খেলা শেষ, খেলা শুরু: কোন পথে বাংলা

0
887

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ২০২১ শেষ রেকর্ড সৃষ্টি করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরে এলেন যে ‘হাইপ’ নিয়ে বিজেপি স্বপ্ন দেখিয়েছিল ‘বাংলা জয়’ করার, তা আপাতত শেষ ‘খেলা হবে’ শেষ; কিন্তু আরেকটি ‘খেলা শুরু’ হচ্ছে?

প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই ভারতীয় নির্বাচন কমিশনকেএই প্রথম নির্বাচনপর্বে আগের তুলনায় অনেক কম নির্বাচনীহিংসা সংঘটিত হতে পেরেছেশীতলকুচির মর্মান্তিক ঘটনা নিশ্চয়ই আমাদের ভবিষ্যতে নির্বাচনীসংঘর্ষ কম রাখতে মনে করাবেএকই সঙ্গে নির্বাচনপরবর্তী হিংসা বাঙালি সমাজকে আবারও গ্রাস করে চলেছেএর শেষ কোথায়?

এবার কয়েকটি কথা, কিছু বিশ্লেষণএই নির্বাচন আবার প্রমাণ করল যে, বাঙালি সমাজ মূলত একদ্বিমেরু’, দ্বিপক্ষীয়’- ‘বাইনারিরাজনৈতিকসমাজ, যা আমরাওরা’, এপক্ষওপক্ষ’, ‘মিত্রপক্ষশত্রুপক্ষ’-বিভক্ত একটিপার্টিসমাজ’। এখানে বিরোধীপক্ষ বলে কিছু নেই, আছে শত্রুপক্ষ এই  বাঙালিবাইনারিজাতিবৈশিষ্ট্য স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয় বাঙালি সমাজ দেখে চলেছেপ্রথমে কংগ্রেসবাম’, পরে বামকংগ্রেস’, তারপরে বামতৃণমূল’। তারপরেতৃণমূলবাম’। এবার তৃণমূলবিজেপি’। কাজেই, যে কারণগুলোর জন্য এক পার্টি জয়লাভ করে, ঠিক সেই ফ্যাক্টরগুলোই অপর পার্টির পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়

প্রথম, নির্বাচনের লেভেল মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচন কোন জাতীয় নির্বাচন নয়, রাজ্য নির্বাচন এটা এখন সুস্পষ্ট যে, ভারতীয় ভোটাররা জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচনের পার্থক্য খুব ভালোভাবেই বোঝে, আর সেই ভাবেই ভোট দেন আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভোটাররা সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেনতাই ২০১৯ জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট দিয়ে বিজেপিকে ১৮ জন এমপি দিয়েছিল আর এখন বিধান সভায় ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়ে এই পাঁচ বছরে থেকে বিজেপিকে ৭৭ জন এমএলএ সিট দিয়েছে এই নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপি সেই অর্থে ২০১৬ বিধানসভার নিরিখে লাভবান হয়েছে২০১৬ বিধানসভায় ১০ শতাংশ ভোট থেকে বিজেপি এখন পরিপূর্ণ বিরোধী শক্তি হিসেবে ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেআবার, ২০১৬ সালের সাপেক্ষে তৃণমূল তার সিট এবং ভোট শতাংশ বাড়িয়ে নিয়েছেবামকংগ্রেস শক্তি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেআর, রাজ্য ভিত্তিক নেতৃত্বের কোনোবিকল্পনা থাকার জন্যেই বিজেপি বা অন্য তৃতীয় শক্তির উপর বাঙালি সমাজ নির্ভর না করে মমতা ব্যানার্জির ওপরই আস্থা রেখেছে। 

দ্বিতীয়, ‘বহিরাগত ইস্যু ও ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রথম থেকেই মমতা ব্যানার্জি বিজেপির দিল্লির নেতৃত্বের আক্রমনকে বহিরাগত আক্রমণ হিসেবে দেখাতে পেরেছেনএই বহিরাগত আক্রমণতত্ত্বকে প্রতিহত করতে বিজেপি নেতৃত্ব পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে২০১৯ সালের সাফল্যের পর থেকে বিজেপি নেতৃত্ব বাংলাভিত্তিক নেতৃত্বকে গ্রুম করে উঠতে পারেনি মমতা ব্যানার্জি ঠিক এখানেই নিজেকে বাংলার মেয়ে’- ভূমিকন্যা হিসেবে নিজেকে পুরোপুরি বাঙালিমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেনআবার, শুধুমাত্র নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলো দিয়ে কয়লা, গরু, কাটমানি, তোলাবাজীচক্রের বিরুদ্ধেপিসিভাইপোকেব্যক্তিগত আক্রমণতথা মমতাবেগমবলে মহিলাহিসাবে আক্রমণ সাধারণ বাঙালি একেবারেই গ্রহণযোগ্য মনে করেনি, বরং তা বিজেপির পক্ষেকাউন্টারপ্রোডাকটিভহয়ে গেছেবিজেপির কেন্দ্রীয়নেতৃত্বেরবাংলাঅর্জনেরপরিবর্তেবাংলাদখলেরআগ্রাসী মানসিকতাকে আপামর বাঙালি প্রত্যাখ্যান করেছে

