বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও ত্রাণে নেহেরু সরকারের বৈষম্য ও বঞ্চনা

বিধায়ক দাস পুরকায়স্থ

‘সিরিল স্ক্যাল্পেল’-এর একক নিপুণ চালনায় মাতৃভূমি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে ক্ষয়িষ্ণু ঔপনিবেশিক শক্তির চিতার উপর জন্ম নিল দুটি দেশ, ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের ভাগ্যবিধাতা নেতারা একটি ‘খণ্ডিত দেশ’ উপহার দিলেন দেশবাসীকে, যা তাদের দূরতম কষ্টকল্পনাতেও ছিল না। বিভাজনের ফলে একটি বৃহদংশের মানুষ, নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেলেন। বৈষম্যমূলক আচরণ এবং বেআইনি ও বৈরী কার্যকলাপের ফলে পূর্ববঙ্গ ও পাঞ্জাব প্রান্তের হিন্দু এবং শিখ জনজাতিকে তাদের জমি থেকে উপড়ে ফেলে পলায়নে বাধ্য করে। নিশ্চিত পেশা ছেড়ে শুধুমাত্র নিরপত্তার তাগিদে নতুন বাসস্থানের খোঁজে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হন একটি বিশাল অংশের মানুষ। এই মরিয়া উদ্বাস্তু মানুষেরা বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে, আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্বদিকের প্রদেশে চলে আসেন। ঠিক একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশীভূত হওয়া পূর্বতন পাঞ্জাব প্রদেশের মানুষেরা পাঞ্জাব, হরিয়াণা এবং দিল্লী সহ ভারতের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়েন।

উদ্বাস্তুদের স্রোত বাড়তে থাকায় বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী ত্রাণ শিবির তৈরি হয়। তদানীন্তন ভারত সরকার ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসব ঘটনার ফলস্বরূপ “ত্রাণ ও পুনর্বাসন” (Relief & Rehabilitation) নামে একটি নতুন মন্ত্রক তৈরি করে, যার দায়িত্ব বর্তায় শ্রীযুক্ত কে.সি.নিয়োগীর উপর।

এই লেখায় আমি, পূর্ব বাংলা বা তৎকালীন পাকিস্তানের দেশ বিভাজনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থদের বিষয়ে ভারত সরকার এবং স্ব স্ব রাজ্য সরকার কর্তৃক গৃহীত ত্রাণ ও পুনর্বাসন নীতিগুলির আলোচনা করতে চাই এবং একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের তুল্যমূল্য আলোচনা করতে চাই।

 

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেদের মধ্যে বৈষম্য

আনুষ্ঠানিকভাবে দেশভাগের ঘোষণার আগে জনগণের মধ্যে উত্তেজনা, অশান্তি ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। ভয়ে ও যন্ত্রণায় আশ্রয়বিহীন মানুষেরা পশ্চিমবঙ্গের দিকে যাত্রা শুরু করে। শিয়ালদা স্টেশনে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী পৌঁছতে শুরু করে। বেসরকারী সংস্থাগুলির স্বেচ্ছাসেবীরা দুঃস্থ লোকদের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রকারের সহায়তা প্রদান করেন এবং বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে তাঁদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। সরকারের তৈরি করা নীতিগুলি কেবল কাগজেই লেখা ছিল। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সম্পর্কে প্রথম ছয়-সাত বছর ধরে ভারত সরকার রীতিমত অজ্ঞ ছিল। যে সামান্য সহায়তা সরকারিভাবে দেওয়া হয়েছিল, তা অগ্রিম ঋণ আকারে ছিল; অর্থাৎ ভবিষ্যতে তা সুদসহ শোধ করতে হত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসনে বৈষম্যের বিষয়টি আড়াল করতে পুনর্বাসন মন্ত্রকের মিথ্যা প্রচার এই ধারণা তৈরি করতে সফল হয়েছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীরা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের নিজেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সন্তোষজনকভাবে পুনর্বাসিত হতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের দিকে তারা অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন যে এদের ‘উদ্যোগ এবং স্ব-সহায়তার অভাব রয়েছে’, এরা সরকার এবং দেশের (অর্থনীতির) জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (Source: Agony of West Bengal, pp. 59; Ranjit Roy).

