‘বাংলা তেরে টুকড়ে হোঙ্গে!’

0
1332

(বাদ মে বাংলাস্তান-কে সাথ জোড় দেঙ্গে)

“জাতিরাষ্ট্রের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিকে অতিক্রম করার” জন লেননোচিত আপাত-মহৎ আকাঙ্ক্ষা যে আজকাল প্রাতিষ্ঠানিক আকাদেমির অলিন্দে ঘুরঘুর-রত প্রতিষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞানীদের আকাদেমিক কার্যক্রমে প্রেরণা ও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে, সম্প্রতি সে সংবাদ শুনে যারপরনাই আমোদ পেলাম। এইজাতীয় সীমানাবিহীন লেননীয় (পাঠক সাবধানে পড়বেন, ‘লেনিনীয়’ বলিনি কিন্তু) ইউটোপিয়ার ধারণা গত শতকের ষাটের দশকের শেষভাগ থেকেই আমাদের গ্রহের বামপন্থী নামক একটি বিশেষ প্রজাতির সদস্যদের মন-মাথা-চোখ স্বপ্নালু ক’রে রেখেছে। এঁরা সীমানা মোটেই পছন্দ করেন না, কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা বিবিধের মাঝে মহান মিলন খুঁজে পেলে তাকে “বহুর মধ্যে এক খোঁজার মেঠো বুলি” ব’লে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে থাকেন। বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আলোচনার ক্ষেত্রে কুখ্যাত পুরনো পাপী আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় পাতায় সেই কাজটিই আবার করে দেখিয়েছেন হিস্ট্রির প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক শ্রীরণবীর চক্রবর্তী।

পাঠক আবার খেয়াল করবেন, শ্রীচক্রবর্তীর পরিচয় দিতে গিয়ে আমি কিন্তু ‘ইতিহাস’ শব্দটি ব্যবহার করিনি, ব্যবহার করেছি ইংরেজি শব্দভাণ্ডারের অন্তর্গত ‘হিস্ট্রি’ শব্দটি। তার কারণ আছে। পাঠক জেনে থাকতে পারেন যে ‘হিস্ট্রি’ শব্দের ব্যুৎপত্তি ঘাঁটতে বসলে একটি গ্রীক শব্দে উপনীত হ’তে হয়, সে শব্দটি হ’ল ‘হিস্টোরিয়া’। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় এই শব্দটি ন্যারেটিভ বা আখ্যান অর্থে ব্যবহৃত হ’ত। সেই অর্থ থেকেই স্প্যানিশ, পর্তুগীজ বা ইটালিয়ানের মতো রোমান্স ভাষাগুলিতে ‘গল্প’ অর্থে যথাক্রমে ইস্তোরিয়া, হিস্তোরিয়া অথবা স্তোরিয়া শব্দগুলি প্রযুক্ত হয়।

লক্ষণীয়, রোমান্স ভাষাগুলির উৎপত্তি এবং ব্যবহার ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাচীন রোমান সভ্যতার পীঠস্থান রোম তথা আধুনিক কালের ইতালি নামক দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের খুব কাছাকাছি এই রোমান্স ভাষাগুলির জন্ম, বেড়ে ওঠা ও বিবর্তন। আর রোমান সভ্যতার বীজ প্রাচীন গ্রীসের শিল্পজ্ঞানচর্চামণ্ডিত সভ্যতারই পরিপক্ক ফল থেকে নির্গত। ফলে দক্ষিণ ইউরোপের এই দেশগুলির মনন ও ভাষায় প্রাচীন রোমের হাত ঘুরে আসা গ্রীক প্রভাব যে থাকবেই, এতে আর আশ্চর্য কি?