তৃতীয়, প্রার্থীনির্বাচনতৃণমূল থেকে আসা প্রায় সমস্ত দলবদলুদের বিজেপি যে প্রার্থী করল, সেখানেই মমতা ব্যানার্জি চরম ফায়দা তুলতে পেরেছেন এই দলবদলুদের বিশ্বাসঘাতক’, ‘গদ্দার’, তথামিরজাফরহিসেবেই বাঙালি সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে; শুধুমাত্র সুবিধা লাভের জন্য, আসন্ন ক্ষমতাপদের জন্য এই সমস্ত প্রার্থীদের বিপরীতে তৃণমূল প্রার্থীদেরকেদূর্নীতিগ্রস্থতা মাপকাঠিতে কোনোইপ্রার্থক্যকরেনিমাটিকামড়ে পড়ে লড়াইকরা দলীয় কর্মীদের বেশি হারে প্রার্থী না করা বিজেপির বিপক্ষে গেছেএমনকি, বর্তমান এমপিদের প্রার্থী করাকে বিজেপিররিজার্ভ বেঞ্চডেফিসিটহিসেবেই এই বাংলা ধরেছে 

চতুর্থ, মহিলাভোটারমহিলা সশক্তিকরণের জন্য বিভিন্ন মহিলাকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা সর্বভারতীয় ইলেকশনে নরেন্দ্র মোদী যেমন পেয়েছেন, ঠিক একইভাবে রাজ্যস্তরে মহিলা প্রকল্পগুলি মমতা ব্যানার্জিকে গত ১০ বছর ধরে সেই একই ডিভিডেন্ট দিয়ে চলেছে এছাড়া মমতা ব্যানার্জির ঘরের মেয়েরএপ্রোচ বাংলার মহিলাদের কাছে ওনাকে আরো বেশি নির্ভরযোগ্য করে তুলেছেতার নরম সুরের আহ্বানকে বাংলার মেয়েরা নিজের করে নিয়েছে

পঞ্চম, কমিউনিকেশনস ফ্যাক্টরবাংলার নির্বাচনে ভাষা একটা বড় ফ্যাক্টর দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের লাগাতার হিন্দিতে গ্র্যান্ড প্রচার বাংলার সাধারণ মানুষ নিতে পারেনি, যা বাংলার সংস্কৃতিকৃষ্টিকে ভাষাগত আক্রমণআক্রমণ হিসেবেই ধরা হয়েছে মমতা ব্যানার্জি এই ভাষাকেন্দ্রিক ক্যাম্পেইনের সুবিধা গ্রহণ করেছেন; বিজেপি নেতৃত্বের হিন্দিভাষাকেন্দ্রিক প্রচারের ব্যর্থতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন মমতা বরাবরের মতো সহজ সরলমেঠো বাংলায় সরাসরি ভাষায় দিল্লিনেতৃত্বকে আক্রমণ করে ফায়দা তুলেছেন

ষষ্ঠ, এককাট্টা মুসলিমভোটএবারের নির্বাচনে বাঙালি মুসলিমদের সাপেক্ষে এক দিকপরিবর্তন– ‘প্যারাডাইম শিফটঘটেছে এই প্রথম মালদা, মুর্শিদাবাদসহ বাংলার সব অঞ্চলেই বামকংগ্রেস জোটকে বাঙালি মুসলিম জাতি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে সমস্ত মুসলিম ভোট মমতা ব্যানার্জির পক্ষে গিয়েছেএকদিকে বিজেপির চরম হিন্দুত্ববাদথেকে বাঁচা, আরেক দিকে মুসলিম জাতির পরিচয়সত্তার অস্থিত্ব রক্ষারজন্য মুসলিমরা মমতা ব্যানার্জিকে রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে; কোন দ্বিতীয় পক্ষের জায়গা রাখেনিতবে মুসলিম ধর্মগুরুর নেতৃত্বে আইএসএফ এখানে লাভ পেয়েছে, একটা সিট পেয়েছে; যা ভবিষ্যতে বাংলার মুসলিম জনবিন্যাসে ধীর অথচ নিশ্চিত পরিবর্তনের সাপেক্ষে মুসলিম জাতিশক্তিকে একটি পরিচালকশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে

সপ্তম, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইস্যুস্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলায় বামপন্থী ধারায় শ্রেণীসংগ্রামের প্রায়োগিক ফলিত চর্চা যা হয়েছে, সেই ধারাকে প্রায় সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার পর সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি এসসি/এসটি/ওবিসিদের নিয়ে যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা করেছে, সে একই পরীক্ষা বাংলার বুকে করেছেন মমতা ব্যানার্জিবিভিন্ন ভাষিকগোষ্ঠী, আদিবাসী, জনজাতি, নিম্নবর্গগোষ্ঠী তথা মুসলিমগোষ্ঠীকে ওবিসিসংরক্ষণপ্রায় সবধরনের জনগোষ্ঠীকে কায়েমী স্বার্থ তথা ক্ষমতার অংশীদারিত্বের ভাগীদারি করেছেনএমনকি হিন্দিভাষিক গোষ্ঠীও এই জনক্ষমতার অঙ্গীভূত হয়েছেবিজেপিও এবার বাংলায় এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে রাজবংশী, মতুয়া, আদিবাসী ডিভিডেন্ড পেয়েছেতবে লাভ বেশি পেয়েছেন মমতাই তার নেতৃত্বের কারণেই

