তিতুমীর এবং তবলীগ জামাতঃ এক নিগূঢ় সম্পর্কের খোঁজ

0
4256
তিতুমীর ও বাঁশের কেল্লা

তবলীগী জামাত বর্তমান সময়ে সমগ্র ভারত জুড়ে একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ প্রসঙ্গে। কিন্তু এই সমগ্র বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা আন্দোলন শুধুমাত্র এই ক্ষুদ্র প্রেক্ষিতে বিচার করলে বিচার করলে তা আমাদের একটি বড় ভ্রান্তি হিসাবেই ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। তবলীগী জামাতের ইতিহাস বিচার করলে দেখা যাবে যে বর্তমান সংগঠনটি ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও, এর আদর্শ অত্যন্ত প্রাচীন। মাওলানা মহম্মদ ইলিয়াস আদপে একটি ধারার বাহক যা বারে বারে এসেছে ইসলামিক সমাজে, বিভিন্ন দেশে। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হত্যা এবং শুদ্ধি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট সংগঠনটি মেওয়াতের মিও-মুসলমানদের ইসলামের মুল ধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন কোন অভিনব ঘটনা। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলা, তথা ভারতের বুকে এমন বিভিন্ন তবলীগী আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বস্তুত তবলীগী জামাতের অর্থ ইসলামে আমন্ত্রণকারী দল। দাওয়াত ইসলামের ছয়টি প্রধান আদর্শের একটি। তবলীগী জামাত ইসলামের প্রচার এবং ইসলামের সূচনার সময় যেভাবে ইসলাম পালিত হত সেই পথে সমস্ত মুসলমানকে ফেরানোর লক্ষ্যে সর্বদাই অবিচল।

বঙ্গদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি আন্দোলন হল হাজী শরিয়তুল্লাহের ফরায়েজী আন্দোলন, এবং মীর নিসার আলির ওয়াহাবী আন্দোলন।এর মধ্যে ফরায়েজী আন্দোলন মোটের উপর মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে, এবং সাথে করে নিয়ে গিয়েছে হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং তার পুত্র দুদু মিয়াঁর কথা। তিতুমীরের ওয়াহাবী আন্দোলনের কথাও আজ চলে গিয়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে, কিন্তু তিতুমীর আজও থেকে গিয়েছে একটি পরিচিত নাম। বস্তুত তার আন্দোলন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান না থাকার দরুন অনেকের কাছে তিতুমীর হয়ে উঠেছে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। এ শুধু সত্যের অপলাপ নয়, বরং একটি প্রহসন।

 

ওয়াহাবী আন্দোলন ও সৈয়দ আহমেদ বারেলভি

তিতুমীর কথা জানার আগে আমাদের শুরু করতে হয় ওয়াহাবী আন্দোলনের জনক আব্দুল ওয়াহাব, এবং তিতুমীরের দীক্ষাগুরু সৈয়দ আহমেদ বারেলভির কথা দিয়ে। আব্দুল ওয়াহাব জন্মগ্রহণ করেন আরবের নাজদ অঞ্চলের উয়ায়না শহরে, অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। মক্কা, বাগদাদ এবং বাসরার ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্রে ইসলামিক শিক্ষালাভের পরে হজ্জ্ব করেন তিনি। তারপর মদিনায় এসে তিনি ফের ইসলামের শিক্ষা নেন আব্দুল্লাহ ইবনে ইব্রাহিমের কাছে। সেইখানে তিনি ইসলামের মূল নীতিতে ফেরার তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করেন, নিজের শহর উয়ায়নায় ফিরে এসে। মহম্মদের সময়ে ইসলাম যেভাবে পালিত হত তার থেকে মুসলমানরা অনেক জায়গাতেই দূরে সরে এসেছিল। বিশুদ্ধ ইসলামের মূল আদর্শে ফেরা এবং সমস্ত রকমের শিরক এবং বেদআত করে ধ্বংস করাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। প্রথমে উয়ায়নার শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও পরে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়, এবং ওয়াহাবকে উয়ায়না ছাড়তে হয়। তিনি আশ্রয় নিলেন ডিরিয়াতে, ইবনে সৌদের কাছে। ইবনে সৌদ ওয়াহাবের কন্যাকে বিবাহ করেন, এবং ওয়াহাবীবাদ প্রচারের দায়িত্ব তুলে নেন। এর মাধ্যমেই হয় প্রথম সৌদি রাজত্বের স্থাপনা, যা পরিচিত ডিরিয়ার এমিরাতি হিসাবে। বর্তমানে ওয়াহাবী ইসলামের প্রভাব সমস্ত পৃথিবীতেই পরিদৃশ্যমান, এবং স্বাভাবিকভাবে ভারত তার ব্যতিক্রম নয়।

