বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে চীন-ভারত ব্যবসায়িক সম্পর্ক: একবিংশ শতাব্দীর ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’?

– সোমদীপ ভট্টাচার্য্য

১৯৬২-এর যুদ্ধের আগে এবং পরেও বহুবার ভারত-চীন সীমান্ত অঞ্চল কিংবা Line of Actual Control এ Escalation হয়েছে, সরাসরি যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সেই যুদ্ধ কিন্তু শুধুই সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকে নি, ছড়িয়েছে অন্যক্ষেত্রেও। লাইন অফ কন্ট্রোলের সীমানা ছাড়িয়ে ঢুকে এসেছে ড্রয়িংরুমে!
দিনের আলোয় চৈনিক অনুপ্রবেশ বারবার কিভাবে আমাদের ক্ষতি করেছে ও করছে এবং বুঝে বা না বুঝে আমরা এর শিকার হচ্ছি তার একাধিক প্রমাণ নিয়ে, বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা এই ফিচার।
বাঙালি পাঠকের অন্যতম রুচি গল্প, তাই আপাতত এটিকে গল্প হিসেবে পড়লেও মন্দ হবে না। ‘গল্পের’ শেষবেলায় রইলো লেখার সূত্র, চরিত্রের নামসহ সম্পূর্ণ তথ্যপরিচয়। তবে বলা প্রয়োজনীয়-এ গল্পের কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়। উপস্থাপনা করলাম কথকের জবানীতেই।

 

চীনের লবিয়িংঃ ঘটনা_১

চীন ভারতকে বরাবর শত্রুদেশ হিসেবেই মনে করে, আমরা যতই হিন্দি-চীনী ভাই-ভাই ন্যারেটিভ বানানোর চেষ্টা করি ওদের সেই দায় নেই। মিলিটারিতে থাকা ব্যক্তিরা তাদের লড়াই করুক, আমি ব্যবসায়ী হিসেবে আমার কথা বলব।

সাল ২০০৮ – ’০৯। একটা হোটেলের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি তখন, ‘ফ্লোরিং’ ঠিকঠাক রাখার উপায় খুঁজছি। ভারতীয় ম্যানুফ্যাকচারারের কাছে রেঞ্জ সীমিত। আর ইউরোপের অপশান থাকলেও তা বহু দূরে। সুতরাং ঘরের পাশে থাকা চীনের কথাই মনে এল; দূরত্ব কম, দাম কম, অনেক ভ্যারাইটিও পাব। আকর্ষণীয় দাম ছাড়াও ওদের জিনিসের বিভিন্নতা বা ভ্যারাইটি আমার খুব ভাল লাগল কিন্তু কেনার সময় চক্ষু চড়ক গাছ!

ভারত, চীনে উৎপাদিত এসব জিনিষের উপরে লাগিয়ে রেখেছে Anti Dumping Policy -এর আওতায় উচ্চ তারিফ বা ট্যাক্স (এখানে যারা জানেন না তাদের জন্যে বলে রাখি, বাইরের কোনো দেশ তাদের দেশে উৎপন্ন জিনিস যাতে স্বল্পমূল্যে আমাদের দেশে বিশাল পরিমাণে বেচতে না পারে, তারজন্যে এই ব্যবস্থা। এতে বিদেশী শক্তির দেশের বাজারে অনুপ্রবেশ আটকানোও হয়, আবার দেশীয় উৎপাদকদের একটা Safety Net ও প্রদান করা যায়), এর ফলে পছন্দসই দ্রব্যাদির দাম বেশি পড়ে যাচ্ছে। তখন সিরামিক ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমাদের কাছে।

আমার আবার এই দ্বিতীয় অপশনটি পছন্দ ছিল না এবং আমি চাইছিলাম চীন থেকেই ইম্পোর্ট করতে, অর্ডারের পরিমাণও ছিল যথেষ্ট। ফলে ডিল চূড়ান্ত না হলেও চৈনিক সংস্থার সেলস হেড আমায় সেই রাতে তার আতিথ্যে ডিনারে ডাকেন, এদিক সেদিক আলোচনার পরে খুব মিষ্টি করে ব্যবসায়িক বিষয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।

“আপনি ফ্লোরিং এর জন্যে ভিট্রিফায়েড টাইলসই নিন না, ওতেই যখন আপনার কাজ হয়ে যাচ্ছে?”

