পূর্ণ হিন্দুত্ব ৩: হিন্দু সমাজতত্ত্ব

0
1973

ইতিপূর্বে লেখক বঙ্গদেশে বাঙ্গালীর জাতিসত্তা নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করেছেন। এবার হিন্দুত্বের পালা। জাতিসত্তার পাঠ ছাড়া রাষ্ট্রসত্তার পাঠ অসম্পূর্ণ। তাই পাঠককে অনুরোধ করবো এই প্রবন্ধটিও পড়তে।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পূর্ণ হিন্দুত্ব ৩: হিন্দু সমাজতত্ত্ব

 

বিষয়সূচী
গুণত্রয় এবং মানুষের ব্যক্তিত্ব
পুরুষার্থ
চতুরাশ্রম
হিন্দু সমাজে নারীর অধিকার
পারিবারিক সুখ, সমাজ এবং রাজনীতি
চতুর্বর্ণ সমাজ
পঞ্চযজ্ঞ: সমাজ ও জাতির প্রতি হিন্দুর সার্বজনীন কর্তব্য

পরিভাষাকোষ
জাত – Caste
জাতি – Ethnic group
জাতিসত্তা, জাতীয়তা – Ethnicity
জাতীয় – Ethnic
দেশ, বর্ষ – Country
প্রশাসন – Administration, Management
রণ-রাজনীতি – Geopolitics
রাষ্ট্র – Nation (Country অর্থে)
রাষ্ট্র-জাতি – Nation (People অর্থে)
রাষ্ট্রবাদ – Nationalism
রাষ্ট্রবাদী – Nationalist
রাষ্ট্রসত্তা, রাষ্ট্রীয়ত্ব – Nationality
রাষ্ট্রীয় – National
স্বরাজ্য – Nation-State
শাসনশক্তি – State
শাসনযন্ত্র – State machinery

গুণত্রয় এবং মানুষের ব্যক্তিত্ব

হিন্দুধর্মের সাথে আব্রাহামীয় ধর্মগুলির প্রভেদের কারণ বুঝতে হিন্দু দর্শনের গুণত্রয় সম্পর্কে আমাদের অবহিত থাকা দরকার। ‘একঃ অহং বহু স্যাম প্রজায়েয়’ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/৩)—‘আমি এক থেকে বহু হবো’, পরমাত্মার এই ইচ্ছা থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। চেতন রূপে তাঁর আবির্ভাব জীবাত্মা বেশে, আবার জড় রূপে প্ৰকৃতিতে তাঁর প্রকাশ, সবকিছুই তিনি—‘বাসুদেব সর্বং ইতি’ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৭/১৯)। প্রকৃতি ত্রিগুণাত্মক—সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ—এই তিন গুণের দ্বারাই আমাদের দেহ-মন সহ সমস্ত জড় ও সূক্ষ্ম বস্তুর সৃষ্টি।

প্রকৃতির এই তিন গুণের বিবর্তনের মাধ্যমে ঘটে আমাদের দেহ-মনের বিকাশ। আমাদের চরিত্রে এই তিন গুণের উপস্থিতির তারতম্যে দু’টি গুণকে ছাপিয়ে একটি গুণ প্রধান হয়ে আমাদের চরিত্রকে সাত্ত্বিক, রাজসিক অথবা তামসিক করে গড়ে তোলে। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের কর্ম, ভাবনা, ঝোঁক, ভালো লাগার বিষয়কে প্রভাবিত করে। তাই দু’জন ব্যক্তির পূজা-প্রার্থনা বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও চারিত্রিক ভাবে তা হতে পারে সাত্ত্বিক, রাজসিক অথবা তামসিক।

তামসিক ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে আলস্য, দীর্ঘসূত্রতা, সঙ্কীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা এবং বুদ্ধির জড়ত্ব। তমো প্রধান মানুষের জন্য চাই রজোগুণ বিকাশের শিক্ষা ও ব্যবস্থা, যেমন কায়িক পরিশ্রম, মাছ-মাংসের আহার, কৃচ্ছতার সাধন ইত্যাদি। পরিবর্তে তাকে সাত্ত্বিক হতে বলার উপদেশ, যেমন নিরামিষ আহার করা বা ধ্যান-জপের অনুশীলন প্রভৃতি, অপধর্ম মাত্র কারণ এ সকল নিয়ম তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির  পরিপন্থী। একক অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তার জন্য সমবেত অনুষ্ঠানের বেশি প্রয়োজন, যেখানে থাকবে নিয়মানুবর্তিতা এবং সংঘবদ্ধতা, থাকবে সমষ্টি চেতনার বিকাশের সুযোগ।

রাজসিক ব্যক্তি হয় কর্মঠ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং কিছুটা ঈর্ষাপরায়ণ। পরশ্রীকাতরতা আর ঈর্ষার পার্থক্য—প্রথম ক্ষেত্রে অন্যের উন্নতিতে ঈর্ষাপরায়ণ হলেও নিজে পরিশ্রম করে সেই উচ্চতায় ওঠার আকাঙ্ক্ষা অনুপস্থিত, রাজসিক ব্যক্তির ঈর্ষার চরিত্র ভিন্ন, সে চায় অন্যকেও ছাপিয়ে যেতে। আবার রাজসিক ব্যক্তি স্বার্থপর হলেও তামসিক ব্যক্তির মতো সঙ্কীর্ণ মানসিকতার নয়; আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে সামাজিক খ্যাতি বা প্রশংসা লাভের জন্য দাতব্য কাজে সে এগিয়ে আসে।

রাজসিক ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের সত্ত্বগুণ প্রায় অনুপস্থিত তারা হয় আসুরিক সম্পন্ন—তাদের মধ্যে ক্রোধ, লোভ, অহঙ্কার অত্যাধিক পরিমানে থাকে, তাদের ব্যবহার হয় কর্কশ, অপরের প্রতি থাকে তাচ্ছিল্য। এহেন ব্যক্তিদের একমাত্র দণ্ড, অর্থাৎ সহিংস পদ্ধতি প্রয়োগ করে বশ মানানো যায়।

রাজসিক ব্যক্তিদের মধ্যে সত্ত্বের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকলে, তারা হয় দৈবিক গুণসম্পন্ন। তারা বৃহৎ আদর্শের জন্য, বিশেষ করে দেশ ও ধর্মের জন্য বৃহত্তর স্বার্থে আত্মত্যাগ করতে পিছপা হয় না। বর্তমান হিন্দু সমাজে এমন মানুষেরই সর্বাধিক প্রয়োজন।

সাত্ত্বিক ব্যক্তি হয় কর্মঠ কিন্তু ধীর, নির্ভীক এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ত্যাগ-সংযম পালনে, ধর্মীয় কর্ম সম্পাদনে, সাধন-ভজনে তাদের থাকে প্রবল অনুরাগ। আব্রাহামীয় ধর্মের সাথে হিন্দুধর্মের পার্থক্যের যে আলোচনা আমরা করেছি, তাতে বলা বাহুল্য, একমাত্র হিন্দুধর্মেই সত্ত্বগুণের চর্চাকে প্রোৎসাহিত করা হয়েছে, মূলধারার আব্রাহামীয় ধর্মে এর বিশেষ চর্চা নেই। তাদের নিয়মের কঠোরতা চিত্তশুদ্ধির জন্য নয়, তা সম্প্রদায়ের মধ্যে রেজিমেন্টেশন অথবা কিছু ব্যক্তিগত সিদ্ধি-বিভূতি লাভের উদ্দেশ্যে। শ্রীশ্রীগীতার চতুর্দশ (গুণত্রয়বিভাগযোগ) এবং শেষ তিনটি অধ্যায়ে (দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ, শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ এবং মোক্ষযোগ) এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।

মানব সমাজে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে রজঃ ও তমঃ গুণের আধিক্য। হিন্দুধর্মের জীবনচর্যার মূল নীতি মানুষকে ক্রমশ তামসিক থেকে রাজসিক হয়ে সাত্ত্বিক রূপে গড়ে তোলা। কিন্তু ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য এটাই যথেষ্ট নয়, তাই হিন্দু অধ্যাত্ম সাধনার লক্ষ্য এই তিন গুণকে ছাপিয়ে ত্রিগুণাতীত হওয়া। ত্রিগুণাতীত অবস্থায় না উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত সাধনার উপলব্ধির মধ্যেও আছে এই বিভাগ। আব্রাহামীয় সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান, মানব জগৎকে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী গোত্রে ভাগ করা, জন্মান্তরকে অস্বীকার করা অথবা জগৎ থেকে সৃষ্টিকর্তাকে আলাদা করে রাখার কারণ এই সকল ধর্মের সিদ্ধান্ত ত্রিগুণাতীত চৈতন্য হতে উদ্ভুত নয়। যৌগিক দৃষ্টিতে তা রজোস্তমো স্তরের উপলব্ধি যা ষড়রিপুর প্রভাবযুক্ত। পূজ্য সাধক শ্রী অনির্বাণ তাঁর অন্তর্যোগ পুস্তিকায় এ বিষয়ে বিশদে আলোকপাত করেছেন।

