ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী – ৬

ক্রান্তদর্শী শ্রী সীতারাম গোয়েলের The Story of Islamic Imperialism in India মার্কসবাদী ইতিহাসচর্চায় ভারতে ইসলামী আক্রমণের উপেক্ষিত অধ্যায়গুলির উপর একটি বিশ্লেষণাত্মক গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় বই অত্যন্ত বিরল। বাঙালি পাঠককুলের কথা মাথায় রেখে বঙ্গদেশ পত্রিকা এই বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করছে। অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা অনুমতির জন্য ভয়েস অফ ইণ্ডিয়ার কাছে ঋণী।

১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা

 

ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী 

লেখক: সীতারাম গোয়েল

অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অধ্যায় ৬: মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১

বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট তাঁর ‘সভ্যতার গল্প’ (‘Story of Civilisation) পুস্তকে লিখেছেন : “ভারতবর্ষে মোহামেডান বিজয় সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত গল্প” (the Mohammedan conquest of India was probably the bloodiest story in history).

ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের আগেও ভারত খুব কিছু শান্তির স্থল ছিল না। হিন্দু রাজকুমারদের মধ্যে প্রচুর যুদ্ধ হয়েছিল। তবে সেই সমস্ত যুদ্ধে, হিন্দুরা রাষ্ট্র দ্বারা অনুমোদিত কিছু ঐতিহ্যবাহী হিন্দু নীতি পালন করতেন। ব্রাহ্মণ ও ভিক্ষুদের কখনও অসম্মান করা হত না। গরুদের কখনই হত্যা করা হত না। মন্দিরগুলিকে তো কখনও স্পর্শই করা হয়নি। মহিলাদের সতীত্ব কখনও লঙ্ঘিত হয়নি। অ-যোদ্ধাদের কখনও মারা হয়নি বা ধরাও হয়নি। দুর্গ না হলে কখনও কোনও মানুষের আবাসকে আক্রমণ করা হয়নি। নাগরিক জনগোষ্ঠী কখনই লুণ্ঠিত হয়নি। বিজয়ীদের গণনায় যুদ্ধে পাওয়া লুঠে মাল (War booty) ছিল সম্পূর্ণ অজানা এক ধারণা। যোদ্ধা শ্রেণীর মধ্যে যে সংঘর্ষ হত, তা বেশিরভাগ উন্মুক্ত স্থানে এবং সেটাও যথাযোগ্য সম্মানজনক নীতি মেনে। বিজয় বা বস্তুগত লাভের জন্য সম্মান ত্যাগকে মৃত্যুর চেয়েও অবাঞ্ছিত বলে মনে করা হত।

ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ একটি ভিন্ন নীতি আমদানি করে – রসূলের সুন্নাহ। যুদ্ধের ময়দানে কোনও বিজয় নিশ্চিত অর্জনের পরে তার যোদ্ধাদের অসহায় নাগরিক জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। প্রতিহতকারীরা বা রক্ষণাত্মক পক্ষ লড়াইয়ে মারা যাওয়ার বা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের গ্রাম ও শহরগুলিকে নষ্ট করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অযোদ্ধাদের মধ্যে গরু, ব্রাহ্মণ ভিক্ষুদের হত্যা মনোযোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মন্দির এবং মঠগুলি তো ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগের বিশেষ প্রতীকী লক্ষ্য ছিল। যাদের হত্যা করা হত না, তাদের বন্দী করে দাস হিসাবে বিক্রি করা হত। এমনকি মৃতদেহগুলির দেহ থেকেও লুণ্ঠিত করা লুটের পরিমাণও ছিল সামরিক অভিযানের সাফল্যের একটি মাপকাঠি। আর এ সমস্ত কাজই তারা করত মুজাহিদ (পবিত্র যোদ্ধা) এবং গাজি (কাফির-হত্যাকারী) হিসাবে আল্লাহ ও তাঁর শেষ নবীর খিদমতে।

হিন্দুদের কাছে এই নতুন আক্রমণকারীদের মনস্তত্ত্ব ছিল দুর্বোধ্য। ইতিহাসে প্রথমবার হিন্দুরা এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল, যা ‘কানহাদাড়ে প্রবন্ধ’-এ (১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দ) নিম্নলিখিত ভাষায় বর্ণিত হয়েছিল: “বিজয়ী সেনাবাহিনী গ্রামগুলিকে পুড়িয়ে দিয়েছে, জমি ধ্বংস করেছে, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, ব্রাহ্মণ, শিশুদের ও সকল শ্রেণীর মহিলাদের বন্দী করে স্থূল আড়ালে রেখে চাবুক মারতে মারতে নিয়ে যেতে যেতে কার্যত যেন চলন্ত কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল। বন্দীদেরকে আপত্তি অগ্রাহ্য করে তুর্কীতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।” এটা লেখা হয়েছিল ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটে আলাউদ্দিন খলজির আগ্রাসনের স্মরণে। কিন্তু এই মারাত্মক খেলাটি তিন শতাব্দী আগেই শুরু হয়েছিল, যখন মাহমুদ গজনবী প্রতিবছর প্রতিমা ধ্বংস, কাফিরদের হত্যা, যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের সবাইকে বন্দী করা এবং ভারতের সুপরিচিত বিশাল সম্পদ লুণ্ঠনের বলা যায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

