে গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তুলতে উৎসাহ দেন। মুসলিম লীগ অফিসের ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ বহন করতেন সোহরাওয়ার্দী নিজে।সোহরাওয়ার্দীকে অনুরোধ করে হাশিমকে সম্পাদক করে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করা হয়, তার নাম দেওয়া হয় “মিল্লাত।”

এইসময় শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের এক কনফারেন্স আয়োজন করেন যেখানে তৎকালীন বেঙ্গল মুসলিম লীগের সব নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছিলেন। কনফারেন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিব নিজে। মুজিবের বক্তব্য অনুযায়ী এই কনফারেন্স গোপালগঞ্জের মুসলিম সমাজে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে। অর্থাৎ অন্তত নিজের মহকুমার মুসলিমদের মধ্যে ফজলুল হকের প্রভাব সরিয়ে সেখানে মুসলিম লীগের প্রভাব বৃদ্ধিতে মুজিব ছিলেন পুরোমাত্রায় সফল। মুজিব নিজেই নিজেকে”গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের জন্মদাতা” বলে উল্লেখ করেছেন।

শুধু কনফারেন্স আয়োজন করাই নয়,এই সময় গুন্ডামীও সমানে চলতে থাকে। ১৯৪১এ লীগ সরকারের পতনের সময় মাড়োয়ারিরা যখন বাজি পুড়িয়ে উল্লাসে মেতেছিল, তখন মুজিবের নেতৃত্বে একদল গিয়ে তাদের মারধর করে।

চল্লিশের দশকে বাঙ্গালার মুসলিম লীগে দুইটা গ্রুপের সৃষ্টি হয়। প্রথম দল প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিল এবং এই দলে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী,আবুল হাশিম এবং দ্বিতীয় দলে ছিলেন ম‌ওলানা আক্রম খান,খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমূখ। বলা বাহুল্য মুজিব ছিলেন প্রথম দলে। যাইহোক, সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে দুই দলের মধ্যে একটা মিটমাট হয়েছিল।

যদিও এইসময় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নেতাজির প্রতি মুজিবের মনোভাব ছিল মিশ্র। মুজিব নিজের আত্মজীবনীতে লিখে গিয়েছেন “অখন্ড ভারতে মে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম ‌।” সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তৃতা শুনে মন চঞ্চল হয়ে উঠলেও তাঁর মনে হত,” সুভাষবাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কি হবে?”।

শুধু তাই নয়, এইসময় মুজিব শেরে বাংলা ফজলুল হককেও পুনরায় মুসলিম লীগে আসতে অনুরোধ করেন।

১৯৪৬এর নির্বাচনের আগে ফরিদপুর জেলায় মুসলিম লীগের হয়ে প্রচারের দায়িত্ব ছিল মুজিবুর রহমানের। প্রতিটি থানা এবং মহকুমায় মুসলিম লীগের অফিস খোলা হয়।

মুজিবের চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক রূপ দেখা যায় এইসময়তেই, বিশেষ করে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময়। যদিও মুজিব আত্মজীবনীতে লিখে গিয়েছেন আবুল হাশিম তাঁদের মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে বলতে বলেছিলেন “এই সংগ্রাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে,আসুন আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে এটা পালন করি” এবং সোহরাওয়ার্দীও শান্তিপূর্ণভাবে এই দিনটি পালন করতে বলেছিলেন, কিন্তু আসল ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। ষোল‌ই অগস্ট মুজিব সকাল সাতটায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে গিয়েছিলেন। “ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে” কেন মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে হবে তা সত্যিই দুর্বোধ্য। শুধু তাই নয় , মুজিব লিখেছেন কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রোপাগান্ডায় হিন্দুরা বুঝেছিল এই সংগ্রাম তাদের বিরুদ্ধে।

গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের দায়ভার পুরোটাই হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে মুজিব নিজে এবং নিজের গুরু সোহরাওয়ার্দীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। নির্লজ্জের মত লিখেছেন দাঙ্গার প্রথম দিকে মুসলমানেরা মার খেলেও পরে তারা পাল্টা মার দেয়, যদিও আসল ঘটনা তার বিপরীতে। নোয়াখালীর হিন্দুহত্যা সম্পর্কে মাত্র এক লাইন খরচ করেছেন।