পুরুষার্থ

কিন্তু আমরা যদি ভাবি হিন্দুধর্মের লক্ষ্য শুধুমাত্র মোক্ষলাভ তাহলে ভুল করব। মানব সমাজে অধিকাংশের সত্ত্ব গুণের তুলনায় রজোস্তমোর আধিক্য থাকায় তাদের মোক্ষলাভের সাধনায় নিযুক্ত করা অযৌক্তিক, নিষ্ফল এবং ক্ষতিকর। আমাদের ঋষিকুল সেই বাস্তবকে উপলব্ধি করে, ‘যার পেটে যা সয়’ বিবেচনা করে সমাজের সকল মানুষের জন্য চার পুরুষার্থকে (চতুর্বর্গ নামেও পরিচিত) জীবনের লক্ষ্য বলে চিহ্নিত করেছেন—ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। এই চতুর্বর্গের সাধনাই হচ্ছে সম্পূর্ণ ধর্ম-সাধনা, কারণ এর মাধ্যমেই মানুষ প্রাপ্ত হয় ‘অভ্যুদয়’ (দৈহিক, মানসিক ও জাগতিক উন্নতি) এবং ‘নিঃশ্রেয়স’ (মোক্ষ) যা ইতিপূর্বে ধর্মের তিন নম্বর ব্যাখ্যায় আলোচনা করেছি।

ধর্ম: এখানে ধর্মের অর্থ নৈতিক ও কর্তব্য কর্ম করা, যা ইতিপূর্বে ‘ধর্ম জিজ্ঞাসা’ বিভাগে ধর্মের দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় আমরা আলোচনা করেছি।

অর্থ: জীবনধারণ করতে গেলে বিত্তের প্রয়োজন। নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ধন, সম্পদ আহরণ এই পুরুষার্থের উদ্দেশ্য। গার্হস্থ্য আশ্রম প্রসঙ্গে আমরা অর্থ নিয়ে আরও বিশদে আলোচনা করব।

কাম: কাম অর্থে সাধারণতঃ আমরা যৌনতা বুঝি। পুরুষার্থ হিসেবে কামের ধারণা কিন্তু অনেক ব্যাপক। আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের (চক্ষু, জিহ্বা, নাসিকা, কর্ণ এবং ত্বক ) মাধ্যমে পঞ্চতন্মাত্র, অর্থাৎ রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ এবং স্পর্শ আস্বাদন করাই কাম চরিতার্থ করা। এই সকল পঞ্চতন্মাত্রের অনুভূতির সূক্ষ্ম রূপ আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মনের মাধ্যমে, অর্থাৎ কল্পনার মাধ্যমে উপভোগ করাও কামের অন্তর্গত। সংক্ষেপে, ইন্দ্রিয় সম্ভোগের ইচ্ছাকে বলে কাম। শাস্ত্রে এই সকল ইচ্ছাকে সাধারণতঃ তিন ভাবে বিভক্ত করা হয়েছে— পুত্রৈষণা (যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে সন্তান লাভের আকাঙ্খা), বিত্তৈষণা (প্রাচুর্য এবং বিলাসিতার বাসনা) এবং লোকৈষণা (ক্ষমতা ও খ্যাতির অভিলাষ)।

মোক্ষ: জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে নিবৃত্তিই মোক্ষ যার উল্লেখ আমরা করেছি। কিন্তু এটা অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যা বৌদ্ধ পরবর্তী যুগে হিন্দু মানসে প্রবেশ করেছে। সাধনার লক্ষ্য সত্যকে জানা, ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা; জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে মুক্তি এর ফলস্বরূপ মাত্র। বৈদিক যুগে আমরা সাধনাকে ইতিবাচক রূপে দেখতাম—ঈশোপনিষদে যেমন ঋষি বলছেন,

হিরণ্ময়েন পাত্রেন সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নাপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।। (ঈশ উপনিষদ, ১৫)

(বঙ্গানুবাদ: তোমার জ্যোতির্ময় স্বর্ণময় পাত্র সত্যকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে,
হে পূষন, তাকে অপসারিত করে সেই সত্যধর্মকে আমায় দেখতে দাও।)

এতো প্রার্থনা নয়, যেন দাবি; ঋষির প্রার্থনার এই ভঙ্গিমা ও সুরের মধ্যে পাই লোকমান্য তিলকের কথার প্রতিধ্বনি—

“সত্যকে উপলব্ধি করা আমার জন্মগত অধিকার, হে দেব, সেই সত্যকে আমি উপলব্ধি করবই!” 

বেদ-মহাভারতের যুগে আমরা জীবনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখিনি। বেদে ধনসম্পদ, সন্তান ও শতায়ু লাভের প্রার্থনা আছে। মহাভারতের সারানুবাদের ভূমিকায় রাজশেখর বসু লিখেছেন,

তাঁরা শ্মশানবৈরাগ্য প্রচার করেন নি, বিষয়ভোগও ছাড়তে বলেন নি, শুধু, এই অলঙ্ঘনীয় জাগতিক নিয়ম শান্তচিত্তে মেনে নিতে বলেছেন—

সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনান্তাঃ সমুচ্ছ্রয়াঃ।
সংযোগা বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং চ জীবিতম্।।

—সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়, উন্নতির অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়।[1]

জীবনকে এইভাবে আলিঙ্গনের ফলে তাঁদের অনুসন্ধিৎসা শুধু অধ্যাত্ম জগতে সীমিত থাকেনি, জাগতিক বিষয়ের চর্চা তাঁরা করেছেন, সৃষ্টি হয়েছে বেদাঙ্গের ব্যাকরণ, শব্দকোষ (নিরুক্ত), জ্যোতিষ (জ্যোতির্বিজ্ঞান) এবং শূল্বসূত্র (পরিমিতি ও জ্যামিতি), উপবেদের আয়ুর্বেদ (স্বাস্থ্য বিষয়ক), ধনুর্বেদ (যুদ্ধ বিষয়ক), স্থাপত্যবেদ এবং গন্ধর্ববেদ (সঙ্গীত বিষয়ক)। এছাড়াও ছিল অর্থশাস্ত্র (রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক), কামশাস্ত্র (দাম্পত্য বিষয়ক), ধর্মশাস্ত্র (পরিবার ও বৃত্তি বিষয়ক), এবং নাট্যশাস্ত্র। এই সকল বিষয়ের চর্চা একদিন হিন্দু জাতিকে মানব সভ্যতার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক শক্তিতে হিন্দু হয়ে উঠেছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে হিন্দু বিজয়রথ পাড়ি দিয়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়, হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল সুদূর ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), মালয় (মালেশিয়া), যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও বলিদ্বীপ (ইন্দোনেশিয়া), সিংহপুর (সিঙ্গাপুর), কম্বোজ (কম্বোডিয়া), শ্যামদেশ (থাইল্যাণ্ড) ও চম্পায় (ভিয়েতনাম)। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মন্দির ভারতে নয়, আছে কম্বোজের আঙ্কোরওয়াতে। চম্পার মন্দির স্থাপত্যে পাওয়া যায় বঙ্গের, বিশেষ করে পাল যুগের প্রভাব। এছাড়া চীন প্রভাবিত হয়েছিল বৌদ্ধমতের দ্বারা, জাপানে জনপ্রিয় হয়েছিল হিন্দু দেব-দেবীদের পূজা, যার প্রচলন আজও আছে। জাপানে সর্বাধিক পূজিতা হলেন দেবী সরস্বতী (বেনজাই-তেন)। শিব (দাইকোকু-তেন), গণেশ (শো-তেন), বিষ্ণু (নারায়ান-তেন), লক্ষ্মীদেবীও (কিচিজো-তেন) জাপানিদের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছেন।

সামরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। ভারতের রাজেন্দ্র চোলা যবদ্বীপে সাফল্যের সাথে সমর অভিযান চালিয়েছিলেন, তারও পূর্বে শ্রীলঙ্কার রাজ সিংহাসন অধিকার করেছিলেন বাঙ্গলার বিজয় সিংহ। পশ্চিম এশিয়াও ছিল হিন্দু প্রভাবিত। অতি প্রাচীনকালে, সেই ঋগ্বেদের যুগে ঘটেছিল ‘দশরাজ্ঞ’ বা দশ রাজার যুদ্ধ, যার একদিকে ছিলেন পুরু গোত্রীয় ভরত বংশের রাজা সুদাস এবং অপরদিকে অনু বা আণব গোষ্ঠীর নয়টি উপজাতি ও দ্রুহ্যূ গোষ্ঠীর একটি উপজাতি। এই যুদ্ধে সুদাস জয়ী হন এবং অনু গোষ্ঠীর উপজাতিরা সরে আসে আরও পশ্চিমে—পশতু (পাখতুন), ভালানা (বালুচ) গোষ্ঠী আশ্রয় নেয় বর্তমান পাকিস্তান অঞ্চলে, শিম্যু (সইরিমা), দাস (দহি) এবং বিষাণিন (পিশাচিন বা নুরিস্তানি) উপজাতিরা চলে আসে বর্তমান আফগানিস্তানে, পর্শু (পার্সি) এবং পৃথু (পার্থিয়ান) গোষ্ঠী ইরান বা পারস্যে এসে স্থিত হয়, শিব (খিব) এবং দাসদের এক অংশ (দাহি), অলিন  (অলন) এবং শিম্যুর এক অংশ (সারমাতিয়ান) ছড়িয়ে পড়ে যথাক্রমে বর্তমান উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উক্রাইন এবং রুশ দেশে। এইসকল উপজাতিকে বৃহত্তর ইরানি গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করা হয়। তুরস্ক, রোমানিয়া ও বুগেরিয়ায় চলে যায় ভৃগু (ফ্রিগে) এবং দাস উপজাতির একাংশ (দাসিয়ান)। অলিন উপজাতির একাংশ (হেলেন বা হেলেনিক) বসতি স্থাপন করে গ্রীসে, এবং শিম্যুর আর এক অংশ (সিরমিও) যায় আলবেনিয়ায়। এইভাবে প্রথমে বালুচিস্তান, হিন্দুকুশ অঞ্চল ও ইরান বা পারস্য হয়ে বিভিন্ন সময়ে ভাগ হয়ে আর্যভাষী গোষ্ঠী ছড়িয়ে পরে আনাতোলিয়া (তুরস্ক), গ্রীস, ইতালি, আলবেনিয়া, রুশ, স্লাভ অঞ্চল সহ সমগ্র ইউরোপে, জন্ম নেয় বৃহত্তর ভারত-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী।

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, হিন্দুধর্ম আজ পর্যবসিত হয়েছে শুধুমাত্র মোক্ষধর্মে, যা আমাদের ধর্মের চতুষ্পাদের একটি পাদ মাত্র। চতুষ্পদ টেবিলের তিনটি পায়া ভেঙে দিলে যেমন টেবিলটি ভূপতিত হয়, ধর্ম-অর্থ-কাম, এই তিন পুরুষার্থকে উপেক্ষা করে হিন্দুধর্মও হয়েছে অধঃপতিত, হিন্দু জাতি হয়েছে দুর্বল, মোহাচ্ছন্ন। সময় হয়েছে ধর্মের এই ত্রুটি সংশোধন করে, ধর্মের এই অবক্ষয় রোধ করে, হিন্দুধর্ম ও জাতিকে পুনরায় মহিমান্বিত করে গড়ে তোলার।

চতুরাশ্রম

পূর্বের জীবনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য হিন্দু শাস্ত্র জীবনকে চার পর্যায়ে ভাগ করে সন্ন্যাস আশ্রমকে রেখেছিলেন একদম অন্তিমে; তার আগে ছিল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, এবং সন্তানদের নিজস্ব সংসার হলে পর সংসার থেকে অবসর নিয়ে বানপ্রস্থ, যা ছিল সন্ন্যাসের প্রস্তুতি পর্ব। চতুর্বর্গের সাথে সমন্বয় করে তৈরী হয়েছিল এই চতুরাশ্রম ব্যবস্থা।

ব্রহ্মচর্য আশ্রম: প্রথম পর্যায়, অর্থাৎ বিদ্যার্থী জীবন ছিল ব্রহ্মচর্য আশ্রম। লক্ষ্য ছিল গুরুর আশ্রমে নৈতিকতার শিক্ষা, সংযত জীবনচর্যা ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে প্রথম পুরুষার্থ, অর্থাৎ ধর্মের সাধনা। ব্রহ্মচর্য আশ্রম বা শিক্ষার্থী জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য অন্তরে শ্রদ্ধার বিকাশ, কারণ—

শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানম্ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪/৩৯)

শ্রদ্ধা বলতে আমরা বুঝি গুরুজন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মান দেখানো, কিন্তু এই ধারণা আংশিক মাত্র। আমাদের আলোচ্য ‘শ্রদ্ধা’ শব্দের অর্থ, ব্যঞ্জনা অনেক ব্যাপক। এই শ্রদ্ধার অর্থ আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা বোধ, যার সাথে আসে সংকল্পে দৃঢ়তা, প্রতিজ্ঞায় অবিচলতা। এই শ্রদ্ধার অভাব হলে মানুষের অন্তর হাল্কা হয়ে ওঠে, বাজে আড্ডা, গুলতানিতে সে সময়ের অপব্যয় করে, গুরুদায়িত্ব বহন করার শক্তি তার থাকে না। এই শ্রদ্ধার অভাব যখন আমাদের মধ্যে জাতিগত ভাবে দেখা যায়, তখন—

আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স্, এবং নিজের বাক্‌চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।[2]

স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু জাতির, বিশেষ করে বাঙ্গালীর মধ্যে এই শ্রদ্ধার অভাব দেখে পুনরায় আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগানোর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

ভেবো না তোমরা দরিদ্র, ভেবো না তোমরা বন্ধুহীন; কে কোথায় দেখেছ—টাকায় মানুষ করে? মানুষই চিরকাল টাকা করে থাকে। জগতের যা কিছু উন্নতি, সব মানুষের শক্তিতে হয়েছে, উৎসাহের শক্তিতে হয়েছে, বিশ্বাসের শক্তিতে হয়েছে। তোমাদের মধ্যে যারা […] কঠোপনিষৎ পাঠ করেছ, তাদের অবশ্যই স্মরণ আছেঃ […] নচিকেতার হৃদয়ে শ্রদ্ধা প্রবেশ করল। এই ‘শ্রদ্ধা’ শব্দটি আমি তোমাদের নিকট ইংরেজীতে অনুবাদ করে বলব না; অনুবাদ করলে ভুল হবে। এই অপূর্ব শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা কঠিন; এই শব্দের প্রভাব ও কার্যকারিতা অতি বিস্ময়কর। নচিকেতার হৃদয়ে শ্রদ্ধা জেগে ওঠা মাত্র কি ফল হল, দেখ। শ্রদ্ধা জেগে ওঠা মাত্রই নচিকেতার মনে হল—আমি অনেকের মধ্যে প্রথম, অনেকের মধ্যে মধ্যম, অধম আমি কখনই নই; আমিও কিছু করতে পারি। তাঁর এইরূপ আত্মবিশ্বাস ও সাহস বাড়তে লাগল, তখন যে-সমস্যার চিন্তায় তাঁর মন আলোড়িত হচ্ছিল, তিনি সেই মৃত্যুতত্ত্বের মীমাংসা করিতে উদ্যত হলেন; যমগৃহে গমন ব্যতীত এই সমস্যার মীমাংসা হবার অন্য উপায় ছিল না, সুতরাং তিনি যম-সদনে গেলেন। সেই নির্ভীক বালক নচিকেতা যমগৃহে তিন দিন অপেক্ষা করলেন। তোমরা জান, কিরূপে তিনি যমের নিকট হতে সমুদয় তত্ত্ব অবগত হলেন। আমাদের চাই এই শ্রদ্ধা। দুর্ভাগ্যক্রমে ভারত হতে এই শ্রদ্ধা প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে। সেজন্যই আমাদের এই বর্তমান দুর্দশা। মানুষে মানুষে প্রভেদ এই শ্রদ্ধার তারতম্য নিয়ে, আর কিছুই নয়। এই শ্রদ্ধার তারতম্যেই কেউ বড় হয়, কেউ ছোট হয়। আমার গুরুদেব বলতেন, যে আপনাকে দুর্বল ভাবে, সে দুর্বলই হবে—এ অতি সত্য কথা। এই শ্রদ্ধা তোমাদের ভিতর প্রবেশ করুক। পাশ্চাত্যজাতি জড়জগতে যে আধিপত্য লাভ করেছে, তা এই শ্রদ্ধারই ফলে; তারা শারীরিক বলে বিশ্বাসী। তোমরা যদি আত্মাতে বিশ্বাসী হও, তাহলে ফল আরও অদ্ভুত হবে। তোমাদের শাস্ত্র, তোমাদের ঋষিগণ একবাক্যে যা প্রচার করেছেন, সেই অনন্ত শক্তির আধার আত্মায় বিশ্বাসী হও—যে আত্মাকে কেউ নাশ করতে পারে না, যাঁর মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে। কেবল আত্মাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। [3]

