সেক্যুলার মৌলবাদ

শ্রী অমিতাভ গুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখাতে চেয়েছেন, কেন আর এস এস অন্যদের জন্য তো বটেই, কেন হিন্দুদের জন্যও খারাপ। তাঁর লেখাটির মূল দর্শনটি একটি মৌলবাদ – সেক্যুলার মৌলবাদ। কেন তাই না হয় বলি।

আমি লেখাটির মূল নির্যাসটি এখানে পরিবেশন করি। লেখাটিতে আর এস এস নানান সামাজিক কার্যক্রমের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সংঘের প্রতি যে দলিত বা আদিবাসী মানুষ ক্রমশঃ আকর্ষিত হচ্ছেন তা তিনি তুলে ধরেছেন। আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হল না। কিন্তু আর এস এসের যে কোন সদস্য এতে গর্ব অনুভবই করবেন। আগে একটা ন্যারেটিভ ছিল আর এস এস উচ্চবর্ণ হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান। শ্রী অমিতাভ গুপ্ত তথ্যের আলোকে সেই ন্যারেটিভের ভ্রান্তি স্বীকার করে নিয়েছেন। বস্তুতঃ, তাঁর প্রবন্ধে তথ্যগত কোন ভুল নজরে এল না। এজন্য আমি তাঁকে শ্রদ্ধেয়ই মনে করি।

এ সব কিছুর পরেও তিনি জানিয়েছেন আর এস এস তাঁর বিচারে ভুল, ভীষণভাবে ভুল। কারণ তারা হিন্দু মৌলবাদী আর শ্রী গুপ্ত সেক্যুলারবাদের পক্ষে। এই যুক্তিটি হয়ত আধুনিক ভারতে বা বাংলায় খুব চলে। কিন্তু ইতিহাস খুঁজলে এই সেকুলারবাদী যুক্তির সাথে মিল পাওয়া যায় ধর্মীয় মৌলবাদী যুক্তির।

বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ যথা কুরআন বাইবেল আদি পড়লে জানা যায়, সেই সব গ্রন্থ বলে যে সৃষ্টিকর্তা (আল্লা বা জিহোভা) মানুষের কর্ম নিয়ে তেমন ভাবিত নন। তিনি অধিক ভাবিত মানুষ তাঁকে স্বীকার করে কিনা, তাঁর প্রেরিত পয়গম্বরকে মানে কিনা। যদি কেউ তা মানে তবে তার জুটবে অনন্ত স্বর্গসুখ মৃত্যুর পর। অন্যথা অনন্তকালের জন্য নরকগমনকেই বা রুখতে পারে! অর্থাৎ কর্ম হোক যেমন তেমন, বিশ্বাস হোক পবিত্র কিতাবে বা পয়গম্বরে। ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন, তা সেই আধুনিক ইরাকের আইসিস-ই হোক বা মধ্যযুগের গোয়ার চার্চের ইনক্যুইজিশন, বলে, আমি তোমার কর্ম ভালো কি মন্দ তার বিচার করব না। তোমরা যদি পবিত্র কিতাব বা পয়গম্বরে বিশ্বাস না কর, তবে তোমার জন্য জুটবে বুলেট বা আগুন।

শ্রীগুপ্তও অনুরূপ ভাবে হয়ত বলতে চেয়েছেন, কর্ম হোক যতই ভালো, সেক্যুলার বাদে বিশ্বাসই একমাত্র মানুষকে সঠিক করতে পারে। আর এস এসের কর্ম যেমনতরোই হোক, যদি তারা নিজেদের সেক্যুলার না বলে হিন্দু বলে, তবে তারা ঘৃণার্হ। অন্যদিকে যাঁরা নিজেদের সেক্যুলার বলেন, তাঁদের কর্ম বিচার করার কোন প্রয়োজন নেই। সেক্যুলার বলেই তাঁরা শ্রদ্ধেয়। তাঁর মত অনেকে এটা খোলাখুলি বলেই থাকেন যে শ্রী রাহুল গান্ধী এই কারণেই শ্রদ্ধেয় – তিনি সেক্যুলারবাদী। শ্রী গান্ধীর কর্ম নিয়ে তাঁরা তেমন ভাবিত নন। দেখাই যাচ্ছে আব্রাহামীয় ধর্মমতগুলির মত সেক্যুলারবাদ কেবল বিশ্বাসকেই মান্যতা দেয়, কর্মকে নয়।

সেক্যুলারবাদ বা লিবারেলবাদ যে এক ধর্মীয় বিশ্বাস (ইংরেজীতে যাকে কয় religion), এ কথা কিন্তু আমি বলছি না। বাঘা বাঘা পণ্ডিতরা বলেছেন।

প্রথমে আসি Sapiens: A Brief History of Mankind (2011) বইটিতে।  আমরা সবাই জানি এই বইটি কি বিশাল আলোড়ন তুলেছেন সারা পৃথিবীর বিদগ্ধ পাঠকমহলে। লেখক Yuval Noah Harari দ্বাদশ অধ্যায়ে লিখছেন,

“The modern age has witnessed the rise of a number of new natural-law religions, such as liberalism, Communism, capitalism, nationalism and Nazism. These creeds do not like to be called religions, and refer to themselves as ideologies. But this is just a semantic exercise. If a religion is a system of human norms and values that is founded on belief in a superhuman order, then Soviet Communism was no less a religion than Islam.”