মাহমুদ গজনবী ও তাঁর পুত্র

১০০০ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ কাবুলের হিন্দু শাহিয়া রাজবংশের এক রাজপুত্র রাজা জয়পালকে পরাজিত করেছিলেন। এই রাজবংশ দীর্ঘকাল ধরে উত্তর-পশ্চিমের ভারতের দ্বাররক্ষকের কাজ করছিল। মাহমুদ ক্ষতিপূরণ হিসাবে ২,৫০,০০০ দিনার আদায় করেছিলেন। সেটা সম্ভবত ছিল কোনও সাম্রাজ্য নির্মাতার স্বাভাবিক ব্যবসা। কিন্তু ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভাটিয়া আক্রমণ করে জায়গাটি লুণ্ঠন করেছিলেন। তিনি তাঁর সঙ্গে আনা মোল্লাদের সাহায্য নিয়ে সেখানকার হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য সেখানে কিছু দিন অবস্থান করেছিলেন। ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাগরকোট (কাংরা) দখল করেন। লুটের পরিমাণ ছিল মুদ্রায় ৭০,০০০,০০০ দিরহাম এবং ৭,০০,৪০০ মণ স্বর্ণ ও রৌপ্য, তাছাড়া প্রচুর মূল্যবান পাথর এবং সূচিকর্মযুক্ত কাপড়। ১০১১ সালে তিনি অরক্ষিত থানেসারকে লুণ্ঠন করে অনেক মন্দির ধ্বংস করেন এবং প্রচুর প্রতিমা ভেঙে দেন। বিশ্বাসীদের পায়ের নীচে অশুচি করার উদ্দেশ্যে প্রধান বিগ্রহ ‘চক্রস্বামিন’-এর মূর্তিটিকে গজনিতে নিয়ে গিয়ে সরকারী চত্বরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মাহমুদের সচিব উতবির লেখা ‘তন্‌খ্‌-ই-ইয়ামান’ অনুযায়ী, “কাফেরদের রক্ত ​​এত প্রচুর পরিমাণে প্রবাহিত হয়েছিল [থানসারে] যে শুদ্ধ জলের বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়, এবং কেউ তা পান করতে পারছিল না।” সুলতান যে লুটপাট নিয়ে ফিরে এসেছিলেন তা গণনার অতীত। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের যে সম্মান দান করেন, তার জন্য আল্লাহর প্রশংসা প্রাপ্য। [“The blood of the infidels flowed so copiously [at Thanesar] that the stream was discoloured, notwithstanding its purity, and people were unable to drink it. The Sultãn returned with plunder which is impossible to count. Praise he to Allah for the honour he bestows on Islãm and Muslims.”]

১০১৩ সালে মাহমুদ নন্দনার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন যেখানে শাহিয়া রাজা আনন্দপাল তাঁর নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। হিন্দুরা দারুণ লড়াই করেও পরাজিত হয়েছিল। পুনরায় মন্দিরগুলি ধ্বংস এবং নিরীহ নাগরিকদের জবাই করা হয়েছিল। উতবি লুণ্ঠিত সম্পদ ও যুদ্ধবন্দীদের একটা বিবরণ দিয়েছেন: “সুলতান পেছনে প্রচুর লুঠের সামগ্রী নিয়ে ফিরে এসেছিল। গোলামরা এত বেশি সংখ্যায় ছিল, যে তাদের দর খুব সস্তা হয়ে যায় এবং স্বদেশে শ্রদ্ধেয় লোকেরাও অবনমিত হয়ে সাধারণ দোকানদারদের দাসে পরিণত হয়। তবে এটাই আল্লাহ তালার মহিমা, যিনি তাঁর নিজের ধর্মকে মর্যাদা দিয়ে কাফেরদের প্রতি অসম্মান বর্ষণ করেন।”

