হিন্দুদের ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’ আইনের মত নির্বোধ পরিকল্পনা ও অলস মানসিকতা পরিত্যাগ করা উচিত

0
1908

অরিহন্ত পাওয়ারিয়া

অতীব সরল সমাধানগুলির থেকে ভয়ানক আর কিছুই নেই, কারণ এগুলিকে দেখলে আপাতভাবে মহৌষধি বলে মনে হয়, কিন্তু এগুলি উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে।কিন্তু দুঃখের বিষয় এরকম ধারণাই অধিক সংখ্যক মানুষের দ্রুত সমর্থন লাভ করে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন

‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন’ সেরকমই একটি প্রস্তাব এবং প্রতারকরা এটিকে ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে বিপুল মাত্রায় জালিয়াতি করে যে এটি কেবল ভারতীয়দের অধিক জনসংখ্যার সমস্যাকে সমাধান করবে তা নয়, এমন কি মুসলিমদের অনেক দশক ধরে প্রচুর সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে হিন্দুদের উপর যে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে চলেছে তারও সমাধান করবে।

স্বাধীনতার সময় থেকে, প্রায় ৩৫ জনেরও বেশি ব্যক্তিগত সদস্যদের বিল এই অত্যধিক জনসংখ্যার সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সংসদে পেশ করা হয়েছে, কিন্তু কোনটাই পাশ হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীর শাসনে জরুরী অবস্থা চলাকালীন বর্বরোচিত পন্থা অবলম্বন করার পরেই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে দৃঢ় ও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পেশ করা দাবিগুলি একদম নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ঐ সময় বলপূর্বক লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বীজকরণও করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বিজেপি নেতাদের নেতৃত্বে এই “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ”-এর এই দাবিটি আবার সরব হয়ে উঠেছে।

২০১৬তে বিজেপি সাংসদ প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর একটি ব্যক্তিগত সদস্যের বিল পেশ করেছিলেন। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ রাকেশ সিনহা ২০১৯-এ এই একই কাজ করেছিলেন। ২০১৮তে প্রায় ১২৫ জন সাংসদ রাষ্ট্রপতিকে দুটি সন্তানের নিয়মের দৃঢ় বাস্তবায়নের জন্য লিখিত অনুরোধ করেছিলেন। বিজেপি নেতা অশ্বিনী কুমার উপাধ্যায় দিল্লী আদালতে এই একই বিষয়ের জন্য একটি জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা দায়ের করেছিলেন কিন্তু এটিকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর তিনি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে যান।

এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, শিবসেনার সাংসদ অনিল দেশাই একটি ব্যক্তিগত সদস্যের বিল উত্থাপন করেন যেটি “ছোট পরিবার গঠনের প্রচার”-কে দেশের সাংবিধানিক কর্তব্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে একটি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব রাখে। মার্চ মাসে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভিও দেশজুড়ে দুটি সন্তানের নিয়মের আইন বলবৎ করেছিলেন। কিছু দিন পর, বিজেপি সাংসদ অনীল আগরওয়াল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে জনবিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিল পেশ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।

বিগত বছরে স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রধানমন্ত্রী মোদী এই বিষয় নিয়ে কথা বলার পর থেকেই হিন্দু চক্রের আইন দ্বারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার উৎসাহ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোদী একটি ছোট পরিবার গঠন করার সিদ্ধান্তকে এক প্রকার দেশভক্তিরই নামান্তর বলে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি মানুষকে তাঁদের পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আহ্বান করেছিলেন যাতে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

এই বক্তৃতার কিছু মাস পরে, দ্য সানডে গার্ডিয়ান বিবৃত করে যে কেন্দ্রীয় সরকার জনবিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন বলবৎ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিষেরবার মারফত আমাদের প্রাথমিক নিরীক্ষণগুলি করা শুরু করেছেন।

যা রটে, তার কিছুটাও তো বটে। আর উপরোক্ত সকল ঘটনাগুলি ইঙ্গিত করে যে আসলে হয়ত এর আড়ালে অন্য কিছু ঘটে চলেছে।।

কেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন একটি ভয়াবহ পরিকল্পনা ?