অর্থাৎ, বর্তমান যুগে লিবারেলবাদ, কম্যুনিজম, উদার অর্থনীতিবাদ, জাতীয়তাবাদ এবং নাৎসীবাদ নামক বহু ধর্মমতের উৎপত্তি হয়েছে যারা প্রকৃতির নিয়মকে বর্ণনা করতে চায়। এরা হয়ত নিজেদের ধর্মমত না বলে আদর্শবাদ বলতে চায়। কিন্তু এ কেবলই কথার মারপ্যাঁচ। যদি ধর্মমত মানে হয়, মানুষের রীতিনীতির কোন প্রতিষ্ঠান যারা অতিমানবীয় কোন নিয়মে বিশ্বাস করে, তবে সোভিয়েতের কম্যুনিজম ইসলাম থেকে কিছুমাত্র আলাদা বিশ্বাসবাদ নয়।

একই কথা অনেক আগে পড়েছিলাম সুরসিক সিলেটী পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলীর মুখে। তাঁর “টুনি মেম” গ্রন্থের “ভ্যাকুয়াম” নামক প্রবন্ধটিতে (সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৭, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১৪০৮ বঙ্গাব্দ)। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে কম্যুনিস্ট বা নাৎসীবাদ ধর্মমতের সমতুল্য। তাঁর মত রসসিক্ত কলম আমার নেই। কিন্তু তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি দেখাব কিভাবে সেক্যুলারবাদও ধর্মমতের মত এক বিশ্বাসবাদ মাত্র।

সেক্যুলারবাদের শুরু এইভাবে যে সমষ্টিজীবনকে ধর্মজীবন থেকে আলাদা করতে হবে। তার জন্য ধর্ম যা যা করে থাকে, তার অনুরূপে সেক্যুলারবাদ এক আলাদা বিশ্বাসবাদ সৃজন করবে। সাম্প্রদায়িক ধর্মমত বলে, আমার মত সঠিক, বাকী সব ভুল। সেক্যুলারবাদের “ইমান” (আলী সাহেবের ভাষায়) বলে, সব ধর্মমত এক্কেবারে একরকম। কোনটাই অন্যটার চেয়ে একচুল এদিক ওদিক নয়। সমস্ত ধর্মমতকে একনজরে দেখা উচিত তা তার উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্যেই হোক বা আমাদের দেশে। এটাই সেক্যুলারবাদের মূল। এই মূল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই সেক্যুলার মৌলবাদ রচিত।

খ্রীষ্টান বা ইসলাম ধর্মমতের ক্যাথলিক/প্রোটেস্ট্যাণ্ট বা শিয়া/সুন্নীর মত দুটি শাখা আছে যারা মূল একই “সত্যে” (যেমন, বাইবেল বা কুরআনের কথাগুলিতে) বিশ্বাসী হলেও অন্য কিছু ব্যাপারে ভীষণভাবে দ্বিমত পোষণ করে। যেমন, ক্যাথলিকরা মনে করে পোপ এবং পোপের চার্চই একমাত্র পথ, প্রোটেষ্ট্যাণ্টরা পোপের বিরোধী। শিয়ারা মনে করে আলীর বংশধরদের খলিফা হওয়া ন্যায় এবং সুন্নীরা মনে করে, আলীর বংশধরদের সে যোগ্যতা নেই। সেরকম সেক্যুলারবাদেরও আছে দুটি শাখা। সেক্যুলারবাদের এক শাখা হচ্ছে সাংস্কৃতিক মার্কসবাদ শাখা যারা বলে সবধর্মই সমানভাবে ভুল। অন্য শাখা হল সর্বধর্মসমভাব শাখা যারা বলে সব ধর্ম একদম সমানভাবে সঠিক।

সব বিশ্বাসবাদের পবিত্র কিতাব থাকে যা অখণ্ডনীয়। যেমন খ্রীষ্টানদের বাইবেল, মুসলমানদের কুরআন। মুজতবা আলী জুড়েছেন, কম্যুনিজমের পবিত্র কিতাব দাস ক্যাপিটাল, নাৎসীবাদের মাইন কাম্পফ। সেরকম ভারতীয় সেক্যুলারবাদের মূল কিতাব ভারতীয় সংবিধান। এই ভারতীয় সংবিধানকে এক বিশেষ সময়ে আমাদের দ্বারা সৃষ্ট একটি গ্রন্থ হিসাবে না দেখে কোন এক অখণ্ডনীয় সত্য হিসাবে দেখা। যার পরিবর্তন করা দূর থাক, যার কোন কথার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করাও পাপ।