এখন আর সেই গুরুকূল নেই, নেই ব্রহ্মচর্য আশ্রম। কিন্তু আমাদের প্রকৃত ইতিহাসকে মানুষের কাছে তুলে ধরে, ধর্মচর্যাকে জীবনচর্যার বিশিষ্ট এবং অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে, সমাজজীবনের সাথে নিজেদের জীবনকে আরও নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত করে হিন্দু জাতির মধ্যে পুনরায় শ্রদ্ধা জাগানো সম্ভব।

গার্হস্থ্য আশ্রম: শিক্ষার্থী জীবনের সমাপ্তির পর বিবাহের দ্বারা প্রবেশ হতো গার্হস্থ্য আশ্রমে। এই আশ্রমের লক্ষ্য অর্থ ও কামের সাধনা, অবশ্যই ধর্ম বা নৈতিকতার পথ ধরে। সন্তানের জন্মদান ও ষোড়শ সংস্কারের পালন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন, সমাজের হিতে কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ এই আশ্রমের সাধনা।

গার্হস্থ্য জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য সন্তান লাভের মধ্যে দিয়ে বংশ পরম্পরা এবং জাতিকে শক্তিশালী করা। সন্তানের জীবনে বিবিধ সংস্কার পালন করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে যার মধ্যে ষোলোটি সাধারণ মান্যতা লাভ করেছে। সন্তানকে গর্ভধারণের পূর্ব থেকে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া পর্যন্ত এই ষোড়শ সংস্কারকে জীবনের পাঁচ পর্বে ভাগ করা যায়—জন্মানোর পূর্বে, শৈশবে, শিক্ষার্থী জীবনে এবং বিবাহিত জীবনে এবং মৃত্যুর পরে। এর মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকটি হলো গর্ভাধান (প্রথম সংস্কার, গর্ভধারণের পূর্বে), পুংসবন (অন্তঃসত্ত্বা হবার লক্ষণ দেখা দিলে), জাতকর্ম (জন্মানোর পর), নামকরণ, অন্নপ্রাশন, বিদ্যারম্ভ, উপনয়ন, কেশান্ত (ছেলেদের) অথবা ঋতুশুদ্ধি (মেয়েদের), সমাবর্তন, বিবাহ এবং অন্ত্যেষ্টি।

শুধু বংশবিস্তার নয়, হিন্দু সমাজের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেককে সুসন্তান রূপে, সমাজের উপযুক্ত অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলার। তাই দেখি ষোলোটি সংস্কারের মধ্যে গর্ভাধান সমেত ১১ টি সংস্কার শৈশবকালের। এর মধ্যে গর্ভাধান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বিধি অনুসারে মূল পুজোর প্রারম্ভে থাকে সঙ্কল্প গ্রহণ। সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে গর্ভাধান এমনই এক সঙ্কল্প বিশেষ। ঋগ্বেদ (১০/১৮৪/১-৩, ১০/৮৫/৩৭), অথর্ববেদের (১৪/২/২) একাধিক স্থানে লিঙ্গ নির্বিশেষে সন্তান লাভের প্রার্থনা আছে। শুধু প্রার্থনা যথেষ্ট নয়, সন্তান যাতে উত্তম শরীর ও মনের অধিকারী হয় তার জন্য সুশ্রুত তাঁর গ্রন্থে দম্পতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, গর্ভাধানের সময় স্বামী-স্ত্রীর আহার, আচরণ ও মানসিকতার দ্বারা সন্তানের স্বভাব-চরিত্র এবং খাদ্যরুচি নির্ধারিত হয়।

আহারাচারচেষ্টাভির্যাদৃশীভিঃ সমন্বিতৌ।
স্ত্রীপুংসৌ সমুপেয়াতাং তয়োঃ পুত্রোঽপি তাদৃশঃ।। (সুশ্রুত সংহিতা, শরীরস্থানম্, ২/৪৬)

কিন্তু সুসন্তান গড়ে তোলা মানে পরিবারকে একটি সন্তানে সীমিত রাখা নয়, বিশেষ করে এই গণতান্ত্রিক রাজনীতির যুগে যেখানে সংখ্যাই দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। জনচরিত্রই দেশের নিয়ন্তা—‘Demography is Destiny’। অন্যান্যদের তুলনায় কোন জাতির জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কম হলে তা জাতিগত আত্মহত্যার সমান। দেশভাগের পর মাত্র সাত দশকের মধ্যে অবিভক্ত বঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ৪৫% থেকে ৩০% নেমে এসেছে। মাঝে ১৯৭১-এর জেনোসাইডে প্রায় পঁচিশ লক্ষ্য হিন্দুর গণহত্যা, বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন হিন্দু নারী অপহরণ এবং দাঙ্গায় মৃত্যু এই নিম্নমুখী হারকে প্রভাবিত করলেও, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার পরিকল্পনাই এই ক্রমবর্ধমান আনুপাতিক হ্রাসের জন্য মুখ্যত দায়ী। ইদানিং পল্লীসমাজেও এই প্রবণতা যাচ্ছে। বাংলাদেশ হতে অনুপ্রবেশ সহ স্থানীয় বাঙ্গলাভাষী মুসলিম জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান ষ্ফীতির বিপ্রতীপে নিজেদের সন্তানদের দুধেভাতে রাখতে গিয়ে ‘হাম দো হামারে এক’ নীতিতে চলা পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী যে নিজের উত্তরপ্রজন্মকে আর একবার উদ্বাস্তু শিবিরে ঠাঁই করানোর ব্যবস্থা পাকা করছে সেই বোধোদয় এখনো তার হয়নি।

বানপ্রস্থ আশ্রম: এরপর সময় আসে সন্তানের বিবাহের, হয় পরবর্তী প্রজন্মের দাম্পত্য জীবনের সূচনা। দৌহিত্র-দৌহিত্রী কিছুটা বড় হলে আসে বানপ্রস্থ গ্রহণের সময়। কারণ নিজের যৌবন, কর্মক্ষমতা ক্ষয় হলে পৃথিবীও হয় ‘গতযৌবনা’ (মহাভারত, আদিপর্ব), সমস্যা দেখা দেয় ‘জেনারেশন গ্যাপ’-এর। বানপ্রস্থ আশ্রমের উদ্দেশ্য অবসর জীবনে এতদিনের অভ্যাস ও জীবন চর্যায় পরিবর্তন সাধন, ভাগবৎ সেবা ও সন্ন্যাসের প্রস্তুতি; প্রবৃত্তি মার্গের অবসান হয়ে এবার নিবৃত্তি মার্গের প্রারম্ভ।

সন্ন্যাস আশ্রম: জীবনের সকল কর্তব্যের অবসানের পর, বানপ্রস্থে প্রস্তুতিপর্ব শেষ হলে, অবশেষে আসে সন্ন্যাস—‘সম্যক রূপেণ ন্যাস’—সম্পূর্ণ রূপে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ। ঈশ্বর দর্শন বা আত্মোপলব্ধির জন্য শুরু হয় কঠোর তপস্যা। অবশ্য এক জন্মের সাধনায় মোক্ষলাভ হয় না, কিন্তু জীবনের এই পর্বের তপস্যা যে সংস্কার গড়ে তোলে তা মানুষকে পরবর্তী জন্মে আরও উন্নত জীবনযাপনে সহায়তা করে।