তবে গ্রীসের প্রাচীন সভ্যতা ও প্রাচীন গ্রীক ভাষার প্রভাব যে শুধু দক্ষিণ ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল, এমনটা ভাবলে খুব ভুল করা হবে। ইউরোপের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমে, এমনকী মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জেও প্রাচীন গ্রীক এমন সুদূরপ্রসারী ছাপ ফেলে রেখে গেছে যে আজও অ্যাংলো-স্যাক্সনদের ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীসেরই বাচনভঙ্গির অনুরণন শোনা যায়। ইংরেজের মাতৃভাষার প্রায় ষাট শতাংশ শব্দই হয় সরাসরি নতুবা ল্যাটিনের হাত ঘুরে প্রাচীন গ্রীক ভাষা থেকে এসেছে। এমতাবস্থায় ইংরেজ ইতিকথা বলতে যা বোঝায়, তাকে ‘হিস্ট্রি’ শব্দদ্বারা নির্দেশ ক’রে থাকে।

এই আলোচনা থেকে যে নির্যাস পাঠক পেতে পারেন তা হ’ল – পাশ্চাত্যের ‘হিস্ট্রি’ বলতে আসলে একরকম (বা বলা ভালো, কোনো এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত) আখ্যানকে বোঝানো হয়ে থাকে। একে শিলালিপির মতো মোক্ষম এবং অমোঘ ব’লে ধ’রে নেওয়ার কিচ্ছু নেই। বিশেষ ক’রে সেই হিস্ট্রিকে তো নয়ই, যা পাঠ করা এবং লেখা হয়ে থাকে এক্কেবারে বিশুদ্ধ পাশ্চাত্য বোধ থেকে। ঊনবিংশ শতকে লর্ড মেকলে সাহেবের কল্যাণে যখন সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের ধাঁচে ঢালা স্কুল-ইউনিভার্সিটি ধারার শিক্ষা চালু হ’ল, তখন সেই শিক্ষার তথাকথিত ‘নব-আলোকপ্রাপ্ত’ বঙ্গজেরা বাংলা ভাষায় ইংরেজের বিদ্যার বুলি ধাড়াদ্ধার আমদানি করতে লেগে গেলেন। এই পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার আলোকে আলোকিত যে বিদ্যা, তার (এবং শুধুমাত্র তারই) লব্জের বাংলা পরিভাষা রচিত/নির্দেশিত হবার সেই শুরু। সেই চোখধাঁধানো পশ্চিমা আলোর আলোকিত ক্ষণে ‘হিস্ট্রি’-র পরিভাষা হিসেবে আমাদের পূর্বপুরুষগণের পবিত্র আর্যভাষা থেকে ‘ইতিহাস’ শব্দটি ধার করবার মহান কীর্তিটি সব অর্থেই আমাদের ঔপনিবেশিক নিয়তির একখানি নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

পাঠক একথা মনে রাখলে ভালো করবেন যে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘ইতিহাস’ শব্দের প্রয়োগ যে জায়গায় সবচাইতে বেশি ক’রে চোখে পড়ে তা হ’ল মহাভারত। মহাভারত নিজেই নিজেকে ‘ইতিহাস’ ব’লে ঘোষণা করেছেন। ভারতের নিজস্ব সাহিত্যে ও চিন্তার জগতে ‘ইতিহাস’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি এবং তার বিশেষ তাৎপর্য বলতে যা কিছু বুঝিয়ে থাকে, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারতই তার উৎস, এই মহাভারত গ্রন্থই তার আদর্শ বা মডেল।

