বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

১৭ তম পর্বের পর

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

মাতৃভাষা দিবস

১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রথম বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় বলা চলে। পরের বছর ঢাকাতেই ১৯৫২-তে দিনটিকে পালন করা হয় শহীদ দিবস হিসাবে। ১৯৫৬-তে পরাধীন বাংলায় প্রথম সরকারি সমর্থনে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। তারপর স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২-এ ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদ্‌যাপিত হয়। ১৯৫৩-য় আবদুল গফফর রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে প্রথম সুরারোপ করেছিলেন আব্দুল লতিফ। পরে ১৯৫৪-য় আলতাফ মাহমুদ পুনরায় সুর দেন, যে সুরে এটি এখনও পর্যন্ত প্রভাতফেরির গান হয়ে গেছে।

ঐ তারিখটির আন্তর্জাতিক মর্যাদার দাবিদারও স্বাধীন বাংলাদেশের গফরগাঁও। ১৯৯৮ সালের ২১শে মার্চ কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আন্নানের কাছে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”-এর দাবিতে এক পত্র লেখেন। ঐ পত্র সাক্ষর করেন সাতটি জাতি ও ভাষার দশজন সদস্য। এলবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল (ফিলিপিনো), জাসেন মোরিন ও সুজ়ান হডগিন্স (Suzan Hodgins) (ইংরেজি), ডঃ কেলভিন চাও (ক্যান্টনিজ়), নাজনীন ইসলাম (কাচি), রিনাতে মার্টিন্‌স (জার্মান), করুণা যোগী (হিন্দী) এবং রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম (বাংলা)। ১৯৯৯-এর ৩রা মার্চ ইউনেস্কোর সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের সচিব আন্না মারিয়া মাজ়লোফ (Anna Maria Mazlof) রফিকুলকে লেখেন “Regarding your request to declare the 21st February as International Mother Language Day, the idea is indeed very interesting.”
কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে বিষয়টি উত্থাপনের কোনও সুযোগ নেই, ইউনেস্কোর পরিচালক কোনও সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে উত্থাপন করতে হবে। পরে প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিনিধি দলের নেতা ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের মাহাত্ম ১৮০টি দেশের সামনে তুলে ধরেন, বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে ২১শে ফেব্রুয়ারি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হসাবে স্বীকৃতি লাভ করল বলতে গেলে বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায়। বিষয়টির প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরব; আর সমর্থক ছিল ভারত, ওমান, বেনিন, হন্ডুরাস, শ্রীলঙ্কা, মিশর, রাশিয়া, বাহমাস, ডোমিনিয়ন রিপাবলিক অব বেলারুশ, ফিলিপিনস্, আইভরি কোস্ট, গাম্বিয়া, সাইক্লোনেসিয়া, ভেনেজ়ুয়ালা, ইন্দোনেশিয়া, ইটালি, পাপুয়া নিউগিনি, কমোরস, ইরান, লিথুয়ানিয়া, সিরিয়া এমনকি পাকিস্তান।
ঢাকায় স্থাপিত সাভার বা শহিদ-স্মৃতিস্তম্ভ সশ্রদ্ধায় স্মরণ করিয়ে দেয় ২১শে ও ২২শে পুলিসি হামলায় নিহতদের। শহিদের তালিকায় হিন্দু নাম দুষ্প্রাপ্য হলেও হিন্দু বাঙালীর অবদান ছিল না, সেটা শুধু কষ্ট কল্পিত নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত বা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দের নাম মাতৃভাষা দিবসে স্মরণ করতে শোনা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের তুলনামূলক পরিসংখ্যান তো অন্য কথা বলে। তাছাড়া হিন্দুস্তানকেই নিতে হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা উভয় সম্প্রদায় মানুষের বাড়তি চাপ। পশ্চিমবঙ্গে ভাষা আন্দোলনকারীদের আস্তানাও ছিল, বিপন্নদের জন্য আশ্রয়ও ছিল, জনমানসে সমর্থনও ছিল। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের উন্মাদনা আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে।
অথচ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শামিল হওয়া তো বটেই, ভারতবর্ষের মতো বহুভাষাভাষীর দেশের পক্ষে আভ্যন্তরীণ কারণে ভাষার প্রশ্নে নৈতিক সমর্থন জানানোও যথেষ্ট কঠিন; কারণ বিশাল ভূখণ্ডে সংহতির পথে অন্যতম অন্তরায় নানাবিধ ভাষাগোষ্ঠী এবং সেগুলো অধিকাংশ যথেষ্ট উন্নত ও বলিষ্ঠ। যেখানে “ইন্তি ওড়িকা, তামিল বাড়কা” অর্থাৎ ‘হিন্দী নিপাত যাক, তামিল দীর্ঘজীবী হোক’ বলে তীব্র আবেগে নিজের দেহে অগ্নিসংযোগ করে আত্মাহূতি দেয় ভারতীয় যুবক, সেখানে কোথাও মাতৃভাষার দাবিকে স্বীকৃত জানানো মানে নিজের প্রাদেশিক হিন্দীর সঙ্গে ভাষাগুলির সংঘাতকে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলা।
অন্যদিকে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পেছনে বাঙালীর অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশি। নেতাজীর হিন্দীপ্রীতির কথা তো সুবিদিত। ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতবাসীকে উদ্দীপিত করার জন্য তিনি হিন্দী ও উর্দুতেই স্লোগান দিতেন। রাসবিহারী বসু প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (INA)-এর প্রাথমিক দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহন সিং। সুভাস বসু নেতৃত্ব গ্রহণের পর ‘আজ়াদ হিন্দ ফৌজ’ নামটাই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি হিন্দীর হয়েই সওয়াল করেন। তার বহু আগে রামমোহন রায়ও হিন্দীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে ছিল একাধিক হিন্দী পুস্তক যেগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে প্রথম হিন্দী মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সরস্বতী’-র জন্মদাতা ‘ইন্ডিয়ান প্রেস’-এর অধিকর্তা চিন্তামণি ঘোষ। পরে ১৯০৩ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত সম্পাদনা করেন মহাবীর প্রসাদ দ্বিবেদী। মূলত খড়িবোলী উপভাষার হিন্দী মান্য হিন্দীর মর্যাদা পেয়ে যায় এক বাঙালীর হাত ধরে।