প্রথমে, যাঁরা এই ধরনের আইনের মাধ্যমে নিম্নতর জনসংখ্যা অর্জন করতে চান, তাঁদের মত অবিলম্বে আমাদের বর্জন করতে হবে। সর্বোপরি, ভারতবর্ষে মহিলাদের গড় প্রজনন হার (টি এফ আর) (২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে) ইতিমধ্যেই ২.১ বা প্রতিস্থাপন স্তরের কাছাকাছি। এর অর্থ হল – আমরা যদি কিছু না করি, এই জনসংখ্যা ধ্রুবক থাকবে এবং বৃদ্ধি পাবে না। বাস্তবিক অর্থে ২০২১ সালের জনগণনায় আশা করা হচ্ছে যে এই টি এফ আর এর মান প্রতিস্থাপন স্তরের নীচে নেমে যাবে এবং আগামী বছরগুলিতে নগরায়ণ ও শিক্ষাগত স্তরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এটি আরো অধোগামী হবে। তাই এমন কোনো সমস্যার সমাধানের কথা উপস্থাপন করার একেবারেই কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই যে সমস্যার প্রকৃতপক্ষে কোনো অস্তিত্বই নেই।

দ্বিতীয়ত, আসল সমস্যাটি সর্বোপরি গড় প্রজনন হারকে নিয়ে নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট গড় প্রজনন হারকে নিয়ে – মুসলিম মহিলাদের গড় প্রজনন হার এবং কিছু দরিদ্র, গ্রাম্য রাজ্যগুলির গড় প্রজনন হারকে নিয়ে (প্রাথমিকভাবে পূর্ব ভারতে) ইতিমধ্যেই ২৪টি রাজ্যে প্রতিস্থাপন স্তরের নিম্নে যা নির্দেশ করে যে তাদের জনসংখ্যা আগামী দশকগুলিতে হ্রাস পাওয়া শুরু হবে।

এখন, গ্রাম্য অঞ্চলে উচ্চ গড় প্রজনন হার একটি ধর্মমত নির্বিশেষের সমস্যা এবং এটিকে আরো অধিক অর্থনৈতিক প্রসার, শিক্ষা, সচেতনতা বিস্তারের অনুষ্ঠান, উন্নত পরিকল্পনা ইত্যাদির দ্বারা সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে।

মুসলিম গোষ্ঠীর উচ্চ গড় প্রজনন হার -ই প্রধান সমস্যা যা, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন’গুলি এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে- এই তত্ত্বকে সমর্থন করে।

তাই যতক্ষণ না ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন’ কেবলমাত্র মুসলিম গোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে বলবৎ হচ্ছে, এই পরিকল্পনাটি অবশ্যই ত্যাগ করা উচিত।

কারণ এরূপ কোনো আইন মুসলিম মহিলাদের গড় প্রজনন হার হ্রাস করতে তো পারেই না , এমন কি সুদূর ভবিষ্যতের জন্য বিষয়টিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যায় কারণ কেউই এই পরিকল্পনার দ্বিতীয় স্তরের প্রভাবগুলি নিয়ে চিন্তা করেননি।

সমস্ত ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন’গুলিতে যে সকল পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, তাদের দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে – শাস্তি এবং পুরষ্কার। প্রথম ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে পছন্দের অগ্রাধিকার, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, কর বিরতি ইত্যাদি পুরষ্কারের কথা বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আইন-লঙ্ঘনকারীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, সরকারি ভর্তুকি পাওয়া ইত্যাদি বিষয় থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।

এই পন্থাগুলি আমাদের বলে যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনের সমর্থকরা বিশ্বাস করে যে মুসলিমদের মধ্যে উচ্চ টি এফ আর একটি ধর্মমত নিরপেক্ষ সমস্যা। এর বিপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কেরালায় উচ্চ সাক্ষরতা সত্ত্বেও মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে টি এফ আর কিছুই হ্রাস পায়নি।

যদি মুসলিম গোষ্ঠীর মানুষকে অধিক সন্তান উৎপাদনের জন্য ধর্মীয়ভাবে উৎসাহিত হয় যাতে আগামী কিছু দশকের মধ্যে তাঁরা জনসংখ্যাগত দিক থেকে ভারতের কর্তৃত্ব পেতে যারেন, সেক্ষেত্রে কর ছাড় অথবা ভর্তুকি কমানো জনসংখ্যার উপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ ভারতে এমন বহু সংখ্যক করদাতাও নেই বা এমন বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মুসলিমও নেই যাঁরা সরকার থেকে প্রাপ্ত র‍্যাশন ছাড়া জীবনধারণ করতে পারবেন না।

যে একমাত্র শ্রেণীটি এর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁরা হল দরিদ্র হিন্দুরা। ধনী হিন্দুদের সন্তান না ধারণ করার জন্য কর বিরতির প্রয়োজন নেই। তাঁরা এমনিও সন্তান ধারণ করছে না। বাস্তবিক অর্থে, তাঁদের অধিক সন্তান উৎপাদনের জন্য কর বিরতি দেওয়া প্রয়োজন, স্বল্পের জন্য নয়। এটাই হল আসল সমাধানের জায়গা।

হিন্দুদের জনবিন্যাসে না হারার জন্য কি করা উচিৎ?

হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বুঝতে হবে যে মুসলিমদের উচ্চ গড় প্রজনন হার আসল সমস্যা নয়, বরং মুসলমান ও হিন্দুদের প্রজনন হারের বৈষম্যই হিন্দুরাই আসল সমস্যা। তাই আমাদের এই ব্যবধানটিকে কমিয়ে আনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে মুসলিম গড় প্রজনন হার যখন নিজে থেকেই কমে আসতে থাকবে, তখন হিন্দু গড় প্রজনন হার বৃদ্ধির দিকে অধিক জোর দেওয়া উচিত। এটা এখন পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত যে কীভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন সকলের উপর সমানভাবে বলবৎ হলে তা অদূর ভবিষ্যতে হিন্দুদেরই ক্ষতিসাধন করবে।

কিন্তু হিন্দুদের গড় প্রজনন হার বৃদ্ধি করার চিন্তা করার আগে আমাদের একটা জিনিস স্পষ্ট করতে হবে যে আমরা কখনই দরিদ্র হিন্দুদের আর সন্তান ধারণ করতে দিতে চাই না বরং আমরা ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের হিন্দুদের অধিক সন্তান নিতে উৎসাহ প্রদান করছি। এই গোষ্ঠীটিকে আমাদের অন্ততপক্ষে দুটি সন্তানলাভ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা উচিত অথবা সামাজিক ভাবে ঐদিকে ঠেলে দেওয়া উচিত।

শহুরে হিন্দুরা কেন পরিবার শুরু করা বা এমনকি সঠিক সময়ে বিবাহ করা থেকে বিরত থাকছে, তার অসংখ্য কারণ আছে। দুটি মুখ্য কারণ হল- অর্থনৈতিক কারণ এবং কোনো প্রকার দায়িত্ব নেওয়ার অনীহা/ জীবন উপভোগের প্রবণতা। প্রথম কারণটি সরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে (ভারতের শহুরে অঞ্চলগুলির উপর বেশি জোর দিয়ে) যা উচ্চমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা অত্যন্ত ভর্তুকিযুক্ত মূল্যে প্রদান করবে কারণ এই দুটি মুখ্য বিষয় পরিবার পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের মাথায় বেশি করে ঘোরে। দ্বিতীয়টি অধিকতর কঠিন এবং এর জন্য পারিবারিক স্তরে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন এবং তাঁদের মতামত পরিবর্তন করার জন্য হিন্দু সামাজিক/ ধর্মীয় সংগঠনগুলির তৃণমূল স্তর থেকে কাজ করা প্রয়োজন ।

তাছাড়াও, স্বরাজ্যের সম্পাদক জগন্নাথন জীর পরামর্শমত, হিন্দুধর্মকে আগ্রাসী ধর্মবিস্তারে নামতে হবে।

এইসবগুলি করা সংসদে আইন পাশ করার মত এত সহজ নয়, কিন্তু এগুলি খুবই কার্যকর হবে। হিন্দুত্ববাদী পক্ষকে অলস সংক্ষেপে কাজ সারার মনোভাবটি ত্যাগ করতে হবে এবং আইন পাশ করে কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে ভেবে নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলা বন্ধ করতে হবে।

বর্তমানে জনসংখ্য়াগত অবস্থা বজায় রাখার জন্য হিন্দুদের বিপুল সামাজিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তবে এটি যেকোনও সভ্যতা রক্ষার সংগ্রামের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য।

লেখক সাংবাদিক। স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত মূল লেখা ‘Population Control Bill’ Is A Daft Idea; Hindus Need To Shun Lazy Shortcuts And Come Up With Practical Solutions থেকে অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।

(লেখকের মতামতের জন্য বঙ্গদেশ পত্রিকা দায়ী নয়।)