আমি বলি, “কিছু করার নেই। আপনাদের দাম সস্তা হলেও অতিরিক্ত ট্যাক্সের ফলে দাম অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। এতটা বেশি দামে কেনা সম্ভব না।”

সেলস হেড বলেন যে, “কোনো অসুবিধে নেই। আপনি শুধু দামটাই দেবেন। অতিরিক্ত ট্যাক্স আমরা বহন করব। কিন্তু…”

আমি জানতে চাই, “সেই কিন্তুটা কি?”

উনি বলেন, “দেশে ফিরে আপনাকে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে যাতে এই ‘এণ্টি ডাম্পিং ট্যাক্স’ তুলে নেওয়া হয়। আর এর জন্যে আপনি যতো টাকা দরকার সেই টাকা খরচ করুন, সবচেয়ে ভাল আইন বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিন। সব খরচা আমাদের কোম্পানি দেবে আপনাকে!”

এই শুনে আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওখানে থেকে বেরিয়ে আসি শুধু এই বলে যে, ভেবে দেখব।

এই ঘটনা আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। পরে দেশে ফিরে ভেবেচিন্তে এবং নিজের হৃদয়ের তাড়নায় এই চীনা কোম্পানির সঠিক মালিকানা জানতে, আমি আরও রিসার্চ শুরু করি। শেষ অবধি দেখতে পাই এটি রেজিস্টার করা রয়েছে অনেক পেপার ওয়ার্ক, শেল কোম্পানির পিছনে, অফসোরে, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যাণ্ডে। সম্ভবত, এত আড়াল সড়ালে দেখা যাবে কোনো CCP বা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যের মালিকানা রয়েছে এর পিছনে।

 

চীনের লবিয়িংঃ ঘটনা ২

তখন ২০০৬ – ‘০৭ সাল।

একটা খুব বড় Opthelmic লেন্স কোম্পানি আমার সাহায্য চায় চীন থেকে খুব বেশি সংখ্যায় কিছু লেন্স আমদানি করতে। আমরা মোটামুটিভাবে চীনের বাজার ঘেঁটে শাংহাইয়ের থেকে একটু ভিতরে একটা লেন্স ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির খোঁজ পাই, যারা মোটামুটিভাবে ভারতের ডিমাণ্ডের প্রায় ৬০% নিজেরাই তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। এই কোম্পানির মালিকের মেয়ে পড়াশোনা করেছেন আন্তর্জাতিক ব্যবসাবিদ্যা নিয়ে এবং তিনি যেহেতু ইংরাজি জানতেন, তাই তিনিই এই ব্যাবসায়িক আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা নেন।

আমি ডিলটি করছিলাম একজন ভারতীয় সিন্ধি ব্যবসায়ীর হয়ে এবং তাঁর ছেলে আমাদের সঙ্গে গেছিলেন। একে সিন্ধি তায় ব্যবসায়ী, ভয়ানকভাবে দরদাম নেগোশিয়েট করতে থাকেন। তার সোজা কথা ছিল, “যদি সস্তায় কিনতেই না পারি তবে চীনে এলাম কেন?”

শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে মালিক তনয়া মিটিংরুমেই নিজেদের ইন্টারনাল লেজার চেয়ে পাঠান। তিনি নিজে আমাদের সাথে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে নেগোশিয়েট করেন এবং তারপরে সিদ্ধান্ত হয় যে, ওভারহেড কস্টের মাত্র ১% উপরে সব মাল বিক্রি হবে (ওভারহেড কস্ট – অর্থাৎ উৎপাদনে সবকিছু মিলিয়ে যা খরচা হচ্ছে তার থেকে মাত্র ১% বেশী)।

এটাও যথেষ্ট বড় ডিল ছিল এবং ভারতীয় বিক্রেতার সুরক্ষা রক্ষার্থেই তার নাম প্রকাশ করছি না। এরপরে ডিলটির সফল হওয়ার বিষয়টি উদযাপন করতে আমরা ডিনারে যাই। সেখানে গিয়ে আমি মালিক কন্যার সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করি কিভাবে এত স্বল্পমূল্যে তারা অপথালমিক লেন্স বিক্রি করছেন?

ইনিয়ে বিনিয়ে এদিক সেদিকের কথা বলে তিনি এড়িয়ে যেতে চান। যাই বলুন না কেন, আসল সত্যিটা কিছুতেই জানান না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি আমার বুদ্ধিমত্তা এবং ‘চার্ম’ দিয়ে তার শেষ ডিফেন্সটিও ভেঙে দিতে পারি। তিনি জানান যে প্রাথমিকভাবে তাঁর ১% লাভ থাকলেও প্রোডাকশন চালু থাকছে, পয়সা রোল করছে, সবাই কাজও পাচ্ছে। আর এত বড় অর্ডারে এক শতাংশ লাভও খারাপ না।

তাছাড়া, কিন্তু কিন্তু করেই তিনি জানান, আমরা ১০% এক্সপোর্ট সাবসিডি পাব। হয়তো এক বছর পরে পাব, কিন্তু এর ফলে আমাদের লাভের পরিমাণ বেশ ভালোই থাকবে। (এক্সপোর্ট সাবসিডি — নিজের দেশে উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে বিক্রি এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলে নিজের দেশের সরকার যে উৎসাহভাতা দেয়।) সব শুনে আমি চুপ করে গেলাম। ভাবতে পারিনি আমরা বাণিজ্যে চীনাদের থেকে কতটা পিছিয়ে আছি।

এইভাবে চীন তাদের ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিচ্ছে ভারতের বাজার ধরার, বৈদেশিক ট্রেডারদের সাথে প্রতিযোগিতায় এমন মূল্য দেবার যাতে তাদের কাছে চীন ছাড়া আর কোনো বিকল্পই না থাকে। একবার বাজার পেয়ে গেলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করার আর কোনো অসুবিধাই নেই। অনেকটা ড্রাগসের মত, প্রথমে অল্প দামে বা বিনামূল্যেই দাও, অভ্যেস করাও, তারপরে তাকে শুষে নাও।

তাই আমি আপনি যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখি, বয়কট চীন বা চীনা জিনিষ কেনা বন্ধ করি, ওদের আঘাতটা লাগে সঠিক জায়গায়। আমি বলছি না আপনাদের চীনের জিনিস বয়কট করতে, তবে চীনা জিনিস ত্যাগ করবেন না কিনবেন তা আপনাদের উপরে, আপনাদের হত্যার বা আত্মসমর্পণের ফাণ্ডিং আপনি করবেন কি না, অবশ্যই সেটা আপনাকে ভেবে দেখতে হবে।

কার অভিজ্ঞতা?

শ্রী নিশীথ শরণের। ইনি একজন ব্যবসায়ী, কনসালটেন্ট, EAPC পুরস্কারের জুরি মেম্বার, ইলেকশন স্ট্রাটেজিস্ট, আর ইউটোপিয়ান স্ট্রাটেজিক কনসাল্টিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ জীবন ইনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়ে সহায়তা দিয়েছেন এবং এই তথ্যটি ওনারই অভিজ্ঞতালব্ধ ফসল। তাঁর সম্পূর্ণ বক্তব্যটি নীচেই দিলাম।

 

এ বিষয় নিয়ে ব্যবসা থেকে আলোচনা সবই চলতে পারে, বয়কট চীনের মজাও ওড়ানো যায়, তবে দীপাবলীর প্রদীপের মাটিটা নিজের দেশের হলেই বেশি উপভোগ্য হয়।