তিতুমীরের প্রসঙ্গে বলতে গেলে, সৈয়দ আহমেদ বারেলভির কথা দিয়েই উপক্রমণিকা করতে হয়। রাইবারেলি ভারতে বর্তমানে পরিচিত উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস দলের গড় হিসাবে। এককালে ইন্দিরা গান্ধী, এবং বর্তমানে সোনিয়া গান্ধী এই অঞ্চলের সাংসদ। তবে একই সাথে এই অঞ্চল হল সৈয়দ আহমেদ বারেলভির জন্মস্থান। সৈয়দ আহমেদ বারেলভি ভারতে ইসলামের ইতিহাসে একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, যাকে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনের জনকও বলে। এর কারণ মূলত সৈয়দের বিশুদ্ধ ইসলামে ফেরার তাগিদ থেকেই। তাঁর তত্ত্ব এবং আন্দোলনের নাম হল তরিকা-ই-মহম্মদিয়া। স্বাভাবিকভাবেই, ভারতের প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনের রূপ ওয়াহাবী আন্দোলনের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। ভারতে অসংখ্য মুসলমানের বাস ছিল যারা কোন সময়ে বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেও আদপে জীবনযাত্রায় ছিল অনেকাংশেই হিন্দু। মূলত এদের ইসলামের মূল স্রোতে নিয়ে আসাই লক্ষ্য ছিল এই তরিকা-ই-মহম্মদিয়ার।

উলটোদিকে ওয়াহাবী আন্দোলন ছিল ইসলামে ঢুকে পড়া বিভিন্ন অন-ইসলামি পদ্ধতিকে বর্জন করার। মূলত এই শুদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেই এক করে দেখা হয়েছে আন্দোলন দুটিকে। এছাড়া সৈয়দ ছিল ভারতের অন্যতম প্রথম মুসলিম নেতা যে একই সাথে সামরিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় একটি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সৈয়দ ব্যক্তিগত জীবনেও এই প্রত্যেকটি পথেই নিজে অংশগ্রহণ করেছিল, যার সূচনা হয় তার যৌবনেই। দিল্লীর মাদ্রাসা রহমানিয়াতে শাহ আবদুল আজিজের তত্ত্বাবধানে ইসলামচর্চার পর সে ভবিষ্যতে টঙ্কের নবাব আমির খাঁয়ের লুটেরা বাহিনীর অংশ ছিল। তার লক্ষ্য ছিল ভারতকে পুনরায় দারুল-ইসলামে পরিণত করা, যা ইতিমধ্যে ইংরেজ শাসনের কারণে হয়ে উঠেছিল দারুল-হারব।

সৈয়দ সৈন্যবাহিনীর মধ্যেই তত্ত্বপ্রচার শুরু করে দেয়। পরবর্তীতে আমির খাঁ নিজের সৈন্যবাহিনী তামাদি করে দিলে সৈয়দ আহমেদ তার লক্ষ্য অবিচল থেকে অন্য পথ ধরে। সে প্রথম নেতা এবং উলেমাদের বদলে তার তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করে সাধারণ মুসলমানের মধ্যে, যা সে সময়ে ভারতে ছিল অভিনব। ভারতের বিস্তৃত অংশে ভ্রমণ করে সে তার তত্ত্বের প্রচার করতে থাকে। সেইভাবেই সে এক সময় কলকাতায় আসে, এবং তিতুমীরকে নিজের শিষ্য হিসাবে পায়। এই ভাবেই জ্বেহাদের পথে আগমন ঘটে মীর নিসার আলী, বা তিতুমীরের। সৈয়দ পরবর্তীতে মক্কাতে  ওমরাহ করে ফিরে এসে জ্বেহাদ ঘোষণা করে পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংয়ের রাজত্বের উপর। জয় পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সে অনেক অনুগামী পায়, তবে শেষ পর্যন্ত বালাকোটের যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করে ইসলামী ভাষায় শহীদ হতে হয় তাকে। তবে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় দেখলেই আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায় তার অনুগামী তিতুমীরের সাথে।

 