কিন্তু আসল ঘটনা লিখে গিয়েছেন দুইজন ব্রিটিশ লেখক লেওনার্ড মোসলে ( লাস্ট ডেজ অফ ব্রিটিশ রুল) এবং মাইকেল এড‌ওয়ার্ডস ( লাস্ট ইয়ার্স অফ ইন্ডিয়া) গ্রন্থে লিখে গিয়েছেন কিভাবে ধর্মীয় কারণে হিন্দুবিদ্বেষে সোহরাওয়ার্দী পুলিশকে নিয়োগ করেছিলেন হিন্দু নিধন যজ্ঞে।১৯৪৬এর ষোল‌ই অগস্ট মুসলমান গুন্ডারা অবাধে হিন্দু হত্যা,ধর্ষণ এবং সম্পত্তি লুন্ঠনে মেতে উঠেছিল। সাংবাদিক শংকর ঘোষ নিজে লালবাজারের কন্ট্রোলরুমে আবিষ্কার করেছিলেন সোহরাওয়ার্দীকে। আর সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রশিষ্য মুজিবুর রহমান? তিনি নিজেই তো নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দাঙ্গায়। দাঙ্গায় হিন্দু খুন করার শিক্ষা তো তিনি নিজের গ্রাম থেকেই নিয়ে এসেছিলেন। যেসময় হাজার হাজার হিন্দু তরুণ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করছিলেন, পুলিশের অত্যাচার সহ্য করছিলেন বা ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছিলেন,ঐসময় সোহরাওয়ার্দী আর তাঁর মন্ত্রশিষ্য মুজিবুর রহমান ব্যস্ত ছিলেন হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদের পরিকল্পনায়। সেটা ঢাকা দিতে প্রচুর পরিমাণে মিথ্যাচার করেছেন নিজের আত্মজীবনীতে।

নোয়াখালীর হিন্দুহত্যা নিয়ে এক লাইনের বেশি খরচ না করলেও বিহারের দাঙ্গা নিয়ে কিন্তু মুজিব বেশ সরব। মুলত মুজিবের উদ্যোগেই পটনা থেকে দাঙ্গাবিধ্বস্ত মুসলমানদের আসানসোল এবং পার্শ্ববর্তী জায়গায় নিয়ে আসা হয়।

আসলে মুজিবের লক্ষ্য ছিল জেহাদের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা।

কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও খুব একটা সুবিধা হয়নি। সোহরাওয়ার্দী , আবুল হাশিম আর মুজিবের বিরোধী শক্তি, নাজিমুদ্দিন, আকরাম খানেরা রাজশক্তির দখল নেন। এর কারণ ছিল সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের। সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় গেলে তাঁকে বাদামতলীর স্টিমারঘাটে পর্যন্ত নামতে দেওয়া হয় নি। সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় ফিরে পরে করাচী চলে যান।

মুজিব অবশ্য পূর্ববঙ্গের লোক হ‌ওয়ায় পূর্ববঙ্গের ছাত্রলীগের নেতা হতে অসুবিধা হয়নি। এদিকে আসাম থেকে আগত ম‌ওলানা ভাসানী রাজশক্তির পাত্তা না পেয়ে তৈরী করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। সামসুল হক ছিলেন তার সাধারণ সম্পাদক। মুজিব সেই দলে যোগ দেন এবং কুটনীতির চালে সামসুল হককে সরিয়ে নিজেই সাধারণ সম্পাদক হয়ে বসেন এবং তাঁর চেষ্টায় সোহরাওয়ার্দী এই আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ তার নাম থেকে”মুসলিম” শব্দটি বাদ দেয় শুধুমাত্র হিন্দু সমর্থন আদায়ের জন্য। মুজিব জীবনের শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও তিনি রমনা কালীমন্দির পুননির্মাণে অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন।

তথ্যসূত্র: ১.অসমাপ্ত আত্মজীবনী। শেখ মুজিবুর রহমান।
২. মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে মুজিব। কালিদাস বৈদ্য।

৩. The Sickle and The Crescent. Soumya Basu and Sunanda Sanyal.

৪. এমনটা তো হয়েই থাকে। নারায়ণ সান্যাল।
৫. হস্তান্তর। প্রথম পর্ব। শংকর ঘোষ।