হিন্দু সমাজে নারীর অধিকার

‘সস্ত্রীকো ধর্মমাচরেৎ’—হিন্দু গৃহস্থের ধর্ম সাধনে নারী-পুরুষ সমান অংশীদার। কিন্তু দুজনের যথার্থ ধর্মসাধনে চাই সুখী দাম্পত্য জীবন যা সুনিশ্চিত করতে হলে পতি-পত্নী নির্বাচনে স্ত্রী-পুরুষের স্বাধীনতার প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। পূর্বে সামাজিক জীবনে নারীদের ছিল প্রভূত সম্মান; বিদ্যালাভ থেকে পতি নির্বাচন, বিংশ শতকে প্রাপ্ত ‘নারী স্বাধীনতা’ ইসলাম আক্রমণের পূর্বে ছিল সহজলভ্য। ঋগ্বেদে এমন অনেক স্তোত্র রয়েছে যা বৈদিক সমাজে মহিলাদের দেওয়া উচ্চমর্যাদার ইঙ্গিত দেয়। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে, মহিলা তার নিজের স্বামীকে বেছে নেবেন (১০/২৭/১২) এবং ঋষিকা সূর্যা সাবিত্রী বিবাহ সূক্তে (১০/৮৫) পুত্রবধূকে শ্বশুর-শাশুড়ি সহ পরিবারের সমস্ত সদস্য দ্বারা সম্রাজ্ঞী হিসাবে দেখা উচিত বলে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। রামায়ণ-মহাভারতের যুগ থেকে দ্বাদশ শতকে পৃথ্বিরাজের রাজত্ব পর্যন্ত স্বয়ম্বর প্রথা নিরবচ্ছিন্ন ধারায় চলেছিল। বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও জাত-বর্ণ সাপেক্ষে মহিলারা পিছিয়ে ছিলেন না। ইতিপূর্বে ঋগ্বেদের যুগের ঋষিকা থেকে অষ্টম শতকের প্রখ্যাত মীমাংসক মণ্ডন মিশ্রের স্ত্রী উভয়া ভারতীর কথা আমরা উল্লেখ করেছি।

প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য ও নাটকে, যেমন শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক অথবা বীনা-বাসবদত্তা, বাণভট্টের কাদম্বরী এবং ভবভূতির মালতীমাধব-এ সাধারণ হিন্দু মহিলাদের মধ্যে সামাজিক স্বাধীনতার আভাস পাওয়া যায়। এছাড়া মৌর্য যুগ থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত প্রাপ্ত টেরাকোটা চিত্রে সাধারণ মানুষের জীবনের যে প্রতিচ্ছবি আমরা পাই তাতে সামাজিক উদারতা এবং স্ত্রীর মর্যাদা যথেষ্ট প্রতিফলিত।

কিন্তু ইসলামী আক্রমণ ও অনাচারের ফলে হিন্দু রমণীদের সামাজিক পদমর্যাদা বিশেষ ভাবে ক্ষুন্ন হয়। হিন্দু মহিলাদের বলপূর্বক অপহরণের কারণে বাল্যবিবাহ, এবং সহমরণ দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়। মুসলিম শাসক শ্রেণীর দ্বারা নগরের হিন্দু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধ্বংস হওয়ায় সামগ্রিক ভাবে শিক্ষার মানের অবনমন ঘটে। এর শিকার হয় মহিলারাও। হিন্দু মহিলাদের নিরাপত্তা এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পরে যে সারা উত্তর ভারতে দিনের বেলায় বিবাহের প্রাচীন বৈদিক পরম্পরার বিরুদ্ধে গিয়ে তা সূর্যাস্তের পরে করার রীতির প্রবর্তন করতে হয়। রামায়ণ-মহাভারত বা প্রাচীন কোন গ্রন্থে সান্ধ্য বা নৈশ বিবাহের উল্লেখ নেই। রামায়ণের বর্ণনা থেকে জানা যায় শ্রীরামচন্দ্র ও তিন ভাইয়ের বিবাহ দিনের বেলাতেই সম্পন্ন হয়েছিল। বস্তুতঃ গর্ভাধান (পরে আমরা আলোচনা করবো) ছাড়া অন্যান্য সকল বৈদিক সংস্কার দিবাভাগেই করা প্রযোজ্য। দাক্ষিণাত্যে মুসলিম শাসন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল বলে সেখানে আজও দিবসেই বিবাহ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এদিকে উত্তর ভারতে বিপদকালেও এতকালের সংস্কার ভাঙা কঠিন বলে শাস্ত্রে শ্লোক প্রক্ষিপ্ত করে, নব নব জ্যোতিষবচনের সৃষ্টি করে মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছিল রাত্রে বিবাহ অনুষ্ঠিত করার। এমনই একটি শ্লোক—

“বিবাহে তু দিবাভাগে কন্যা স্যাৎ পুত্র বর্জিতা।
বিবাহানল [বিরহানল] দগ্ধা সা নিয়তং স্বামীঘাতিনী।।”

(বঙ্গানুবাদ: দিবাভাগে বিবাহ হলে কন্যা-পুত্র বর্জিতা, বিবাহের আগুনে দগ্ধা ও স্বামীঘাতিনী হয়।) [4]

এই শ্লোকের তাৎপর্য বিচার করতে গিয়ে বিজয়ভূষণ ঘোষ চৌধুরীর মন্তব্য—

“দিনের বেলা বিবাহ হয়”—এরূপ কথাও যদি সেকালে একান্ত অশ্রুত এবং অপরিচিত ছিল, তবে এই বাগ্বজ্রের সৃষ্টির তো কোনই প্রয়োজন উপলব্ধি হয় না। […] আমাদের তো সুস্পষ্ট মনে হয় যে, শ্রৌত-স্মার্ত শাস্ত্র শাসিত ভারতীয় হিন্দুসমাজে দিবা বিবাহই সনাতন প্রথা ছিল, এবং কোনও কারণে সেই প্রথা রহিত করার কোনও বিশেষ আবশ্যকতা উপস্থিত হওয়ায় সাধারণকে পূর্ব্ব প্রচলিত প্রথানুসরণ হইতে নিবৃত্ত করণের উদ্দেশ্যেই ঐ বিষম বিভীষিকাময় শ্লোকটির সৃষ্টি হইয়াছিল। [5]

কোন ‘বিশেষ আবশ্যকতা’ উপস্থিত হয়েছিল, ভারতীয় ইতিহাসের সাথে সুপরিচিত কোন হিন্দুর অনুমান করা কঠিন  নয়—

গৌড়মণ্ডলে পাঠান রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হইবার [… পরে] নবদ্বীপের ব্রাহ্মণসমাজ কিরূপ বিপন্ন হইয়াছিল, অবিবাহিতা অনূঢ়া কন্যা গৃহে রাখা কিরূপ সর্ব্বনাশের কারণ হইয়াছিল, দিনের বেলা প্রকাশ্য সভা করিয়া এবং বাদ্যভাণ্ডাদির উৎসব সহকারে মেয়ের বিবাহ দেওয়া যে কিরূপ অতি সাহসের কাজ বলিয়া বিবেচিত হইত, তাহা সমসাময়িক বৈষ্ণবসাহিত্য, কুলগ্রন্থের মেল-বিবরণ এবং নূতন নূতন সঙ্কীর্ণ আচারের প্রাচীর নির্ম্মাণাদি হইতে বিলক্ষণ উপলব্ধি করা যায়। […] প্রবলের অত্যাচার হইতে দুর্ব্বলের আত্মরক্ষা করিবার উদ্দেশ্যেই ঐ সকল সঙ্কীর্ণ “কূর্ম্মনীতি”র উদ্ভব হইয়াছিল। [6]

বিজয়ভূষণ এরপর ওড়িশার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলেছেন সেখানে মুসলিম শাসন স্বল্পস্থায়ী হবার কারণে স্থানীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে দিবা বিবাহের প্রথা লুপ্ত হয়নি। একই কারণে দাক্ষিণাত্যে যে দিবা বিবাহ প্রচলিত তার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। বিবাহের পর নব দম্পতির স্বামীর গৃহে ফিরে যাবার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গলাকীর্ণ বঙ্গে বিবাহের পরের দিন নিরাপদ সময় ও পথ ধরে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ ছিল। ভারতে ইসলামী শক্তির প্রাণকেন্দ্র দিল্লীর অনতিদূরে পাঞ্জাবে সেই ঘন অরণ্যের নিরাপত্তা ছিল না। সুতরাং ওখানে সান্ধ্য বিবাহের পর পরদিন প্রত্যুষের পূর্বেই নবদম্পতির পতিগৃহে ফিরে যাবার রীতির প্রচলন হলো। বাঙ্গলার তুলনায় পাঞ্জাবে ঘোড়া সুলভ হওয়ায় এই কর্ম সমাধা করা সহজ হয়।