কেন্দ্রীয় সরকার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখতে পায়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা ‘ভয়াবহ হিংসার শিকার’, সুতরাং ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বিষয়টি ‘তাৎক্ষণিক ও অতিশীঘ্র’ সম্পন্ন করার কথা বিবেচনা করতে হবে। এই বিষয়ে নেহেরু উল্লেখ করেছিলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের পুনর্বাসনের সমস্যা সর্বদাই একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি বিষয়, এখন এটি নতুন স্পর্শকাতরতা পেয়েছে…। মোটামুটিভাবে উদ্ধারের কাজটি কম-বেশি সম্পন্ন করে, পুনর্বাসনের বিষয়টি এখনই হাতে নেওয়া উচিত, অস্থায়ীভাবে বা অবহেলা করে নয় বরং সুপরিকল্পিতভাবে।”  (Source: Discussion at a Cabinet Meeting, Government of India,dated 10th January 1948; SWJN, Vol 5, P 137).

উপরোক্ত আলোচনা ও তথ্যের ভিত্তিতে এখানে প্রশ্ন ওঠে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের মধ্যে কেন এই ধরনের বৈষম্য?   পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরাও সমানভাবে জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছিল এবং একইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল; তা নেহেরু ও তাঁর মন্ত্রিসভার কি জানা ছিল না?  পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের শরণার্থীরাই ১৯৪৭ সালের বিভাজনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, অবিভক্ত ভারতের বাসিন্দা হিসেবেই। সুতরাং, তারা উভয়ই ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের দাবীদার, সমস্ত চিকিৎসা ও সুবিধার সমান অধিকারী। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীরা নেহেরু সরকারের ‘চোখের মণি’ হয়ে ওঠে, আর পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা বর্তমানকাল পর্যন্ত ভারতের ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’ হয়েই রয়ে যায়।

 

পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকারের প্রভূত প্রকল্প

আমরা দেখছি যে পশ্চিম পাকিস্তানের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের কর্মসূচি শুরু থেকেই সুপরিকল্পিত ও সুসংহতভাবে পরিচালিত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার আদান-প্রদানের কারণে ১৯৪৮ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুচ্যুত মানুষের ক্ষেত্রে তা সংঘটিতই হয়নি। ত্রাণবণ্টন ব্যবস্থা ১৯৫০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল এবং ১৯৫৫ এর শেষদিকে স্থায়ী পুনর্বাসন প্রকল্প প্রায় শেষ হয়ে গেছিল।

সরকার পশ্চিমের মারাত্মক পরিস্থিতিটিকে পুরো ভারতের সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করেছে, কেবল পাঞ্জাবের সমস্যা হিসেবে নয়। সুতরাং, পুরো ভারত এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিল। চিন্তিত নেহেরু মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্তব্য করেছিলেন, “এই সমস্যা মোকাবিলা উদ্দেশ্যে পাঞ্জাব সরকারের সংস্থান যথেষ্ট হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তাই ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলিকেও এগিয়ে এসে সহযোগিতা করতে হবে। মূলত তাই এটি কেন্দ্রীয় দিকনির্দেশ এবং পরিকল্পনার অন্তর্গত বিষয় ছিল। কেন্দ্র প্রকৃতপক্ষে এটির জন্য আংশিক বা প্রায় সম্পূর্ণ অর্থ প্রদান করছিল। পরে দেখা যাবে বলে এই বিষয়টিকে ছেড়ে দেয়নি।” (Source: Cabinet Meeting, GOI, dtd.10th June 1948; SWJN, Vol 5, P 137).

ভারত সরকার ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’-দের পুনর্বাসন (ভূমি অধিগ্রহণ) অধ্যাদেশ ১৯৪৮-এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পরিচালনার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ শব্দটিরই সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। সংজ্ঞাটি সংসদের একটি আইন – বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দাবি আইন, ১৯৫০- এ আরও সংশোধন করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের পূর্ববর্তী সংজ্ঞাটি কেবল ত্রাণ বিতরনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫০ সালের দ্বিতীয় সংজ্ঞার মধ্য দিয়ে তৎকালীন ভারত সরকার বাস্তুচ্যুত ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং তাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্য নিজেদের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিল। পরবর্তী আইনটি কেবলমাত্র পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হিসেবে উল্লিখিত, কারণ তাতেই আলাদা করে পশ্চিম পাকিস্তান হিসাবে উল্লেখ করেছে – এই আইনের ভিত্তিতে, আরেকটি আইন আনা হয়েছিল – The Evacuee Property Act, 1950। এই আইনটি ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’-এর সংজ্ঞাটি পূর্বের মতোই রেখেছে কেবলমাত্র নতুন শ্রেণির ব্যক্তি – the Evacuee; যার অর্থ জনসংখ্যার এক অংশের সঙ্গে অপর একটি অংশের স্থানান্তর বা আদানপ্রদান করা। সরকার ব্যক্তিদের বাস্তুচ্যুত হওয়াকে ‘হিংসার আশঙ্কায়’ স্বীকার করে নিলেও, পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের এর আওতা থেকে দূরে রেখেছে।