এরপর রাস্তাটি হিন্দুস্তানের প্রাণকেন্দ্র আক্রমণ করার জন্য পরিষ্কার হয়ে গেল। ১০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাহমুদ যমুনা পেরিয়ে বারান (বুলান্দশহর) থেকে ১,০০০,০০০ দিরহাম সংগ্রহ করেন এবং মথুরা জেলার মহাবানে যাত্রা করেন। উতবির নথি জানাচ্ছে: “কাফেররা দুর্গটি নির্জন করে ফেননিভ নদী পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের অধিকংশকে হত্যা করা হয়েছিল বা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল।” [“The infidels deserted the fort and tried to cross the foaming river, but many of them were slain, taken or drowned. Nearly fifty thousand men were killed.”] পরের শিকার ছিল মথুরা। মাহমুদ ৮৯,৩০০ মিসকাল ওজনের পাঁচটি সোনার প্রতিমা ও ২০০টি রূপোর মূর্তি জবরদখল করেন। উতবির মতে, “সুলতান আদেশ দিয়েছিলেন যে সমস্ত মন্দিরকে ন্যাপথা ও আগুন দিয়ে পোড়াতে হবে এবং মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।” নগরটির ওপর লুঠপাঠ ২০ দিন ধরে অব্যাহত ছিল।

মাহমুদ এবার ফিরলেন কনৌজের দিকে তখনও পর্যন্ত যা বেশ কয়েকটি হিন্দু রাজবংশের আসন ছিল। উতবি আরও জানাচ্ছেন: “কানৌজে প্রায় দশ হাজার মন্দির ছিল। সেখানকার অনেক বাসিন্দাই তাদের বধির ও বোবা মূর্তির ভাগ্য প্রত্যক্ষ করে পালিয়ে গিয়েছিল। যারা পালায়নি, তাদের হত্যা করা হয়েছিল। সুলতান তাঁর সৈন্যদের লুটপাট ও বন্দীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটি দিয়েছিল। পরের দিকে আক্রান্ত মুঙ্গের ব্রাহ্মণরা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আগুনে নিক্ষেপ করে শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকতেও যুদ্ধ করে গিয়েছিল। আসির ভাগ্য রুদ্ধ হয়েছিল এর শাসক ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ায়।” উতবির মতে, “সুলতান আদেশ দিয়েছিলেন যে তাঁর পাঁচটি দুর্গ তাদের ভিত্তি থেকে ভেঙে ফেলার যাতে তাদের ধ্বংসস্তূপে বাসিন্দারা জীবন্ত সমাহিত হয় এবং বাহিনীর সৈন্যরা লুণ্ঠন, হত্যা এবং বন্দী করা চালিয়ে যায়।

আক্রমণের পরের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য শ্রাওয়াও একই পরিণতির মুখোমুখি হয়েছিল। উতবি উপসংহারে লিখেছেন: “মুসলমানরা কাফের এবং সূর্য ও আগুনের উপাসকদের বধ করে আত্মতৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত লুটের প্রতি মনোনিবেশ করেনি। আল্লাহর বন্ধুরা লুঠ পাওয়ার জন্য নিহতদের লাশ তিন দিনের জন্য সন্ধান করে চলে। লুটের মধ্যে ছিল প্রায় তিন লক্ষ দিরহাম মূল্যের সোনা, রূপো, চুনী ও মুক্তো। আর ঘটনার বিবরণ ও বন্দীদের সংখ্যা থেকে অনুমান করা ধৃত বন্দীদের প্রত্যেককেই দুই থেকে দশ দিরহামে বিক্রি করা হয়েছিল। এরপরে এগুলি গজনিতে পাঠানো হয়েছিল যেগুলো কেনার জন্য দূরদূরান্তের শহর থেকে ব্যবসায়ীরা গজনিতে হাজির হয়েছিল এবং যার ফলে মাওরাউন-নাহর, ইরাক ও খুরসানের মতো দেশগুলি ভারতীয় দাসে ভরে যায়। ফরসা, কালো, ধনী দরিদ্র সবাই একত্রিত হয়েছিল একটি সাধারণ দাসত্ব বন্ধনে।

মাহমুদের সোমনাথ আক্রমণ এতটাই পরিচিত যে নতুন করে বলার কিছু নেই। যেটা জোর দেওয়ার সেটা হল, শিবলিঙ্গের টুকরো গজনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যার কিছু কিছু জামা মসজিদের সিঁড়ি নির্মাণের কাজে লাগানো হয়। বাকিগুলো মক্কা, মদিনা ও বাগদাদে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় একইভাবে অপবিত্র করার জন্য।