শুধু বিবাহ ও শিক্ষা নয়, ইসলামী আক্রমণের পর হিন্দু রমণীর বেশভূষাতেও আসে পরিবর্তন। ইসলামী আক্রমণের পূর্বে ভারতে নারী এবং পুরুষদের পরিধান বলতে ছিল নিম্নাঙ্গের জন্য অন্তরীয়, উর্দ্ধাঙ্গের উত্তরীয় এবং কোমরে বাঁধার জন্য কায়াবন্ধ। এ সকল বস্ত্র ছিল সেলাইবিহীন। মহিলারা কোন কোন ক্ষেত্রে উত্তরীয় দ্বারা বুকের অংশ আবৃত রাখতেন। মুসলিম আক্রমণের পূর্ববর্তী মন্দির ভাস্কর্য এবং টেরাকোটা চিত্রে মহিলারা এভাবেই চিত্রিত হয়েছেন। মহিলাদের দাবিয়ে রাখতে বোরখা বা হিজাব জাতীয় কোন পোশাকের চল হিন্দু সমাজে ছিল না। কিন্তু পরে বিধর্মীদের লালসা থেকে হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করতে প্রবর্তন হয় অবগুন্ঠনের। অবগুন্ঠনে মাত্রাও নির্ভর করেছে ইসলামী কেন্দ্র থেকে অঞ্চলের দূরত্বের উপর—বাঙ্গলার ঘোমটার তুলনায় রাজস্থানের ঘুঙ্ঘট অতি দীর্ঘ, যাতে অপরিচিতের দ্বারা মুখদর্শন না হয়। হয়ত রানী পদ্মিনীর অভিজ্ঞতা রাজস্থানের হিন্দু মানসে গভীর রেখাপাত করেছিল। এছাড়া সর্বত্র শুরু হয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর পরিবারের মহিলাদের অন্তঃপুরবাসিনী করে রাখার প্রথা।

মুসলিমদের তিন তালাক, পুরুষের বহুগামিতা, বোরখা সহ আব্রাহামীয় সংস্কৃতিতে নারীদের হীন অবস্থান নিয়ে নীরব থাকা মার্ক্সবাদী এবং নব্য বামপন্থীরা অবশ্য তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে আড়ালে রেখে হিন্দু নারীকে ‘পিতৃতান্ত্রিক’ হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে কখনো কার্পণ্য করে না। মনুস্মৃতিতে মহিলাদের উচ্চমর্যাদাসূচক বহু শ্লোক থাকলেও তাদের আক্রমণের বস্তু সাধারণতঃ একটি শ্লোক—

পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রাঃ ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমৰ্হতি।। (মনু স্মৃতি ৯/৩)

বামপন্থীরা এর অনুবাদ করে থাকেন, ‘বিবাহের আগে কন্যাকে পিতার রক্ষা করা উচিত, যৌবনে রক্ষা করা কর্তব্য স্বামীর, এবং বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানদের দ্বারা; মহিলাদের স্বাধীনতা প্রাপ্য নয়।’ এর ভিত্তিতে বাম-লিবারেলদের আক্রমণ হয় দু’ভাবে—

প্রথমতঃ, ‘মহিলাদের স্বাধীনতা প্রাপ্য নয়’ এমন দাবি হিন্দুধর্মের ‘পিতৃতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী’ চরিত্রের পরিচয়। উত্তরে প্রথমেই বলতে হয়, তাদের এই অনুবাদটি বিকৃত। রক্ষার কথা যেখানে হচ্ছে, সেখানে তার বিপ্রতীপে স্বাধীনতা হরণের প্রশ্ন ওঠে না। স্বাভাবিকভাবে মনুস্মৃতির ভাষ্যকাররা এই অংশের অর্থ ধরেছেন ‘অরক্ষিত না রাখা’। যেমন, রাঘবানন্দ এর ব্যাখ্যা করেছেন—‘স্বাতন্ত্র্যং রক্ষিতৃরহিতত্বম্’, অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্যের অর্থ সুরক্ষা রহিত। মনুস্মৃতির সর্বাধিক পরিচিত ভাষ্যকার মেধাতিথি তাঁর মনুভাষ্যে এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ন অনেন সর্বক্রিয়াবিষয়ম্ অস্বাতন্ত্র্যম্ বিধীয়তে’—সর্বক্ষেত্রে মহিলারা অস্বতন্ত্র এমন নয়, আসলে ‘স্বাত্মসংরক্ষণায় প্রভবতি শক্তিবিকলত্বাত্ স্বতঃ’—[পুরুষদের তুলনায়] শারীরিক ভাবে দুর্বল হওয়ায় মহিলারা আত্মরক্ষায় সক্ষম নন, সুতরাং তাদের সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন। [7]

কিন্তু মহিলাদের শারীরিক গঠন পূর্বের ন্যায় হওয়া সত্ত্বেও তো মহিলারা আজ স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করছেন। এই প্রসঙ্গ ধরে উঠে আসে পিতৃতন্ত্রের দ্বিতীয় অভিযোগ—হিন্দু সমাজ চেয়েছিল মহিলাদের সর্বদা পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে। এক্ষেত্রে একটা বড় ভ্রান্তি, বিবিধ পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে অতীতকে বর্তমান দিয়ে বিচার করা। আজকের মতো সেযুগে বিদ্যুৎ ছিল না, মোবাইল বা ফোন ছিল না, ছিল না বাথরুম সংলগ্ন বাড়ি বা ফ্ল্যাট, অথবা হাউজিং সোসাইটির সিসিটিভি ক্যামেরা, দ্রুতগামী যানবাহনও ছিল অনুপস্থিত। আজকের তুলনায় নগরায়ণ তখন সামান্যই ঘটেছে। বিদ্যুৎ বিহীন, ফোন বিহীন গ্রাম্য জীবনে সূর্যাস্তের পর একাকী মহিলার জীবন কতটা নিরাপদ হতে পারত? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতে হতো বাইরে, একা থাকা মহিলার পক্ষে সেটা কতটা বিপজ্জনক তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া সেকালে যখন ভারতে বা অন্যত্র পরিষেবা ক্ষেত্র বিশেষ ছিল না, আজকে মতো মহিলাদের চাকরির সংস্থান কিভাবে হওয়া সম্ভব ছিল? আর এযুগের মতো তখন নগদ টাকার প্রচলন ছিল না, পিএফ, গ্র্যাচুইটি ও পেনশনের প্রশ্নই নেই, তাহলে বার্ধক্যে একাকী মহিলার আর্থসামাজিক সুরক্ষা কিভাবে সুনিশ্চিত করা যেত? এই সকল কারণে মহিলার একাকী জীবনধারণ তো দূরস্থান, বরং একান্নবর্তী পরিবারের উদ্ভব হয়েছিল।

প্রাচীন ও মধ্যেযুগের হিন্দুধর্ম ও সমাজের রীতিনীতি ইত্যাদি যদি তুলনা করতে হয় তাহলে বর্তমান যুগের সাথে নয়, তা করতে হবে সমসাময়িক মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সমাজের সাথে। যেমন, প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে আইনগত ভাবে প্রত্যেক মহিলার পুরুষ অভিভাবক থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। মধ্যযুগে এসে, অবিবাহিতা মহিলার ক্ষেত্রে কিছু আইনি সুবিধা থাকলেও বিবাহিতাদের অবস্থা পূর্বের মতোই ছিল। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের গণতান্ত্রিক রাজ্যগুলোতে মহিলাদের ভোটাধিকার ছিল না, ‘প্রগতিশীল’ ব্রিটেনে মহিলারা জাতীয় নির্বাচনে পুরুষদের সমভোটাধিকার লাভ করেন মাত্র ১৯২৮ বর্ষে, তার আগে ১৯১৮-তে শুধু ত্রিশোর্ধ মহিলারা এই অধিকার পেয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলারা এই অধিকার লাভ করেন ১৯২০-তে। এছাড়া আব্রাহামীয় ধর্মে নারীর অবস্থান আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। মধ্যযুগে কোন মহিলার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমান থাকলে তার একমাত্র শাস্তি ছিল জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ্ হওয়া, যদিও পুরুষদের ক্ষেত্রে শাস্তি বহুপ্রকার ছিল। এছাড়া ‘ইনকুইজিশন’-এর সময় চার্চের দ্বারা মহিলাদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হয়, চলে যৌন নির্যাতন। ‘ডাইনী’ অপবাদ দিয়ে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয় অনেককে, ‘জোন অফ আর্ক্’ যাদের অন্যতম। আর মুসলিম সমাজে মহিলাদের বৃহদংশ তো আজও বোরখার আড়ালে কালানিপাত করে, এবং ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে নিজেদের স্বামীর বহুগামিতা অথবা ‘নিকাহ্ হালালা’র মতো প্রথাকে মেনে নিতে হয়। এভাবে তুলনা করলে আমরা দেখব, অন্তত ইসলামী আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্যদের তুলনায় হিন্দু সমাজে মহিলারা ছিলেন অনেক বেশি স্বাধীন।

পারিবারিক সুখ, সমাজ এবং রাজনীতি

গার্হস্থ্য আশ্রমকে অবলম্বন করেই সকল আশ্রম এবং সমাজ চালিত হয়। অতএব সকল আশ্রমের মধ্যে গার্হস্থ্য আশ্রমই শ্রেষ্ঠ।