নেহেরুর মন্তব্য থেকে সরকারের উদ্দেশ্য সহজেই অনুধাবন করা যায়, ‘আমরা এখানে পূর্ববঙ্গে বিরাজমান নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতির কথা বলেছি….আমি বিশ্বাস করি যদিও এই নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি রয়েছে তবুও আমি আশাবাদী যে এটি কেবলই নিরাশাবাদী চিন্তাভাবনা নয়, এবং আমি মনে করি ধীরে ধীরে এটি কমে আসবে…। কয়েকজন সদস্য মনে করেন যে সেখান থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্য পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে যাবে….আমি অন্তত এমন চিন্তা করার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না….এটি ঘটা রোধ করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব এবং এমন একটিও শব্দ বা দলিল পেশ করব না যা এই প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে উৎসাহ দেবে, কারণ সেই প্রক্রিয়াটিই আমাদের জন্যে ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করবে যার মুখোমুখি হতে হবে হয়ত আমাদেরই। (Source: Debate in the Parliament, dtd. 9th August 1950; SWJN, P 279)

 

নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির তঞ্চকতা

এখন প্রশ্ন হল, নেহেরু সরকার কি পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি ও পরিণতি রোধ করতে সফল হয়েছিল? সংখ্যালঘুদের কি তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নৃশংসতা, অপমান, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, সম্পত্তি দখল এবং অন্যান্য সমস্ত ধরণের হুমকি বা হিংসার ভয় থেকে রক্ষা করেছিল? উত্তরটি হল একটি সপাট না। তারপরে কোন পরিস্থিতিতে সরকার অনুভব করেছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে দেশ বিভাগের ফলে ক্ষতিগ্রস্থরা ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় নিলে তখনই দেশ ‘ভয়াবহ পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হবে; তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের প্রবেশের কারণে কি দেশের এমন মারাত্মক পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখা দেবে না? লজ্জা। শাসকের আচরণ কীভাবে এতটা বৈষম্যমূলক হতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য সাজানো শিবিরগুলির বিশ্লেষণ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, সেগুলি অদূর ভবিষ্যতে স্থায়ী পুনর্বাসনের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়নি। সরকার বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিষ্পত্তি করে হাত ধুয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিল। মূলতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্যই ১৯৫০ সালে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আমি এখন চুক্তির বিশদে যাচ্ছি না তবে অবশ্যই পাঠকদের সাথে অন্য কোন বিস্তারিত লেখার সময়ে ভাগ করে নিতে চাই যে এটি পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের কোনও উপকারেই আসে নি, কেবল জনগণকে বোকা বানানোর উদ্দেশ্যেই এটি সফল হয়।

ভারত সরকার ১৯৪৯ সালের ৩১শে অক্টোবর পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের শিবির বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন মন্ত্রককে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, “কেবলমাত্র রাজ্য এবং অন্যান্য সরকারকে অবহিত করাই যথেষ্ট নয় আপনারা এই নিখরচায় খাওয়ানো বন্ধ করতে যাচ্ছেন। আপনাদেরকে কাজের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্পের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনাদের পরিকল্পনাটি কতদূর সফল হচ্ছে তার জন্যেও অতি অবশ্যই নিবিড় ও নির্ভুল পরিকল্পনা এবং পরীক্ষা করতে হবে’’।
(Source: Letter of Nehru to the Rehabilitation Minister, Mohanlal Saxena, dtd.10th July 1949; SWJN, Vol 12, P 121)

পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সম্পত্তির উপর অধিকার রয়েছে, এই অজুহাতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি এবং তাই ভারতেও তারা সেই ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেননি। (File of Ayyanagar to Nehru, dtd.24th July 1950, S.No.23, NMMI)
কিন্তু বাস্তবে এই ঘটনাগুলি এইভাবে ঘটেনি। বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তান শরণার্থীদের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার জন্য সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণই দেওয়া হয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য, সরকারি ব্যয়ে প্রচুর শিল্প এস্টেট তৈরি করা হয়েছিল। তাদেরকে কাঁচামাল, আমদানি করা মেশিনারিগুলির জন্য বৈদেশিক মুদ্রাও দেওয়া হয়েছিল। তারা পাকিস্তান ব্যাংকগুলিতে তাদের যে অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন তার ব্যবস্থা করা, জীবন বীমা পলিসির সুবিধা, প্রভিডেন্ট ফান্ড তহবিল এবং কোম্পানির শেয়ারের সুবিধাগুলিও পেয়েছিলেন। দেশ বিভাগের পরপরই সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের ব্যবস্থা হয়েছিল, যার প্রায় পুরোটাই পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশে সীমাবদ্ধ ছিল। (The Agony of West Bengal, P 58; Ranjit Roy).

 

ভারত সরকারের পরিসংখ্যান

১৯৫১-৫২ সালের হিসেব দিতে গিয়ে পুনর্বাসন মন্ত্রকের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৭.৪০ লক্ষ শরণার্থীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, দিল্লিতে ৫.০১ লক্ষ, উত্তর প্রদেশে ৪.৮০ লক্ষ, মুম্বাইতে ৪.২৫ লক্ষ, গুজরাত, রাজস্থানে ৩.৭৩ লক্ষ, মধ্য প্রদেশে ২.০৯ লক্ষর জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলির সমস্তই ভারত সরকার দ্বারা নিজের খরচে নির্মিত, নির্বাসিত মুসলমানদের দোকান বাজারের জমি এবং বাড়িগুলিতেই ক্ষতিগ্রস্ত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিল এবং তাদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে এগুলি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানপন্থী মুসলমানরা অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা, তামিলনাড়ু, মহীশূর, বিহার, উড়িষ্যা এবং হিমাচল প্রদেশে যথেষ্ট জমি, ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে চলে গেছেন। এগুলি পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। একমাত্র পাঞ্জাবেই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের ৬০ লক্ষ একর কৃষি জমি এবং ৭ লক্ষ গ্রাম্য-বাড়ি উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। যেখানে পূর্ব পাকিস্তান শরণার্থীদের কোনও রূপে কোনও ক্ষতিপূরণই দেওয়া হয়নি। ১৯৬৯ থেকে ৭০ সালের মেয়াদে উক্ত মন্ত্রকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, প্রদত্ত সমস্ত ক্ষতিপূরণ বাদেও সরকার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। দিল্লি একাই পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য ৬০ কোটি প্রকল্প সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ২.০২ লক্ষ শরণার্থী বিভিন্ন জব এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কর্মসংস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ৯২ হাজার উদ্বাস্তুকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, ১১ হাজারকে সরকারি প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, ১৯৬৪-৬৫-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের ১০,৫৭১ জন শরণার্থী বিভিন্ন কর্মসংস্থান বিনিময় ক্ষেত্রে নিজেদের নিবন্ধন করেছেন, এর মধ্যে মাত্র ২০৪ জন চাকরি পেতে সক্ষম হন। (Source: The Agony of West Bengal, Ranjit Roy)

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসন ইস্যুতে নেহেরু সরকার উদাসীন মনোভাব দেখিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ যথেষ্ট উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে শুরু হয়েছিল। এমনকি স্থানীয় জনগণ এবং মানুষও তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সম্ভবত দেশটির তৎকালীন জাতীয়স্তরের নেতাদের পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে যোগাযোগ ছিল, যেহেতু দেশভাগের আগে এটি অখণ্ড ভারতের একটি অংশ ছিল। এই নেতারা সরকারী নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে সবরকমভাবে সচেষ্ট ছিলেন যার কারণে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশভাগের শিকার হয়ে ভারতে আসা উদ্বাস্তুরা ভারতের ‘প্রথম শ্রেণির নাগরিক’ হিসাবে ভারতীয় সমাজের মূল স্রোতে অতি সহজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তানে যারা দেশভাগের শিকার হয়েছিলেন অর্থাৎ প্রধানত হিন্দু বাঙালিদের সরকারে এক বা দু’জন নেতা ছিলেন। এই নেতাদের আর্তি ও পরামর্শগুলি কেন্দ্রীয় সরকার ‘বধির কানে’ কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। তারা অসহায় ও নীরব দর্শক হিসেবে প্রতিভাত হন। নেহেরুর অধীনে তৎকালীন কংগ্রেসের নেতারাও বাংলার নেতাদের প্রতি অতিবিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিল যে বাঙালি নেতারা অসামান্য বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয়তাবাদের চেতনা সম্পন্ন সর্বশক্তিমান ব্যক্তিত্ব, যদি তাঁদের সুযোগ দেওয়া হয় তবে তারা দেশের সত্যিকারের যোগ্য নেতা হিসাবে জায়গা করে নেবে। এটি সমস্ত উপায়ে বন্ধ করা উচিত, অন্যথায় কংগ্রেস নেতাদের একটি অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যার জন্য তারা এই ভূভাগটি দুটি দেশে বিভক্ত করেছে, সেগুলি অসম্পূর্ণ হয়ে থেকে যাবে। তারা শক্তিশালী নেতৃত্বের দ্বারা দেশের বাঙ্গালি সম্প্রদায়কে সংগঠিত হতে দেয়নি, নেতৃত্বের সংকট তৈরি করেছিল।