মাহমুদের ছেলে মাসুদও তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছিল। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে সে হানসি দুর্গটি দখল করতে সফল হয় যা হিন্দুরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে রক্ষা করেছিল। ‘তারিখ-উস-সুবুক্তিগিন (Tãrîkh-us-Subuktigîn) নথিভুক্ত করেছে: “ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ পুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল; এবং তাদের মহিলা ও শিশুদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর যে সমস্ত ধনসম্পদ পাওয়া গিয়েছিল, তা সেনাবাহিনীর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল।” পূর্বনির্ধারিত অন্যত্র ব্যস্ততার কারণে মাসুদ এই আচরণের বিশেষ পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি।

মহম্মদ ঘোরী ও তাঁর সেনাপতি

দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের শেষ দিকে নতুন করে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা ভারত আক্রমণ শুরু হয়েছিল মুহাম্মাদ ঘোরীর মাধ্যমে। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করার পরে, ঘোরী আজমেরের ওপর হামলা করে। হাসান নিজ়ামীর ‘তাজ-উল-মাসির’ অনুসারে, সুলতান আজমিরে থাকাকালীন সমস্ত মূর্তি ও মন্দিরগুলির স্তম্ভ এবং ভিত্তি ধ্বংস করেছিলেন এবং তাদের জায়গায় স্থায়ী মসজিদ, মহাবিদ্যালয় নির্মাণ করে ইসলামী নিয়মকানুন, আইন ও রীতিনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পরের বছর তিনি কানৌজের জয়চন্দ্রকে পরাজিত করেন। অবধারিতভাবে এর পরে জনসাধারণের গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুঠপাঠ চলে। গহড়বাদের আস্নি ও বারাণসীর ভান্ডারগুলি লুণ্ঠিত হয়। হিন্দ তথা হিন্দুত্বের কেন্দ্রস্থল বেনারসে তারা এক হাজার মন্দির ধ্বংস করে তাদের ভিত্তির ওপর মসজিদ স্থাপন করে হাসান নিজ়ামী রীতিমতো উৎফুল্ল হন। ইবনে আসিরের ‘কামিল-উল-তাওয়ারিখ (Kãmil-ut-Tawãrîkh) অনুযায়ী “হিন্দুদের নিধন (বারাণসীতে) ছিল অপরিসীম; নারী ও শিশু ব্যতীত কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি এবং পৃথিবী অবসন্ন হওয়া অবধি পুরুষদের হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। নারী ও শিশুদের বাঁচানো হয়েছিল যাতে তাদের দাসত্বের জন্য সমগ্র ইসলামী বিশ্বে বিক্রি করা যায়। সঙ্গে এটাও যোগ করা যেতে পারে, এই সময়ে সারনাথে বৌদ্ধ ক্ষেত্রকেও অবরোধ করে ভিক্ষুদের বধ করা হয়েছিল।

ঘোরীর সেনাপতি (lieutenant) কুতুবুদ্দিন আইবাকও এর মধ্যে ব্যস্ত ছিলেন। হাসান নিজ়ামী লিখেছেন যে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে কোল (আলীগড়)-এ হিন্দু বিদ্রোহ দমনের পরে আইবাক তাদের মাথা দিয়ে প্রায় স্বর্গসমান উঁচু দুর্গের তিনটি প্রান্ত নির্মাণ করান, আর মৃতদেহগুলি হয়ে ওঠে পশু শিকারের পশুখাদ্য বা টোপ। পুরো এলাককে প্রতিমা ও মূর্তি-উপাসনা থেকে মুক্ত করা হয়েছিল এবং কাফেরবাদের ভিত্তিই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।” ১১৯৪ সালে আইবক দিল্লীতে ২৭টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে এবং তাদের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে কুওয়াত-উল-ইসলাম (Quwwat-ul-Islãm) মসজিদ নির্মাণ করান। নিজ়ামীর সূত্রমতে, আইবক এটিকে হাতির সাহায্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া মন্দিরগুলি থেকে পাওয়া পাথর ও সোনা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন। ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে আজমেরের মীর উপজাতি বিদ্রোহ করে এবং গুজরাটের চৌলুক্যরা তাদের সহায়তায় করতে এগিয়ে আসে। পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আইবককে আগে গজনি থেকে সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়েছিল। ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি গুজরাটের রাজধানী আনহিলওয়ার পাটনের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। নিজ়ামী লিখেছেন, যে রাজা করণকে পরাজিত ও পালিয়ে যেতে বাধ্য করার পরে, পঞ্চাশ হাজার কাফেরকে তরোয়ালের আগায় জাহান্নামে পাঠানো হয় এবং আরও বিশ হাজারেরও বেশি দাসকে ও গণনাতীত গবাদি পশু সেই হামলাবাজদের হাতে পড়েছিল। শহরটিকে অবরুদ্ধ করে তার মন্দিরগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং প্রাসাদগুলির ওপর চলেছিল লুঠপাঠ। আজমীরে ফিরে আসার পরে আইবক বিশালদেব সংস্কৃত কলেজ ধ্বংস করে একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন যা ক্রমে ‘আধী দিন কা ঝোম্পাড়া’ (ADhãî Din kã JhoMpaDã) নামে পরিচিতি লাভ করে। ১২০২ খ্রিস্টাব্দে কালিঞ্জর বিজয় ছিল আইবকের কাছে বড় মুকুট অর্জনের মতো। নিজ়ামী শেষ করেছেন এইভাবে: “মন্দিরগুলি মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল। পঞ্চাশ হাজার লোক দাসত্বের কবলে পড়ে এবং সমভূমিটি হিন্দুদের কাছে আলকাতরার মতো কালো হয়ে যায়।”