গৃহস্থঃ প্রত্যহং যস্মাত্তস্মাজ্জ্যেষ্ঠাশ্রমী গৃহী।
ত্রয়াণামাশ্রমাণাস্তু গৃহস্থো যোনিরুচ্যতে।। (দক্ষসংহিতা, ৪৩)

অর্থাৎ দেবগণ, মনুষ্যগণ, এবং কীটপতঙ্গগণ (‘ত্রয়াণাং’) প্রতিদিন গৃহস্থ দ্বারা জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করে, এ নিমিত্ত গৃহস্থাশ্রম শ্রেষ্ঠ। এই নির্ভরতার কারণ অর্থ এবং কৃষি ও অন্যান্য সামগ্রীর উৎপাদন বিহীন জীবন নির্বাহ অসম্ভব। সমাজে অভাব-অনটন থাকলে শুধু জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে না, সাথে নৈরাজ্য দেখা দেয়। নৈরাজ্য, অনাচারের মধ্যে ধর্ম-নৈতিকতার পথ হয়ে ওঠে বন্ধুর। অপরদিকে স্থিতিশীল সমাজেই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। তার জন্য চাই সুশাসন এবং জাতির সার্বভৌমত্ব। দেশের বৈভব রক্ষিত হয় না যদি বহিরাক্রমণ থেকে জাতিকে রক্ষা করা না যায়। বিগত হাজার বছর ভারত যে একাধিক আক্রমণের শিকার হয়েছে তার কারণ কৃষি, শিল্প ও খনিজ উৎপাদনে ভারত ছিল অগ্রগণ্য। হিন্দু জাতির বর্তমান আর্থিক, সামাজিক ও বৌদ্ধিক অবক্ষয়ের কারণ বিগত হাজার বছর ধরে আমরা বহিরাক্রমণকে সাফল্যের সাথে রুখতে সমর্থ হইনি।

মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি, নৈতিকতা এবং রাজনীতির এই নিগূঢ় সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে চাণক্য সূত্র-এ:

সুখস্য মূলং ধর্মঃ।
ধর্মস্য মূলং অর্থঃ।
অর্থস্য মূলং রাজ্যম্।
রাজ্যস্য মূলং ইন্দ্রিয়জয়ঃ। (চাণক্য সূত্র, ১/২-৫)

সমাজজীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে যখন মানুষের জীবন গঠিত হয় নৈতিক মূল্যবোধকে আশ্রয় করে। কিন্তু সেই নৈতিক জীবন তখনই সুনিশ্চিত হবে যখন সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হয়। অর্থনীতি রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত, তার জন্য চাই দক্ষ ও লোকহিতৈষী শাসক শক্তি, যা পরাধীন দেশে কখনই সম্ভব নয়। সুতরাং সমাজের সুখ, সমৃদ্ধি এবং ধর্ম রক্ষার্থে স্বদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা একান্তই প্রয়োজন, জন্মভূমি যে ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’, স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়, তা অতিশয়োক্তি নয়। আর স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে, দেশের সার্বিক উন্নতি সাধন করতে প্রয়োজন এমন প্রশাসকের যিনি দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়পরায়ণ এবং সংযতেন্দ্রিয়। অতি প্রাচীন যুগের রাজর্ষি জনকের উল্লেখ আমরা হিন্দু পুরাণ ও ইতিহাসে পাই, কিন্তু প্রামাণ্য হিন্দু ইতিহাসে এমন এক রাজার দৃষ্টান্ত ছত্রপতি শিবাজী।

চতুর্বর্ণ সমাজ

মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম গভীর সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ হিন্দু সমাজেই হয়েছিল। সংস্কৃত কোষ ও ব্যাকরণের প্রাচীনতম গ্রন্থ, যাস্কের নিরুক্ত-এ বলা হয়েছে বর্ণ শব্দ এসেছে ‘বৃ’ ধাতু হতে যার অর্থ চয়ন বা বেছে নেওয়া। কৃষির উন্নতি ও বাণিজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে মানুষ তার সহজাত গুণ ও প্রবৃত্তি অনুসারে জীবিকার পথ বেছে নিতে শুরু করে। ক্রমশ ঋগ্বেদ যুগের দ্বিতীয়ার্থে সামাজিক বিন্যাস একটি পরিণত অবস্থায় এলে মানুষের সহজাত দক্ষতা, বৃত্তি, বুদ্ধিমত্তা, দায়িত্ব ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে সমাজকে চার শ্রেণী বা বর্ণে বিভক্ত করা হয়। তাই বর্ণের উল্লেখ ঋগ্বেদের প্রাচীন অংশে (দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল, পঞ্চম ব্যতিরেকে) নেই, আছে নবীন অংশের দু’টি মণ্ডলে—প্রথম ও দশমে। দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্ত যথেষ্ট পরিচিত হলেও ঋগ্বেদে প্রথমবার কর্মের ভিত্তিতে চার শ্রেণীর উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম মণ্ডলের উষা সূক্তে—

ক্ষত্রায়  ত্বং শ্রবসে ত্বং মহীয়া ইষ্টয়ে ত্বমর্থমিব ত্বমিত্যৈ।
বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ উষা অজীগর্ভুবনানি বিশ্বা।। (ঋগ্বেদ ১/১১৩/৬)

(বঙ্গানুবাদ: উষার প্রকট হতে কেউ ক্ষাত্র কার্যে, কেউ জ্ঞান অর্জনে, কেউ মনিবের সেবায় এবং কেউ ধনপ্রাপ্তির অন্বেষণে, প্রত্যেকে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন কর্মে নিযুক্ত হয়ে পড়ে।)

গীতাকার চতুর্থ অধ্যায়ে এই ভাবনা সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেছেন—‘চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ’(৪/১৩), প্রত্যেক ব্যক্তির দেহমনে তিনটি গুণের কার্যকারিতা ও তাদের কর্ম অনুযায়ী মানবসমাজকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। শুধু শ্রেণীবিভাগে এই সামাজিক পাঠ থেমে থাকলো না, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য এই চার শ্রেণীর সমন্বয় সাধন করে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে উঠল, যার প্রথম আভাস পাওয়া যায় ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সুক্তের একটি শ্লোকে (ঋগ্বেদ ১০/৯০/১২)। ষোলোটি ঋকের এই সূক্ত মূলত পুরুষ বা পরব্রহ্মের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত। পরব্রহ্মের বিভূত্ব বোঝাতে তাঁকে কল্পনা করা হয়েছে সহস্র মস্তক, সহস্র হাত ও পা বিশিষ্ট বিরাট পুরুষরূপে; সকল সৃষ্টি তাঁর হতে উৎপন্ন। সৃষ্টির বিবরণের প্রত্যেক ঋকে আমরা দেখি চতুর্তত্ত্বের উল্লেখ। যেমন ঋক, সাম, যজু ও ছন্দের, সূর্য-সোম, ইন্দ্র ও অগ্নি, ইত্যাদি। একইভাবে দ্বাদশ শ্লোকে তাঁর মুখ হতে ব্রাহ্মণ, বাহু হতে ক্ষত্রিয়, জঙ্ঘা হতে বৈশ্য এবং পা হতে শূদ্রের জন্মের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে বেদাঙ্গের বিবিধ ধর্মসুত্র ও গৃহ্যসূত্রের গ্রন্থের মাধ্যমে শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ, এই চার শ্রেণীর জন্য কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো, গড়ে উঠল বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। 

শ্রীশ্রীগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে পূর্বোক্ত শ্লোকের বক্তব্য আর একবার পুনরাবৃত্তি করে প্রত্যেক বর্ণের স্বধর্ম অনুযায়ী কর্ম বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণক্ষত্রিযবিশাং শূদ্রাণাং চ পরংতপ৷
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ৷৷
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ৷
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্৷৷
শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলাযনম্৷
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্৷৷
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্৷
পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্৷৷
স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ৷
স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছৃণু৷৷ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ১৮/৪১-৪৫)

সংক্ষেপে শম, দম, তপঃ, শৌচ, স্বধ্যায় ইত্যাদি ব্রাহ্মণের কর্ম, শৌর্য, তেজ ও ধৃতির প্রকাশ, প্রভুত্ব ও দান ক্ষত্রিয়ের কর্ম, কৃষি ও বাণিজ্য বৈশ্যের এবং পরিচর্যামূলক কাজ শূদ্রের কর্ম। শ্রীশ্রীগীতায় উক্ত শ্লোক সমূহের একটি তাৎপর্য দিক প্রতিবার ‘স্বভাবজম্’ শব্দের ব্যবহার, যার দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন এই শ্রেণী অনুসারে কর্মগুলি স্বভাবজাত হলেই একজন প্রকৃতপক্ষে সেই শ্রেণীর অন্তর্গত।