তিতুমীরের কীর্তিকলাপ

তিতুমীরের জীবন শুরু হয় উত্তর ২৪ পরগনায়, বর্তমান বাদুরিয়া অঞ্চলে, হায়দারপুর গ্রামে। তার জন্মের ২৫ বছর আগেই শেষ হয়েছিল বাংলায় নবাবদের রাজত্ব। বাংলায় বসবাসকারী মুসলমানদের মনে সেই ক্ষোভ তখনো রয়েছে পুরোমাত্রায়। তিতুও সেই আগুনে কিছুটা তপ্ত ছিল। বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় পারদর্শী, এবং কোরআনের হাফেজ হওয়া ছাড়াও তিতু লাঠিখেলা এবং কুস্তিতে হয়ে উঠেছিল পারদর্শী। প্রথম জীবনে কুস্তি এবং পরবর্তীতে লাঠিয়ালের কাজ করা তিতু দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে কারাবাস করে এরপর কিছুদিন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তার কলকাতায় আসা এবং সৈয়দ আহমেদ বারেলভির সাথে পরিচয়। সেই থেকেই সূচনা হয় তরিকা-ই-মহম্মদিয়া’তে তিতুমীরের যাত্রাপথের। সৈয়দের সাথেই হজ্ব করতে যায় তিতুমীর, এবং সেখান থেকে ফিরে আসার পরেই শুরু হয় তার জ্বেহাদ-যাত্রা।

বাংলায় অনেক মুসলমানের বাস থাকলেও তারা আদপে এক মিশ্র-সংস্কৃতির জীবনযাপন করত। তাদের নামের ধারাও হিন্দুদের থেকে খুব বেশি পৃথক ছিল না। আরবি ভাষার জ্ঞান না থাকার কারণে তারা কেবল নমাজ আদায় ছাড়া আর কোন রীতিনীতির সাথে পরিচিত ছিল না। বহু হিন্দু দেবদেবীর পূজাও তারা করত, এবং হিন্দু সংস্কৃতির বহু ছাপ তাদের জীবনে ছিল। বর্তমানে বহুল পরিলক্ষিত সুন্নতি দাড়ি তাদের মুখে শোভা পেত না, এবং তাদের পরিধেয় বস্ত্র ছিল অন্য সকলের মতই ধুতি। তিতুর সংগ্রাম শুরু হয় এই সমস্ত শিরক এবং বেদআতের বিরুদ্ধেই।

তিতুর মূল কর্মস্থল হল নারিকেলবেড়িয়া নামের একটি গ্রাম। তিতু সে অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে তার মত প্রচার করার চেষ্টা করতে লাগল। তার দলের অংশীদারদের বাহ্যিক পরিচয় হল তাদের কাছা খোলা কাপড়, সুন্নতি দাড়ি ইত্যাদি। তিতুর দলের লোক অন্যান্য মুসলমানদের উপর তাদের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকায় অনেকে সে নিয়ে বিরক্ত হয়ে অভিযোগ জানাল জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের কাছে। জমিদার প্রতিকার বিধানে তিতুমীরের দলের জ্বেহাদিদের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণার্থে দাড়ির উপর কর ধার্য করলেন। বলে রাখা ভাল, সে অঞ্চলে তিতুর দলভুক্ত ছাড়া অন্যান্য মুসলমানরা দাড়ি রাখত না। তাই তিতুর দল ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত ভাবেই নেয়। কৃষ্ণদেব রায় পুঁড়া গ্রামে সহজেই এই কর আদায় করতে সক্ষম হলেও বাধ সাধল সরফরাজপুর। প্রথমে কিছু পেয়াদাকে পাঠান কৃষ্ণদেব, কিন্তু তিতুর দলের লোক তাদের উত্তম-মধ্যম দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এর জবাবে তিনশত লাঠিয়াল পাঠান কৃষ্ণদেব রায়, এবং এক ভয়াবহ হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়। পলায়ন করতে বাধ্য হয় তিতুর দল। এর বিরুদ্ধে কাছারিতে গেলে দারোগা রামরাম চক্রবর্তী পক্ষ নেন কৃষ্ণদেব রায়ের। সেই থেকে এই দুই ব্যক্তি তিতুমীরের শত্রুদের তালিকায় উঠে আসে একদম প্রথম দিকে।

তিতুর দল ভারে এবং বহরে ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং তিতুও তার জ্বেহাদের পরিকল্পনায় ক্রমেই আরো উন্মত্ত হয়ে উঠতে থাকে। কৃষ্ণদেব রায় তিতুর অন্যতম শত্রু হওয়ার কারণে তিতুর আক্রমণের লক্ষ্য হন তিনি। কার্ত্তিক পূর্ণিমায় তাঁর গ্রাম পুঁড়া আক্রমণ করে তিতুর দলবল। মূল জমিদার ফটক আটকে দিতে সমর্থ হলেও তিতুর দল গ্রামের অন্যান্য জায়গা আক্রান্ত হয়। বারোয়ারিতলায় মহেশচন্দ্র ঘোষের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া গরুর হত্যাপূর্বক তিতু সেখানে পূজারত ব্রাহ্মণকেও হত্যা করে। পরেরদিন তিতুর দলবল আক্রমণ করে লাউঘাটি বাজার। সেখানে অবশ্য একপেশে জয় পায়নি তিতুমীরের দল। তবে জমিদার পুত্র দেবনাথ রায় মৃত্যুবরণ করেন সেই যুদ্ধে।