একজন মুক্ত অভিযানকারী মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি তখন আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিহারের অরক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় শহর ওদন্তপুরী অবরোধ করে এবং মঠগুলিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গণহত্যা করেন। ১২০২ সালে তিনি নদিয়াকে হতবাক করে আক্রমণ করেন। বাদাউনি তাঁর মুনতাখব-উৎ-তাওরিখ (Muntakhãb-ut-Tawãrîkh )-এ লিপিবদ্ধ করেছেন, অগণিত সম্পদ ও লুণ্ঠনসামগ্রী মুসলমানদের হাতে পড়ে এবং মুহাম্মদ বখতিয়ার কাফেরদের উপাসনা ও মূর্তি মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ ও খানকাহ স্থাপন করেন।

দাস (মামলুক) সুলতান

দিল্লীতে আইবাকের পরে আসেন শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ যিনি ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে মালওয়া আক্রমণ করেছিলেন। তিনি বিদিশায় একটি প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। বাদাউনির প্রতিবেদন লিখেছেন: ছয় শত বছর পূর্বে নির্মিত উজ্জয়িনীর মূর্তি মন্দিরটি ধ্বংস করার পর ‘মহাকাল’ নামে অভিহিত মন্দিরটি ভিত্তি পর্যন্ত মাটিতে মিশিয়ে দেন এবং এবং রায় বিক্রমজিৎ-এর মূর্তি ছুঁড়ে ফেলেন, যাঁর নাম অনুসারে হিন্দুরা বর্ষপঞ্জি ও যুগ গণনা করে এসেছে। শুধু তাই নয় কিছু ছাঁচে ঢালা গলিত পেতলের মূর্তি ও কয়েকটি চিত্র নিয়ে এসে পুরানো দিল্লীর মসজিদের দরজার সামনে মাটিতে বিছিয়ে রাখেন এবং লোকদের সেগুলো পদদলিত করার নির্দেশ দেন।

ইলতুৎমিশের পর ভারতে মুসলিম শক্তি মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছিল। বলবনকে পুনর্জাগরিত হিন্দু শক্তি বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পরবর্তী ইতিহাসে রোহিলখণ্ড নামে পরিচিত কাটিহার রাজপুতরা ততদিন পর্যন্ত ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতি স্বীকার করেনি। ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দে বলবন গঙ্গার ওপারে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাদাউনির সূত্রানুসারে, “দিল্লী ছাড়ার দু’দিন পরে তিনি কাটিহার অঞ্চলে পৌঁছেছিলেন এবং প্রত্যেক পুরুষকে হত্যা করেছিল, এমনকি আট বছরের শিশুকেও রেহাই দেয়নি, এবং মহিলাদের বেঁধে রেখেছিল।” কিন্তু এরূপ নির্দয় নিষ্ঠুরতার পরেও খলজিরা ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে পুনরুজ্জীবিত না হওয়া পর্যন্ত মুসলিম শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল।

খলজি বংশ

জালালউদ্দিন খলজি ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোর অভিযানের নেতৃত্ব দেন। পথে তিনি ঝৈনে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। জামা মসজিদের ফটকের সামনে ভাঙা প্রতিমাগুলি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দিল্লীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আলাউদ্দিন ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে বিদিশায় একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেন। বাদউনি জানাচ্ছেন, “আলাউদ্দিন সুলতানের জন্য প্রচুর যুদ্ধাহরণ নিয়ে ফিরেছিল। এবং সঙ্গে হিন্দুদের উপাস্য অনেক প্রতিমাও লুঠ করেছিলেন, যেগুলো বাদাউনের দরজার সামনে ফেলে রাখা হয় পদদলিত করার জন্য।” আলাউদ্দিনের সেই পরিষেবাগুলি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল, যার পুরস্কার স্বরূপ অউধের জায়গীরও তাঁর শাসনাধীন এলাকায় সংযুক্ত করা হয়।