এবার আসা যাক, পয়গম্বর বা এক অখণ্ডনীয় মানুষের কথা। ইসলামের যেমন পয়গম্বর মুহম্মদ (সাল্লালুহা অলায়হি ওয়া সাল্লাম), খ্রীষ্টানদের যেমন যীশু খ্রীষ্ট (কুমারী মেরীর গর্ভে তাঁর জন্ম; জিহোভার পুত্র), তেমনই কম্যুনিজমের পয়গম্বর, মুজতবা আলী লিখেছেন, তাদের শাসনকর্তা লেনিন বা স্টালিন। সেরকম সেক্যুলারবাদের পয়গম্বর গান্ধী এবং নেহরু। গান্ধী বা নেহরু কোনভাবে কোথাও ভুল ছিলেন, এ কথা কোন সেক্যুলার মৌলবাদী স্বীকার করবেন না। পয়গম্বর মহম্মদকে নিন্দা করা যেমন কোন মৌলবাদী সহ্য করে না, তেমনই গান্ধী বা নেহরুর নিন্দা করাও সেক্যুলার মৌলবাদী সহ্য করে না। গান্ধীর বিরোধী কোন গ্রন্থ বা চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করতে হবে এমন দাবী কান পাতলেই শোনা যায়।

প্রত্যেক ধর্মমতের আছে উৎসব। সেক্যুলারবাদের উৎসব হল তাদের পয়গম্বরদের জন্মদিন। ঐদিন তাঁরা কত বড় ছিলেন তা বলার ধূম পড়ে যায়।

প্রত্যেক ধর্মের আছে তীর্থস্থান। সোভিয়েত দেশে ছিল লেনিন-স্টালিনের মৃতদেহ মমি করা। দলে দলে তা দেখতে আসত। দিল্লীতে রাজঘাট, তিনমূর্তি ভবন হয়ে গেছে গান্ধী বা নেহরুর উদ্দেশ্যে সমর্পিত সেক্যুলারবাদের তীর্থস্থান। যদি বলা হয় তিনমূর্তি ভবনে অন্য প্রধানমন্ত্রীদের স্মৃতিও রাখা হোক, সেক্যুলার মৌলবাদী তাতে তীর্থের মাহাত্ম্য কমে যাবে ভেবে অস্থির হয়ে ওঠেন।

বিশ্বাসবাদগুলি তাদের বিরোধী কিছু বলতে দেয় না। যেমন ইসলামীয় দেশে কুরআনের সমালোচনা নিষিদ্ধ। খৃষ্টীয় প্রতিষ্ঠানে বাইবেলের সমালোচনা নিষেধ। ভারতেও বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে তুলনামূলক চর্চা করা মানা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বা হিন্দুধর্ম বিষয়ক পড়াশুনা সেক্যুলারবাদের জন্য করতে দেয় না। কারণ এইরকম পড়াশুনায় বিভিন্ন ধর্মমতের বিভিন্নতা প্রতিভাত হবে যা সেক্যুলার মৌলবাদের বিরোধী।

প্রত্যেক ধর্মমতে থাকে কিছু সংস্কারক যাদের মতে আসল ধর্মমতটি উত্তম, কিন্তু খারাপ করছে কিছু ধর্মধ্বজী। যেমন ডিরোজিও ছিলেন দৃঢ় খ্রীষ্টান কিন্তু তিনি বহু খ্রীষ্টীয় যাজককে ভুল মনে করতেন। হ্যাঁ পাঠক, এই মত আপনি উৎপল দত্তের অভিনীত চলচ্চিত্রটিতে পাবেন না। এটার জন্য আপনাকে পড়তে হবে রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়ের নবরূপে ডিরোজিও বইটি। সংক্ষেপে বলি, খ্রীষ্টান না হবার জন্য মানবতাবাদী ডেভিড হেয়ারের মৃতদেহের কপালে কবরখানা জোটেনি। যেমন জোটেনি বলিউড অভিনেত্রী প্রিয়ঙ্কা চোপরার মালয়ালি খ্রীষ্টান ঠাকুমার  হিন্দুকে বিয়ে করার অপরাধে। অপরপক্ষে, ডিরোজিও বহাল তবিয়তে খ্রীষ্টীয় কবরখানায় শায়িত। যাই হোক, সেরকম সেক্যুলারিজমের কিছু সংস্কারক আছেন যারা আসল সেক্যুলারিজম এবং নকল সেক্যুলারিজমের কথা বলেন। তাঁদের মতে আসলকে খারাপ করছে এই মেকী-সেক্যুলারবাদীরা। তাঁরা আসল সেক্যুলারবাদ আনয়নের কথা বলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কারা তা বিচারের ভার পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম।

আমার কথাটি ফুরালো না, কারণ এই কথাগুলি সবই পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণায় প্রমাণিত। সেগুলির কথাও বলা প্রয়োজন। কিন্তু আর লিখলে সম্পাদক আমায় দেবেন কানমলা। তাই পরের বারের জন্য তুলে রাখলাম অবশ্যই যদি আপনারা আমার ভ্যাঁজর ভ্যাঁজর আরও শুনতে চান।