চতুর্বর্ণের আর এক বৈশিষ্ট তার শ্রেণীবিন্যাস বা হায়ারার্কি, যার যৌক্তিকতা সম্ভবত নিহীত ছিল দায়িত্ব, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার উপর। শূদ্রের কাঁধে তাঁর পরিবারের দায়িত্ব, বৈশ্য তাঁর নিজের পরিবার ছাড়াও পরোক্ষভাবে তাঁর কর্মচারীদেরও অন্নদাতা, ক্ষত্রিয়ের উপর নির্ভর করে সমগ্র রাজ্যের সমৃদ্ধি এবং ব্রাহ্মণের উপর ন্যস্ত রাজন্যের পৌরোহিত্য এবং নীতি নির্ধারণের সহায়তায়। দায়িত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মের বৃত্তও বিস্তার লাভ করে। সুতরাং প্রয়োজন হয় অধিক নেতৃত্বগুণ এবং বুদ্ধিমত্তার, যদিও প্রতি স্তরে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।

আদর্শ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্য দেখা দিল অন্য সমস্যা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্থবিরতা, প্রাক-শিল্প যুগের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং মেধার স্বত্ত্বাধিকার রক্ষা করতে বৃত্তি হয়ে উঠল বংশানুক্রমিক, আবির্ভাব হলো হিন্দুর সামাজিক দর্শনের বহির্ভুত জাতের। একদিকে গুণ-কর্মের ভিত্তিতে বর্ণের তাত্ত্বিক কাঠামো, অপরদিকে তত্ত্বের প্রতিকূল বংশানুক্রমিক বৃত্তি গ্রহণ, এই দুইয়ের যোগফলে জাত-বর্ণের এক মিশ্র আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উদ্ভব হলো যা আজ বহু বিতর্কিত ও সমালোচিত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রতত্ত্ব বিভাগে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বর্ণভিত্তিক জাত ব্যবস্থার কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও সমকালীন পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মীয়-সামাজিক ব্যবস্থার তুলনায় ছিল অনেক উন্নত। প্রথমতঃ, এখানে শ্রেণীবিন্যাস থাকলেও বৃত্তি ও যাপন ক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর জন্য কিছু সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যাতে কোন এক শ্রেণীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা না আসে। এর ফলে সম্পদ ও ক্ষমতার বন্টন ছিল অধিক সুষম। দ্বিতীয়তঃ, নৈতিকতার দিক থেকে এই ব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি মানবিক—পরধর্ম বিদ্বেষ, বিজাতীয় সংস্কৃতির ধ্বংস বা বিধর্মীদের গণহত্যা ও বিজিত জাতির মহিলাদের যৌনদাসী করার শিক্ষা এই ব্যবস্থায় ছিল না। আর নারীর অবস্থান, অন্তত ইসলামী আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত ছিল বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ, যা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।

পঞ্চযজ্ঞ: সমাজ ও জাতির প্রতি হিন্দুর সার্বজনীন কর্তব্য

বর্ণাশ্রম ধর্ম (অর্থাৎ কর্তব্য কর্ম) ছাড়া এক সার্বজনীন বা সাধারণ ধর্ম বা কর্তব্য কর্মের আলোচনা হিন্দু শাস্ত্রে পাওয়া যায়। মনুস্মৃতিতে সার্বজনীন ধর্মের অর্থাৎ সকলের অনুকরণীয় দশটি কর্মের উল্লেখ রয়েছে—

ধৃতি ক্ষমা দমোঽস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্ম্মলক্ষণম্।। (মনু ৬/৯২)

পূর্বে উদ্ধৃত শ্রীশ্রীগীতার ১৮/৪২ শ্লোকের সাথে উপরোক্ত শ্লোকের তুলনা করলে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় স্মৃতিকার ব্রাহ্মণ শ্রেণীভুক্ত হবার কারণে ব্রাহ্মণের সাধারণ কর্তব্যই সার্বজনীন ধর্ম বলে তাঁর কাছে বিবেচিত হয়েছে। আজ হিন্দু সমাজের অধিকাংশের কাছে এইরূপ নিজেদের স্বভাবের পরিপন্থী ধর্মশিক্ষা হিন্দুধর্মকে অনেকাংশে অপধর্মে পরিণত করেছে। এই পরিস্থিতি হিন্দু সমাজে ধর্মহীনতার অন্যতম কারণ। এর পরিবর্তে শাস্ত্রোক্ত পঞ্চঋণের শোধ হিন্দু সমাজের সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

হিন্দুধর্ম মতে মানুষ জন্ম হতেই কয়েকটি ঋণে বদ্ধ—‘জায়মানো বৈ ব্রাহ্মণস্ত্রিভিঃ ঋণৈঃ ঋণবান জায়তে।‘ ক্রমে এই তিন ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে পাঁচ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন—

দেবগণ মানুষের ভাগ্যবিধাতা; পিতৃগণ তাঁহাকে মানবজন্ম দিয়াছেন; ঋষিগণ যে বিদ্যা প্রচার করিয়া গিয়াছেন, সেই বিদ্যাই তাঁহাকে উৎকৃষ্ট দ্বিতীয় জন্মের অধিকারী করিয়াছে; বন্ধু প্রতিবেশী হইতে সমাজের যাবতীয় ব্যক্তি তাঁহাকে রক্ষা করিতেছে; পশু পক্ষী, কীট পতঙ্গ পর্যন্ত কোন-না-কোনরূপে তাহার জীবন রক্ষার সাহায্য করিতেছে। অতএব ইহাদের সকলের নিকটেই ঋণ আছে। এই পাঁচটি ঋণ লইয়াই মানুষকে জন্মিতে হয়। ঋণের বোঝা ফেলিয়া রাখিয়া জীবনযাত্রাটা দুষ্কৰ্ম্ম। জীবন ব্যাপিয়া এই ঋণশোধের চেষ্টা করিতে হইবে। [8]

পঞ্চযজ্ঞের মাধ্যমে এই সকল ঋণের পরিশোধ করা হিন্দু সমাজের সার্বজনীন কর্ত্যব্য—

(১) দেবযজ্ঞ: দেবগণের পূজা-প্রার্থনা এবং হোম ইত্যাদি।
(২) ঋষিযজ্ঞ: ঋষিপ্রণীত ধর্মগ্রন্থ পাঠ।
(৩) পিতৃযজ্ঞ: পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ, মাতা-পিতা ও জীবিত পূর্বপুরুষদের সেবা, সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে বংশ ও সংস্কৃতি রক্ষা।
(৪) নৃ-যজ্ঞ: দেশ ও সমাজের কল্যাণযজ্ঞে নিযুক্ত হওয়া।
(৫) ভূতযজ্ঞ: জল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ, পশুপাখি এবং গাছের পরিচর্যা, বৃক্ষরোপন সহ প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কর্মে লিপ্ত হওয়া।

এইরূপ পঞ্চযজ্ঞের সাধন ব্যষ্টি এবং সমষ্টি, পরিবার এবং সমাজ, উভয়ের পক্ষে কল্যাণপ্রদ। 

প্রসঙ্গসূত্র:

[1] রাজশেখর বসু, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, পৃ. ১৪ (ভূমিকা)

[2] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরচরিত, বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৪০০, পৃ. ৫০-৫১

[3] Swami Vivekananda, ‘Address Of Welcome Presented At Calcutta And Reply’, Lectures from Colombo to Almora, Complete Works of Swami Vivekananda, Vol 3, Advaita Ashrama, Online Edition, https://advaitaashrama.org/cw/volume_3/lectures_from_colombo_to_almora/address_of_welcome_presented_at_calcutta_and_reply.htm; বঙ্গীয় সংস্করণ: ‘কলিকাতা অভিনন্দনের উত্তর’; মূল ইংরেজি হতে অনুবাদ

[4] বিজয়ভূষণ ঘোষ চৌধুরী, আসাম ও বঙ্গদেশের বিবাহ-পদ্ধতি, স্বপ্রকাশিত, ১৩৩৯ বঃ, পৃ. ৩৪৩

[5] বিজয়ভূষণ ঘোষ চৌধুরী, আসাম ও বঙ্গদেশের বিবাহ-পদ্ধতি, স্বপ্রকাশিত, ১৩৩৯ বঃ, পৃ. ৩৪৪

[6] বিজয়ভূষণ ঘোষ চৌধুরী, আসাম ও বঙ্গদেশের বিবাহ-পদ্ধতি, স্বপ্রকাশিত, ১৩৩৯ বঃ, পৃ. ৩৫০-৩৫১

[7] http://indiafacts.org/understanding-manu-smriti-women-freedom/

[8] রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১০৩