‘বঙ্গদেশ’ পত্রিকা যখন আমায় শ্রীচক্রবর্তীর এই আনন্দবাজারি রবিবাসরীয় লেখাটির একখানি জবাব লিখতে অনুরোধ করলেন, তখন প্রথমে একটু দ্বিধা হয়েছিল। দ্বিধার কারণ – একটা লেখা, যার পুরো যুক্তিটিই (যদি আদৌ একে যুক্তি বলা যায়) শুধুমাত্র নামের হেরফেরের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার কি জবাব লিখব? নামের রকমফেরের পিছনে ভাষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সংবলিত একটা আস্ত স্বতন্ত্র জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা – এ তো আপাদমস্তক রেটরিকাল তক্কো – দূর-দূরান্ত অব্দি যে তক্কের কোনো শেষ কোনোকালে নেই। “অমুক সময়ের আগে বাংলা বলে কোনও এলাকা নেই” – এই কথাটা ভদ্রলোক নিজের গোটা লেখা জুড়ে তোতাপাখির মতো বারবার পুনরাবৃত্তি করে গেছেন। মনে পড়ে, “বিলিতি ঔপনিবেশিক সময় অথবা নিদেনপক্ষে মোগল আমলের আগে ইন্ডিয়া/ভারত ব’লে কোনো দেশ/রাষ্ট্র নেই” গোছের হিস্টরিকাল ‘যুক্তি’? ব্র্যান্ডটা খুব চেনা চেনা ঠেকে, তাই নয় কি? এ হচ্ছে আমাদের অতিপরিচিত এক্কেবারে মার্কামারা উত্তরাধুনিকতাবাদী “সবই আসলে সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বজনিত নির্মিতি”-জাতীয় যুক্তি। আসল উদ্দেশ্য অন্যখানে। নব্য-মার্ক্সবাদীরা যেভাবে সমাজবিজ্ঞান চর্চা করেন, তাতে কোনো ধারণা, বস্তু, জাতি অথবা রাষ্ট্রকে একবার কন্সট্রাকশন বা নির্মিতি ব’লে চালিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে! তারপর তার “টুকড়ে টুকড়ে” করতে আর কতক্ষণ।

বাংলা শব্দটি হিস্ট্রিতে নেই বলছেন? বেশ, মেনে নিলাম, নেই। নেই তো নেই। তা বাংলা নেই তো কি হয়েছে? বঙ্গ তো রয়েছে। গৌড় রয়েছে। ‘গৌড়জন’ বা গৌড়িয়া বলতে সেই ষষ্ঠ শতক (খ্রিষ্টীয়) থেকে কাদের বোঝায়? ঐসময় গৌড়ের শাসক শশাঙ্ক পূর্বে কামরূপ থেকে পশ্চিমে ভুবনেশ্বর আর উত্তরে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণের সমতট অব্দি রাজত্ব করে গেছেন – একথা কি আপনারই (হিস্ট্রি নামক) ডিসিপ্লিনের টেক্সট্‌বইতে লক্ষবার ক’রে ছাপা হয়নি? তাহলে বঙ্গের জাতিসত্তা ও স্বাধীন রাজার রাজ্য হিসেবে তার গৌরবময় অস্তিত্বের ‘হিস্ট্রি’ পড়বার জন্য ‘বঙ্গ’ শব্দে আপত্তি থাকলে গৌড় শব্দটিই ধ’রে এগোন না। এসব ছেড়ে লেখক স্রেফ ‘বাংলা’ শব্দটির পিছনেই পড়লেন কেন বোঝা গেল না। পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঐ শব্দটিকেই এই দাঙ্গাজাত, দেশভাগলাঞ্ছিত হতভাগা রাজ্যের নাম ক’রে ছাড়বেন ব’লে আদাজল খেয়ে লেগেছেন – সেইজন্যে নয়তো?

এদিকে লেখক ‘হিস্টরিকাল’ যুক্তি হিসেবে কি খাড়া করেছেন? না, হিউয়েন সাং আর রাজেন্দ্র চোল বাংলা ঘুরে/জয় ক’রে গেলেও ‘বাংলা’ নামটির উল্লেখ করেননি, বরঞ্চ বঙ্গদেশের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত দিয়েছেন। বাহ্‌। এই যদি ওঁর যুক্তির নমুনা হয়, তবে বঙ্গভাষার অভিধানে ‘অজুহাত’ শব্দটির সমার্থক হিসেবে এখন থেকে ‘যুক্তি’ শব্দ ব্যবহার করাই সঙ্গত হবে। উনি কি জানেন  না, “Absence of evidence is not evidence of absence.”? সরকারি পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সংস্কার আনবার নামে বঙ্গভাষার চৌদ্দটা বাজিয়ে ছেড়েছিলেন যাঁরা, কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা-সংলগ্ন অঞ্চলস্থিত সেই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন এমনটা আশা করাই যায়।