এরপর নিজের কাকা তথা শ্বশুর জালালউদ্দিনকে খুন করার পরে আলাউদ্দিন ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হন। ১২৯৮ সালে তিনি গুজরাটে তাঁর সেনাপতি উলুগ খান ও নুসরত খানের নেতৃত্বে একটি অভিযানের আয়োজন করেন। পূর্বের এক অধ্যায়ে আমি ইতিমধ্যে তারিখ-ই-ওয়াসাফ (Tãrîkh-I-Wassãf ) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই অভিযানের সাফল্য বা অর্জনগুলোর বর্ণনা দিয়েছি।   হানাদাররা সুরত ও ক্যাম্বের বন্দর লুট করে নিয়ে যায়। হিন্দুদের দ্বারা পুনর্নির্মাণ করা সোমনাথের মন্দিরটি পুনরায় লুণ্ঠন করে প্রতিমাটি মুসলমানরা পায়ে মাড়িয়ে এই দিল্লীতে নিয়ে গিয়েছিল। পুরো অঞ্চলটাই ছিল আগুন ও তরোয়াল দ্বারা আক্রান্ত যেখানে হিন্দুদের ব্যাপক গণহত্যা করা হয়েছিল। গুজরাটের রানী কমলা দেবীকে রাজকোষের সাথে বন্দী করে দিল্লীতে আনা হয় এবং আলাউদ্দিনের হারেমে থাকতে বাধ্য করা হয়। ১৩১০-১১১১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে যাত্রা করার সময় মালিক নায়েবের কীর্তি তো ইতিমধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে।

তুঘলক বংশ

১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর পরে মুসলিম শক্তি আবার এক ধাক্কা খায়। তবে শীঘ্রই তুঘলকদের মাধ্যমে তা পুনরুত্থিত হতে পেরেছিল। ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বরাবর অধিকাংশ বিখ্যাত মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল; একমাত্র উড়িষ্যা এবং রাজস্থানে তখনও স্বাধীনতা বজায় ছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ ধনী কোষাগার লুণ্ঠিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ও তাদের তরোয়ালবাজদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশায় একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তিনি পুরীতে জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করেন এবং আরও অনেক হিন্দু মন্দিরকে অপবিত্র করেন। তাঁর নিজেরই লেখা বা তাঁর নির্দেশে লিখিত ‘সুরত-ই-ফিরোজ় শাহী’ (Sîrat-i-Fîrûz Shãhî) অনুসারে, “একমাত্র সত্য ঈশ্বর হলেন আল্লা এবং তিনি ছাড়া অন্য কোনও রূপ বা উদ্গম নেই, তিনিই ইসলামের বাদশাহকে ক্ষমতা দিয়েছেন যাতে পূর্ব সমুদ্র উপকূলে এই প্রাচীন মন্দিরটি ধ্বংস করে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া যায়। আর ধ্বংসের পর তিনি জগন্নাথের মূর্তিটিকে ছিদ্র করার ও মাটিতে ফেলে অসম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা জজনগর রাজ্যে মুশরিকদের দ্বারা উপাসনা করা অন্যান্য মূর্তিগুলি খনন করে জগন্নাথের মূর্তির মতোই অপমান করে ছুঁড়ে সুন্নী মসজিদের পথে ও মুসাল্লিতে (নমাজের রাস্তায়) বিছিয়ে রাখা হল এবং সবকটি মসজিদের চত্ত্বরে ফেলা হল যাতে মূর্তির সবকটি দিকেই আসা-যাওয়ার পথে প্রবেশ ও নিকাশ দ্বারে সর্বত্র মূর্তিগুলো মুসলমানদের পদপিষ্ট হয় বা মুসলমানরা জুতো পরেও তাদের মাড়াতে পারে।

উড়িষ্যার মন্দিরগুলি নিষিদ্ধ করার পর ফিরোজ শাহ তুঘলক সমুদ্র উপকূলে একটি দ্বীপে আক্রমণ করেছিলেন যেখানে জাজনগরের প্রায় ১,০০,০০০ পুরুষ তাদের স্ত্রী, শিশু, আত্মীয় এবং আত্মীয়দের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। কাফেরদের গণহত্যার দ্বারা ইসলামের তলোয়ারবাজরা দ্বীপটিকে রক্তের অববাহিকায় পরিণত করেছিল। আরও ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল বাচ্চাসহ মা ও গর্ভবতী হিন্দু মহিলাদের। ‘সুরত-ই-ফিরোজ় শাহী নথিবদ্ধ করেছে: “বাচ্চা এবং গর্ভবতী মহিলাদের সাথে মহিলাদের যেতে বাধা দিয়ে, আটক করে, শেকলে বেঁধে বন্দী করে রাখা হয়েছিল এবং বাধ্য করা হয়েছিল প্রত্যেক সৈন্যের বাড়িতে সেবার জন্য দাসত্ব করতে।”