কংগ্রেস নেতারা ভারতে ‘‘Cluster politics’’ প্রথাটিকে উৎসাহিত করেছিলেন। বাঙালিদের কংগ্রেস পার্টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মত শক্তিশালী হতে দেওয়া উচিত নয়, বরং এর প্রতি তাদের অনুগত থাকতে হবে – এই ছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের মনোভাব। নেহেরু এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছে, ব্রিটিশ রাজশক্তি দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে কংগ্রেসই একমাত্র দল হবে যার কোনো বিকল্প নেই এবং বিরোধীতা নেই। এইভাবে তারা বাঙালি হিন্দুদের এবং পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদেরকে নিজস্বার্থে ব্যবহার করেছে ও দেশ বিভাগ বাঙালি হিন্দুকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। তবে পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। পাঞ্জাব যেহেতু দিল্লির খুব কাছাকাছি ছিল এবং দেশের বিভিন্ন বিভাগগুলি মূলত সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হত; সুতরাং সেই অঞ্চলের স্নায়ু বোঝা খুব প্রয়োজন ছিল। যদি এই সম্প্রদায়টি তার অসন্তুষ্টি এবং বিদ্রোহ প্রকাশ করে তবে সরকার বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারে ও কংগ্রেস নেতারা এর পরিণতিটি কাটিয়ে উঠতে পারে না। সুতরাং, যে কোনও মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই দেশের অংশীভূত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল।

সরকার কর্তৃক পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গা ক্ষতিগ্রস্থদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে একটি জনগোষ্ঠী যেমন সুষ্ঠুভাবে বসতি স্থাপন করেছে, ভূস্বামী, অধিপতি রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব কায়েম করেছে; বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের সিংহ ভাগকে তাদের বেঁচে থাকার ও অস্তিত্বের জন্য লড়াই করতে গিয়ে কেউ মজুরি উপার্জনকারী, কাউকে কায়িক শ্রমের কাজে আবার কাউকে ভূমি শ্রমিকে রূপান্তরিত করে। এমনকি এই সম্প্রদায়ের একটি ভাল অংশ এখনও ‘বিদেশী’, ‘হিন্দু বাংলাদেশী’ হিসাবে বিবেচিত, তাদের পিছনে ‘সন্দেহজনক বিদেশিদের তকমা’, ‘সনাক্ত ও আটককরণ’ এবং ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে নির্বাসিত’ হিসাবে কাজ করে যেতে হয়; যেখানে তাদের আবারও সামাজিক ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পূর্ববাংলা / পাকিস্তানের বিভাজন ক্ষতিগ্রস্থদের বিরুদ্ধে এই অবিরাম অমানবিক কর্মকাণ্ড, নির্যাতন ও অবিচারের অবসান ঘটাতে বর্তমান সরকারের উচিত তাদের পূর্বসূরিদের ভুল নীতিগুলি চিহ্নিত করা এবং ‘রাজনৈতিক ভুলত্রুটি’ সংশোধন করে ভবিষ্যতের স্বার্থে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উচিত পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত-দমন-বঞ্চিত পার্টিশনের শিকার মানুষের স্বার্থ সুনিশ্চিত করা। তাদের সম্মানজনক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেশের মূল স্রোতে নিয়ে আসা উচিত যেখানে জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য সম্মান ও সহানুভূতি রয়েছে; তাতেই দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন।

মূল লেখাটি স্বতন্ত্র পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন সোমদীপ ভট্টাচার্য। লেখকের মতামতের জন্য বঙ্গদেশ পত্রিকা দায়ী নয়।