শুধু তাই নয়, জাতীয় সংহতির কথা ভেবে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষাভাষী বাঙালীরা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ভোটাভুটিতে হিন্দীকে সমর্থন করায় সংসদে মাত্র এক ভোটে জয়ী হয় হিন্দীর দাবি। এহেন বাঙালীর হিন্দীর আধিপত্যে বাংলা সংস্কৃতিকে আক্রান্ত হতে দেখলে বুকে তো একটু বাজবেই – এটা তো স্বাভাবিক। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাজাতিক স্বীকৃতির মধ্যে এপারের বাঙালীরাও গর্বিত বোধ করে। গর্ববোধ শুধু ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরির জন্য যে ত্যাগস্বীকার, রক্তক্ষয় ও অর্থনৈতিক সংকট ভোগ করতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতবর্ষকেই, তাতে এই সাফল্যে গর্বিত হওয়ার ন্যায়সঙ্গত অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে। তাছাড়া বাংলার মতো উন্নত ভাষা মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা বা বহির্ভারতে যোগাযোগের আশ্যিক মাধ্যম হিসাবে মেনে নেওয়ার মধ্যে যদি কোনও চাপা অসন্তোষ থেকে থাকে, বাংলাভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তাতে অনেকটাই উপশম। কিন্তু পররাষ্ট্রের প্রতি এই একাত্মবোধই প্রায়শ আমাদের জাতীয়তাবোধকেও বিভ্রান্ত করে ফেলে। অদৃষ্টের অভিলাষে এই দ্বন্দ্ব, এই যন্ত্রণা শুধু ভারতীয় বাঙালীদের, যারা জাতিগত পরিচয়ে বাঙালী হলেও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে ‘হিন্দুস্তানী’, দেশভাগের চরম মূল্য দিয়েও যাদের শাস্তির মেয়াদ উত্তীণ হয়নি, একদিকে সীমান্ত অনুপ্রবেশে জর্জরিত থেকে যায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি, অন্যদিকে প্রাদেশিকতার বলি হতেই থাকে। যে মাতৃবন্দনার জন্য এত রক্তপাত, সন্তানের আরও কত রক্তপাতে তিনি তৃপ্ত হবেন তার উত্তর অনন্তের গর্ভে।