ফিরোজ শাহ তুঘলক নগরকোটে (কাংরা) আরও ভয়ঙ্কর দৃশ্য সৃষ্টি করেছিলেন যেখানে তিনি জ্বালামুখীর স্মৃতিসৌধটি নিষিদ্ধ বা বাতিল করেন। ফিরিশতার নথি অনুযায়ী, “যে সুলতান জ্বালামুখীর মূর্তিগুলিকে টুকরো টুকরো করে গরুর মাংসের সাথে মিশিয়ে ব্রাহ্মণদের ঘাড়ে ও নাকের থলিতে ঝুলিয়ে দেন। আর বিজয়সূচক ট্রফি হিসাবে মূল মূর্তিটিকে তিনি মদিনায় প্রেরণ করেন।”

আমির তৈমুর

১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর আক্রমণের সময় চূড়ান্ত পর্বটি আসে। তিনি তাঁর তুজ়ুক-ই-তিমুরী (Tuzk-i-Timûrî) গ্রন্থে কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছেন: “হে নবী, কাফের ও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন এবং তাদের সাথে কঠোর আচরণ করুন।” তিনি আরও বলেছিলেন: “হিন্দুস্তান আক্রমণ করার ক্ষেত্রে আমার বড় বিষয়টি ছিল ধর্মবিরোধী কাফের (হিন্দু)দের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ করা, [যাতে] ইসলামের সেনাবাহিনী হিন্দুদের সম্পদ এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে সমৃদ্ধ হতে পারে।

শুরুতেই তিনি কাশ্মীরের সীমান্তে কাটোর দুর্গে ঝড় তোলেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের আদেশ দেন, সমস্ত পুরুষকে হত্যা, এবং সমস্ত নারী ও শিশুদের বন্দী করতে; আর তাদের সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করে বাকি সব বিনষ্ট করে দিতে। এরপরে, তিনি সেই সমস্ত একগুঁয়ে অবিশ্বাসীদের মাথার খুলির স্তূপীকৃত পাহাড়ের ওপর স্তম্ভ নির্মাণের নির্দেশ দেন। এর পরই, তিনি রাজপুতদের দ্বারা রক্ষিত ভাটনীর অবরোধ করেন। খানিক লড়াইয়ের পরে তারা আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে ক্ষমা করা হয়েছিল। কিন্তু অবিশ্বাসীদেরকে দেওয়া কথা রাখার দায় তো ইসলাম তৈমুরকে দেয়নি। নিজের তুজ়ক-ই-তিমুরি (Tuzk-i-Timûrî )-তেই লিখেছেন: “অল্প সময়ের মধ্যেই দুর্গের সমস্ত লোককে তরোয়াল দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল এবং এক ঘন্টার মধ্যে ১০,০০০ কাফেরের মাথা কেটে দেওয়া হয়েছিল। কাফেরদের রক্তে ইসলামের তরোয়াল ধুয়ে ফেলা হয়েছিল, এবং দুর্গে বহু বছর ধরে যে ধন-সম্পদ এবং শস্য জমা ছিল তা আমার সৈন্যদের লুণ্ঠনে পরিণত হয়েছিল। তারা ঘরগুলিতে আগুন ধরিয়ে ছাই করে দেয়। সেই সঙ্গে তারা ভবনগুলি এবং দুর্গটিকে পুরো ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।”

একইভাবে পরের শহর সরসুটি অবরোধ করে সমস্ত কাফের হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হয়েছিল এবং তাদের সম্পত্তি ও জিনিসপত্র মুমিনদের লুণ্ঠনে পরিণত হয়েছিল। তৈমুর এবার জাঠদের ভূমি হরিয়ানার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, যাকেই দেখবে তাকেই লুঠপাঠ করে মেরে ফেলতে। তাই সৈন্যরা প্রতিটি গ্রামে লুঠপাট চালায়, প্রচুর মানুষকে হত্যা করে এবং নারী পুরুষ উভয়কে দাসত্বের জন্য বন্দী করে নিয়ে যায়। দিল্লীতে আসার আগে লোনি দখল করে, যা মূলত হিন্দু শহর ছিল। তবে কিছু মুসলিম বাসিন্দাকেও বন্দী করা হয়েছিল। তৈমুর আদেশ দিলেন – মুসুলমান বন্দীদের আলাদা করে বাঁচাতে হবে, কিন্তু কাফেরদের সবাইকে ধর্মান্ধতার তরবারি দিয়ে জাহান্নামে পাঠানো কর্তব্য।