শ্রীচক্রবর্তীর লেখার সারকথা এই – ‘বাংলা’ আসলে একটি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও চালিত ইতিহাসবিদদের তৈরি মনগড়া স্বপ্নরাজ্য, যা মোগল/আফগান/তুর্কি/ইংরেজ শাসকেরা নিজে হাতে সযত্নে গড়ে বাঙালিদের খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতকে অথবা মেরেকেটে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে উপহার দিয়ে পগার পার হয়েচেন। তার আগে বাংলার নিজস্বতা, বাঙালির অনন্য জাতিসত্তা, রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক কি সাংস্কৃতিক পৃথক কোনো পরিচয় – এসব কিচ্ছুটি ছিল নাকো। এখন যদি সেই ‘বাংলা’র হিস্ট্রি লিখতে বসতে হয়, তাহলে অতি অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সাথে সাথে বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম আর উড়িষ্যার রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক পরিচয় সুবিধেমত ঘেঁটে দিয়ে যেটুকু আজকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য (পড়ুন রোহিঙ্গা পুনর্বাসন এবং অবাধে অবৈধ বাংলাদেশিদের ভারতের সীমানায় ঢুকে পড়বার অভিসন্ধি) সিদ্ধ করবার জন্য যথেষ্ট ঠিক ততটুকু বেছে নিলেই চলবে। সেইজন্যেই শ্রীচক্রবর্তীর লেখায় শুরু থেকে শেষ অব্দি ‘জাতীয়তাবাদ’-কে একখানি দৈত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করবার এমন মরিয়া চেষ্টা। জাতীয়তাবাদ বিভেদমূলক, জাতীয়তাবাদ সঙ্কীর্ণ, জাতীয়তাবাদ কেবলই দুরভিসন্ধিমুলক জিগির তুলে সমকালীন সময়কে চিৎকৃত ক’রে তোলে – এইসব ক্লিশে-তে ভর্তি, যা রোমিলা থাপারের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমরা অব্যর্থভাবেই প্রত্যাশা করে থাকি। এই পোড়া দেশে হিস্ট্রিবিদ্যার গুরুঠাকুরানী থাপার-দিদিমণি এই ‘বাংলা’-র হিস্ট্রির মুখবন্ধটিও লিখেছেন অতিপ্রত্যাশিত ভাবেই।

মাঝখান থেকে বেচারা রবি ঠাকুর কেবলই ইচ্ছাকৃতভাবে মিসকোট হ’তে থাকেন। আহারে, শ্রীচক্রবর্তীকে একটা ব্যাপারে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যাচ্ছে না। তিনি অমন সুন্দর উদাহরণ তৈরি ক’রে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে কে জানত যে অর্ধসত্যের মতোই অর্ধ-কোটেশনও আসলে মিথ্যারই নামান্তর? শ্রীচক্রবর্তী (আবারও প্রত্যাশিতভাবেই) বেশ বুদ্ধি ক’রে গুরুদেবের আনন্দবাজার পত্রিকাকে (সে আনন্দবাজার এ আনন্দবাজার নয় রে পাগলা, অন্ততঃ অভীক সরকারের তো নয়ই) লেখা শুভেচ্ছাবার্তাটি ছেঁটে যেটুকু তাঁর এজেন্ডার সঙ্গে বেশ সুবিধেমত খাপ খেয়ে যেতে পারে ঠিক সেটুকুই টুকে দিয়েছেন। “স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্ধ্বে ওঠো,/কোরো না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।” – এটুকুই শ্রীচক্রবর্তী কোট করেছেন। আমরা নীচে রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বার্তাটি হুবহু তুলে দিলাম –

তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে
শত্রু মিত্র নির্বিভেদে সকলের ‘পরে।
স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো,
সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরো বড়ো।
স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্ধ্বে ওঠো,
কোরো না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।