অষ্টম, ‘নরমচরমহিন্দুত্ব ইস্যুহিন্দুত্ব বাহিন্দুনেসবাঙালি হিন্দু সমাজে সবসময়ইনরমপ্রকৃতিরউত্তরভারতেরমর্যাদাপুরুষোত্ত্মশ্রীরামচন্দ্র বাঙালি হিন্দুর কাছেঘরের লোক নন, বাইরের লোকও নন’; তিনি ঘরের সামনেই থাকেনকিন্তু, বাঙালি হিন্দুর ঘরে আছেনমা কালীআর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরলীলাপুরুষোত্ত্মবংশীধারী শ্রীকৃষ্ণসর্বোপরি, ‘মা দুর্গাতো বাঙালি হিন্দুরআইকন’, যেঘরের মেয়ে’! এইনরমহিন্দুত্বের সামনেজয় শ্রীরামহয়ে দাঁড়িয়েছেচরমহিন্দুত্বেরআগ্রাসীএকপলিটিক্যাল শ্লোগান’, যা বাঙালি হিন্দু সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। 

নবম, ‘ভদ্রলোকপ্রান্তিকবাঙালি ন্যারেটিভএই ইস্যু আমার কাছে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছেউনবিংশ শতাব্দী থেকেইনবজাগরণেরধারায় বাঙালি সমাজে এক কলকাতাকেন্দ্রীকশহুরেউদারবর্ণহিন্দু’-ভিত্তিক মানবতাবাদী একডমিন্যান্ট’ ‘ভদ্রলোকবাঙালিন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে; যার বিপরীতে প্রায় লুক্কায়িত ক্ষমতাবৃত্তের বাইরেগ্রামীণ’ ‘প্যাসিভএকপ্রান্তিকবাঙালিন্যারেটিভও অন্তর্লিন হয়ে বয়ে চলেছেআজকের নির্বাচনী ফল দেখিয়ে দিয়েছে সাধারণ বাঙালি সমাজে সেইভদ্রলোকবাঙালিন্যারেটিভের নিঃসন্দেহ ডমিন্যান্সতবে, বিজেপি কিন্তুপ্রান্তিকবাঙালি সমর্থন পেয়েছে

দশম, ‘বাঙালির বঞ্চনা’। এটা তো অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, ভারতের স্বাধীনতালাভের মূল্য সব থেকে বেশি চোকাতে হয়েছে বাঙালি জাতিকেআবার, বাংলাদেশ হওয়ার পর বাঙালি জাতিররাজনৈতিক সত্তাদ্বিধাবিভক্তভারতীয় বাঙালি জাতিসত্তা এখন শুধুমাত্রসামাজিক’। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক স্তরে বাঙালি জাতিসত্তা স্বাধীনতার পর থেকেইউপেক্ষিততথামার্জিনালাইজড’। ‘অস্মিতাশব্দের পরিবর্তেঅহংশব্দটি বেশি খাটে। ‘বাঙালিঅহংএইবঞ্চনায়ক্ষতবিক্ষত হয়েই চলেছেএই ক্ষতকেই ক্রমাগতভাবে বামশাসকরা, পরে মমতা ব্যানার্জিও সুচারুভাবেতুলেধরতে পেরেছেনস্থানীয় নেতৃত্বকে না তুলে ধরে বিজেপিবাইরের নেতৃত্বদিয়ে এইবাঙালিঅহংকে উপেক্ষা করেছেফল যা হওয়ার তাই হয়েছে

এবার সামনের কথা। ‘খেলা শেষ’- খন্ডযুদ্ধ বাব্যাটেলশেষ হয়েছে; কিন্তুবড় যুদ্ধবাওয়ারমনে হয় শুরু হলোবাঙালি সমাজমেরুকৃত থাকল, যেখানেনিরঙ্কুশ বিরোধীপক্ষের ভূমিকায় এক প্যারাডাইস শিফট ঘটলো দক্ষিণপন্থীবিজেপির উত্থানে; যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক জনমোহিনীপপুলিস্টরাজনৈতিক শক্তিতবে বৃহত্তর ইস্যুগুলো রয়েই গেলযেমন, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, স্বচ্ছ সরকারি চাকরিপরীক্ষা, রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের অভাব, কাটমানি, সিন্ডিকেট, পাচারচক্র, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি। ‘উন্নততর বাংলাগড়তে কোন পক্ষ কেমন পথদিশা দেখাতে পারে, কি ধরনের কর্মসূচি নিতে পারে, সে সবের দিকেই তাকিয়ে আছে আপামর সাধারণ বাঙালি সমাজ