২০২১ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যার ফুলঝুরি – ২

0
740

(প্রথম পর্বের পর)

৬। মিছিলে আন্না হাজারে-র অনুপস্থিতি নিয়ে মমতার মিথ্যা কথা

তাঁর জাতীয় গুরুত্বকে আরো কিছুটা বাড়িয়ে তোলার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ২০১৪ সালে জাতীয় রাজধানীর রামলীলা ময়দানে সমাজকর্মী আন্না হাজারে-র সঙ্গে একটি যুগ্ম মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু আন্না হাজারে তাঁর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সেই মিছিলে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত নেবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর মুখ অপমানে লাল হয়ে যায়। যাইহোক, আসল কথা হল, এই মিছিলটি ফাঁকাফাঁকাভাবে সম্পাদিত হওয়ার জন্য উক্ত যুগ্ম মিছিল থেকে হাজারে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

লজ্জার থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য মমতা ব্যানার্জী মিথ্যার আশ্রয় নিলেন যে এই মিছিলটি আসলে দুর্নীতি-বিরোধী ধর্মযোদ্ধাদের প্রভাবে আয়োজিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এটা আমাদের মিছিল ছিল না। এটি আন্নাজির পীড়াপীড়িতে আয়োজিত হয়েছিল। এটা তৃণমূল কংগ্রেসের মিছিল ছিল না

মমতা ব্যানার্জীর কথার উত্তরে আন্না হাজারে তখন স্পষ্ট করে বলেন যে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধানের সঙ্গে যুগ্মমিছিল বাতিল করে দিয়েছেন কারণ মাত্র ৪০০০ লোকও এটিতে অংশগ্রহণ করতে আসেননি এবং তাঁকে ভুলপথে চালিত করা হয়েছে।

আসল সত্যটি পরে প্রকাশিত হয়েছিল যখন দিল্লির মিউনিসিপাল কর্পোরেশান একটি রসিদের টুকরো প্রকাশ্যে এনেছিল। এখানে দেখা যায় যে রামলীলা ময়দান আসলে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি আগে থেকে নিয়ে রেখেছিল।

৭। বিদ্যাসাগরের মূর্তির সারি

২০১৯ সালে একটি রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়ে যায় যখন চারদিকে খবর ছড়াতে শুরু করে যে উত্তর কোলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি একদল দুর্বৃত্ত এসে ভেঙে দিয়েছে। তৃণমূল ও বিজেপি উভয় দলই এই ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করতে শুরু করে দেয়।

আসল সত্যটা হল, কোলকাতায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সমাবেশে হামলার পরে কোলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে দুবৃত্তরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুর করেছিল।

এই ঘটনার পর মমতা ব্যানার্জী এই হিংসার জন্য বিজেপিকে দোষারোপ করা শুরু করে দেন যেখানে প্রমাণিত সত্য যে এটি তৃণমূলই শুরু করেছিল। মমতা ব্যানার্জী তখন একজন ব্যক্তিকে হাতে প্লাস্টার বেঁধে সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। তিনি দাবি করেন যে বিজেপি কার্যকর্তা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ছাত্রনেতা তীর্থ প্রতিম সাহা-কে আহত করেছেন।

মমতা ব্যানার্জী অত্যন্ত লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যান যখন তীর্থ প্রতিম সাহা নিজেই স্বীকার করেন যে তিনি বেশ কিছুদিন আগে আহত হয়েছিলেন। এটি শীঘ্র প্রমাণিত হয়েছিল যে মমতা ব্যানার্জী রাজ্যে বিজেপির উত্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পূর্ব-পরিকল্পিত আঞ্চলিক উগ্র জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করার জন্য একজন নকল নিগৃহীত লোক সাজিয়ে এনেছিলেন।

৮। মমতা ব্যানার্জী:কখনোই আমরা সিপিএম-এর কার্যালয় দখল করিনি

যদিও বহু বছর ধরে তৃণমূলের প্রধান রাজ্যে তাঁর ভোটারদের প্রচুর সমর্থন উপভোগ করেছেন, তবু বিজেপির প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার কারণে এটি হারানোর ভয়ে তিনি অসংখ্য মিথ্যা কথা ও ছলনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে অষ্টম বছর ক্ষমতায় ছিল, তাঁর দল সিপিএমের একটিও দলীয় কার্যালয় দখল করেনি।

এটি একটি নির্লজ্জ মিথ্যা। ২০১১ সাল পর্যন্ত সিপিএমের প্রচুর দলীয় কার্যালয় ছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বামফ্রন্টের হেরে যাওয়ার পর এগুলি তৃণমূল কংগ্রেস দখল করে নিয়েছিল এবং এর জোড়াফুলের চিহ্ন দেওয়ালে অঙ্কিত হয়েছিল।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর যখন বিজেপি রাজ্যে প্রবেশের পথ সাফল্যের সঙ্গে অর্জন করে নেয়, সিপিএম তখন পশ্চিমবঙ্গে তাদের ১৫০টি দপ্তরের উপর পুনরায় অধিকার বিস্তার করতে সক্ষম হয়, যেগুলি বলা হয় যে ২০১১ সালে বামফ্রন্টের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর শাসক তৃণমূল কংগ্রেস জোরজবরদস্তিমূলকভাবে দখল করে নিয়েছিল।

বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, কুচবিহার, বর্ধমান, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগণা এবং হাওড়ার নানা দলীয় কার্যালয়গুলি সিপিএমের প্রার্থীরা শুধু পুনর্দখল করেছিল তাই নয়, কিন্তু কার্যালয়ে তাদের দলের প্রতীকও অঙ্কিত ছিল এবং কার্যালয়ে দলীয় পতাকাও উড়তে দেখা গেছে।

৯। মমতা ব্যানার্জীর এমজিএনআরইজিএ সংক্রান্ত মিথ্যা

২০১৩ সালে দুই বছর দপ্তরে থেকে মমতা ব্যানার্জী অনেকবড় বড় দাবি করেছেন, বিশেষত মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এমজিএনআরইজিএ)এর আওতায় বেকার প্রাপ্তবয়স্কদের ১০০ দিনের কাজ দেওয়া নিয়ে। তাঁর সরকার দাবি করে যে ২০১২-১৩ সালের তালিকায় ৪৪৭৫.৮০ কোটি টাকার প্রকল্পের রূপায়ণে রাজ্য প্রথম হয়েছে, এটি দেশে সবথেকে বেশি এবং এর জন্য ৫৭.৭৬ লাখ পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে।

তৃণমূল সরকার একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে উন্নয়নের মাত্রায় প্রথম হবার লম্বা চওড়া দাবি করেছিল।

দেখা গেল, এটিও একটি প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতীয় পরিসংখ্যান তখন বলে যে সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ ২৪তম স্থানে রয়েছে। তখনকার কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন : তালিকায় রাজ্য ২৪ তম স্থান অর্জন করেছিল, যেখানে সরকার (তৃণমূল) খুব গর্বভরে অন্য কিছু দাবি করেছিল। এটি সহজেই রাজ্য প্রশাসনের মিথ্যাকে দৃঢ়ভাবে ধরতে পেরেছিল কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচনের পূর্বে তাঁরা মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন

জাতীয় পরিসংখ্যানে এও বলা হয় যে ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৩৫ নং স্থানে নেমে যায়।

তাই এমজিএনআরইজিএ-এর তালিকায় প্রথম হওয়ার মিথ্যা কথার বিপরীতে তৃণমূল শাসনকালে বেকারত্বের হার অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্ব বিস্ময়করভাবে ২১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ সর্বদাই এমজিএনআরইজিএ-এর বিলম্বিত বেতনের তালিকায় সবচেয়ে বেশি শতাংশের অধিকারী এবং এটি সারা রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের কাটমানির ভারে জর্জরিত, যেখানে কর্মীদের এই প্রকল্পের অধীনে কাজ পাওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।

১০। বাংলায় অনাহারে মৃত্যু নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর মিথ্যা

২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়্গ্রাম জেলায় লালগড়ে সাতজন শবর গোষ্ঠীদের সদস্যদের সম্ভবত অনাহারে মৃত্যু হওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর মমতার সরকারকে তীব্রভাবে সমালোচনা করা হয়।

তাঁর নিজের গা বাঁচানোর জন্য তিনি এই সকল প্রতিবেদনগুলিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে অনাহারে কেউ মারা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে এই মৃত্যুগুলি হয় বার্ধক্য জনিত রোগ’- এর জন্য হয়েছিল নতুবা অত্যধিক মদ্যপানের জন্য

তিনি রাজ্য বিধানসভায় বলেছিলেন, যে প্রতিবেদনগুলিতে বলা হচ্ছে যে শবর গোষ্ঠীর কিছু মানুষ অনাহারে মারা গেছে, সেগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো ঘটনা। বাংলায় কেউ অনাহারে মারা যায়নি

তিনি আরো বলেন, জঙ্গলমহ্লে মানুষ অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য বা বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে। যেখানে দুইজন অসুস্থতা ও বেশি বয়সের জন্য মারা গেছেন, যেখানে অপর লোকেরা অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য লিভারের সমস্যা হওয়ায় মারা গেছেন

যাইহোক, একটি সার্ভেতে তৃণমূল সুপ্রিমোর দাবিগুলিকে চূর্ণ করে দিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয় যে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের ৩১% আদিবাসী পরিবারগুলিতে নানা মাত্রায় খাবারের অভাব ছিল”, যার অর্থ হল যে এই রাজ্যে আদিবাসী জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভুগছে এবং তারা অনাহারী।

এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে বছর জুড়ে আদিবাসী পরিবারগুলিতে যে সার্ভে করা হয়, তাতে দেখা যায়, ৫২টি মৃত্যুর মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে ৪৮জন লোক অসময়ে মারা গেছেন এবং মাত্র ৪জন বৃদ্ধ বয়সের জন্য মারা গেছেন।

(ক্রমশ)

মূল লেখাটি লিখেছেন ঝঙ্কার মোহতা, অপইন্ডিয়া পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।