সত্য যে সবার উপরে, সেই অমোঘ সত্যটি মনে করিয়ে দেবার আগে কবিগুরু লেখনীজীবীদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন – “স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো।” গুরুদেবের এই আদেশ যে আধুনিক ভারতে হিস্ট্রির পণ্ডিত-অধ্যাপকগোছের সমাজবিজ্ঞানীদের তথা সাংবাদিকতার ধ্বজাধারীদের কানের ঠিক পাশ দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, তার প্রমাণ আজকাল আমরা নিত্য পেয়ে থাকি।

ইংল্যান্ড তো চিরকাল ইংল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল না। ‘পাকিস্তান’ নামটি তো এই সেদিনকার সদ্যোজাত শিশু। তাই ব’লে কি তাদের জাতিসত্তার খুব কিছু এসে যায়? এসে গেছে কোনোদিন? ইন্ডিয়াও তো চিরকাল ইন্ডিয়া নামে পরিচিত ছিল না। জম্বুদ্বীপ, ভারতবর্ষ, হিন্দুস্তান, ভারতীয় উপমহাদেশ, ভারত প্রজাতন্ত্র – বাহারি তার নামের বিবর্তন। রাজনৈতিক ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভৌগোলিক সীমানার পরিবর্তন ঘটে আকারেও ঘটেছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন পাশ্চাত্য চিন্তাধারার ক্রীতদাসদের বাদ দিলে ক’জন বিশ্বাস করবেন যে ‘ভারত’ ও ‘ভারতীয়’ নামাঙ্কিত জাতিটির পত্তন হয়েছে এই সেদিন, গোরারা ভারতের পশ্চিম উপকূলে সুরাতে নোঙর করবার অব্যবহিত কাল পরে কিংবা বাবর পানিপথ আর খানোয়ার যুদ্ধ করার পর থেকেই? রবীন্দ্রনাথ ‘জাতি’ বলতে কি বুঝিয়েছেন, জাতি বা রাষ্ট্র জাতীয় শব্দগুলি যে এই সেদিনকার খ্রিষ্টীয় উনবিংশ শতকের আধহজম হওয়া পশ্চিমা অনুকরণবাদী দাসবৃত্তিসুলভ মনোভাবের অধিকারীদের দ্বারা ইংরেজের তুষার-ধোঁয়াচ্ছন্ন মনোভূমিকে বাংলার উর্বরা জমিতে টেনে নামাবার নিষ্ফল চেষ্টা-মাত্র নয়; সেই ঋগ্বেদ থেকে আর্ষ-উচ্চারিত হয়ে এই শব্দগুলির নিজস্ব অর্থানুগতিক ইতিহাস রয়েছে, ভারতের আপন ধর্মসঞ্জাত ব্যঞ্জনা রয়েছে, সেকথা শ্রীচক্রবর্তী বা প্রোঃ থাপারের মতো হিস্ট্রিবিদদের কে বোঝাবে? ‘জাতীয়তা’ শব্দের ‘জ’-অক্ষর উচ্চারণ হতে না হতেই তো এঁদের নয়া-মার্ক্সবাদী উত্তরাধুনিক সংবেদনশীলতায় হিস্টিরিয়া ধ’রে যায়!

পরিবর্তন তো শুনেছি জগতের একমাত্র চিরন্তন সত্য। স্বয়ং উপনিষদ বলছেন “জগত্যাং জগত” – যা পরিবর্তনশীল, জঙ্গম, তাই এর নাম জগত – তা জগতের উপরিতলের সেই পরিবর্তনশীলতার আপাত-সত্যটির তলায় লুকিয়ে থাকা ধ্রুবসত্য ভাবটি উপলব্ধি করবার চেষ্টা করে দেখুন একবার। বলি বিদেশের কুকুর নিয়ে আদিখ্যেতা ক’রে তো বহুকাল কাটল, একবার দেশের ঠাকুরটি পরখ করেই দেখুন না (কবি ঈশ্বর গুপ্তের কাছে মার্জনা চেয়ে রাখছি!)।