তৈমুরের তখন ১০ লক্ষ হিন্দুকে বন্দী করা হয়ে গিয়েছিল। যমুনা পার হওয়ার পরে তিনি যখন তুঘলক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, তাঁর আমিররা তাকে পরামর্শ দেয় – যুদ্ধের এই মহান দিনে এই ১০,০০,০০০ বন্দীকে বোঝা করে রেখে দেওয়া যাবে না, এটা যুদ্ধের নিয়মের পুরোপুরি বিরোধিতা করা হবে; আবার এই মুশরিক তথা ইসলামের শত্রুদের স্বাধীনতা দেওয়াও সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী; সুতরাং তাদের তরোয়ালের খাদ্য করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। তুজ়ক-ই-তিমুরি আরও বলেছে: “আমি শিবির জুড়ে ঘোষণা করেছিলাম যে কাফের বন্দীদের প্রত্যেককেই মুসলমানদের হত্যা করা উচিত, এবং কেউ যদি এ ব্যাপারে অবহেলা করে, তাকেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া উচিত এবং তার সম্পত্তি চরের হাতে দেওয়া উচিত। এই আদেশটি যখন ইসলামের গাজ়ীদের কাছে জানা গেল, তারা নিজেদের তরোয়াল টেনে তাদের বন্দীদের নির্বিচারে হত্যা করল। এক লক্ষ কাফের তথা অবাধ্য মুশরিকরা সেদিন মারা গিয়েছিল। একজন পরামর্শদাতা ও শিক্ষাবিদ হয়েও মাওলানা নাসিরুদ্দীন উমর, যিনি সারাজীবন কখনও একটি চড়ুইকে পর্যন্ত হত্যা করেন নি, এখন আমার আদেশ কার্যকর করতে গিয়ে তাঁর তরোয়াল দিয়ে তাঁর অধীনস্থ পঞ্চাশজন মুশরিক হিন্দুদের বধ করেছিলেন।”

পরের দিন যুদ্ধে তুঘলক সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল। তৈমুর দিল্লীতে প্রবেশ করে শুনলেন, নিজেদের স্ত্রী, সন্তান এবং তৈজসপত্র ও মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে এক বিশাল সংখ্যক হিন্দু সারা দেশ থেকে এই শহরে এসেছে। তিনি তক্ষুণি তাঁর সৈন্যদের এই হিন্দু এবং তাদের সম্পত্তি দখলের নির্দেশ দিয়ে দিলেন। তুজ়ক-ই-তিমুরি-রুপসংহারে আছে: “তাদের মধ্যে অনেকেই (হিন্দু) তরোয়াল টেনে প্রতিরোধ করেছিল। এইভাবে কলহের শিখা জ্বলল যা জাহানপথ থেকে সিরি পর্যন্ত সারা শহর ছড়িয়ে পড়ে সর্বস্ব ভস্মীভূত করে দেয়। হিন্দুরা স্বহস্তে নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে স্ত্রী সন্তানদের পুড়িয়ে দেয় এবং নিজেরা লড়াইয়ে নেমে মারা যায়। সেদিন, বৃহস্পতিবার ও পরের দিন শুক্রবারের সমস্ত রাতেই প্রায় ১৫,০০০ তুর্কী হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসে লিপ্ত ছিল। শুক্রবার সকালে আমার সমস্ত সেনাবাহিনী শহরে ভেঙে পড়ে হত্যা, লুণ্ঠন ও বন্দী করা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেনি। পরের দিন, ১৭তম দিন শনিবার সকলেই একইভাবে বেরিয়েছিল এবং তাদের লুটপাট এতটাই দুর্দান্ত ছিল যে প্রত্যেক পুরুষই পঞ্চাশ থেকে একশ জন করে নারী, পুরুষ ও শিশি বন্দী হিসাবে জোটাতে পারে। বিশেরও কম বন্দী কারোরই ছিল না। অন্যান্য লুঠের মাল বলতে ছিল চূনী, হীরা, গার্নেটস, মুক্তো ও অন্যান্য রত্ন এবং গহনা; উদযাপিত আলির আশরাফি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্র, এবং ব্রোকেড ও দুর্মূল্য রেশম। হিন্দু মহিলাদের সোনা ও রূপোর গয়না এত সংগৃহীত হয়, যে সমস্ত সম্পদদের হিসাব ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সৈয়দ, উলেমা ও মুসলমান অধিকৃত শহরের এক চতুর্থাংশ ছাড়া সমগ্র শহরটি দখল করে ছারখার করে দেওয়া হয়।

(ক্রমশঃ)