ক্রমেই পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে তিতুর দল, এবং যত্র তত্র হিন্দুদের উপর অত্যাচার ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। গোহত্যা, হিন্দুদের জোর করে গো-মাংস ভক্ষণ করিয়ে ইসলামে দীক্ষা দেওয়া, অথবা হত্যা, এবং হিন্দু নারীদের ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে মুসলমানদের সঙ্গে নিকাহ করানো, কোন কিছুই বাদ থাকে না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরাই নয়, অন্যান্য জাতির হিন্দুরাও তার হাত থেকে রেহাই পেল না। জিজিয়া কর আদায় করতে থাকে তিতু, এবং অনেক হিন্দু জমিদার বাধ্য হয় সেই কর দিতে। যে মুসলমানরা তিতুর মতাদর্শ গ্রহণ করল না তাদের প্রতিও সম আচরণ করতে থাকল তিতুর দল।

তিতুর দলের কার্যকলাপে চিন্তিত ব্রিটিশ রাজ অন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারাও আঁচ করতে পারেনি তিতুর প্রকৃত শক্তি এবং বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত। বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আক্রমণ করতে যান তিতুকে, কিছুটা তাচ্ছিল্য সহকারেই। সেই আক্রমণে তিনি একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে প্রাণরক্ষা করেন কোনমতে। কিন্তু এইবার তিতুর হাতে পড়ে তার আরেক প্রধান শত্রু রামরাম চক্রবর্তী। তিতু তাঁকে জ্বেহাদের আদর্শে আসার সুযোগ দেয় ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু রামরামবাবু তা অস্বীকার করায় তিতুর সহযোগী গোলাম মাসুম তাঁকে হত্যা করে তখনই। এরপর তিতুর আক্রমণের লক্ষ্য হয় নীলকুঠিগুলি, এবং সেখানে বসবাসকারী সাহেবরা। সেই সমরেও জয়লাভ করে তিতু হয়ে ওঠে প্রবল পরাক্রমশালী। তবে তার শেষ নেমে এল অল্পদিনেই, সেই আলেকজান্ডারের হাতে, নিজের বাঁশের কেল্লাতেই। সেবার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে কোন রকম ঝুঁকি না নিয়ে আলেকজান্ডার সাহেব আসেন সম্মুখসমরে। কামান এবং গোলার সামনে পেরে ওঠে না তিতুর বাহিনী, এবং অচিরেই তার ও তার বাঁশের কেল্লার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

 

তিতুমীরের মূল্যায়ন: মার্ক্স বনাম মার্ক্সবাদী

বস্তুত এই যুদ্ধে তিতুর মৃত্যু হলেও, নিজের আদর্শ অনুযায়ী তিতু পায় শহীদের মর্যাদা। জ্বেহাদের আদর্শের প্রতি অবিচল থাকে সে। গাজী না হতে পারলেও শাহাদা বরণে সক্ষম হয় সে। বরেলভির তরিকা-ই-মহম্মদিয়ার সৈনিক তিতু তার গুরুর পথেই চলে দ্বীনের একজন সিপাহসালার হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেয়। তিতু এর মাধ্যমে বাংলার ইসলামিক সমাজে মর্যাদার স্থান পায়। শরীয়তী ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এভাবেই শক্ত মাটি পায়, এবং চিরতরে শেষ হয়ে যায় বাংলার প্রাক্তন সংস্কৃতি।

ওয়াহাবী মতবাদীদের মধ্যে, বা বৃহত্তর পরিসরে শরিয়তপন্থীদের মধ্যে তিতুর জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক। কিন্তু যা আশ্চর্যজনক তা হল তাকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী আখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা। কার্ল মার্ক্স তাঁর নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিতে (পৃষ্ঠা ১২৯) তিতুমীরকে মুসলিম উগ্রবাদী আখ্যা দিলেও, তাঁর আদর্শে চলা ইতিহাসবিদদের চোখে কেন যেন তিতুর রূপ বদলে যায়।

গৌতম ভদ্র এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের ভ্রাতা অতীশ দাশগুপ্ত তিতুর পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুইজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিতুর ওয়াহাবী সত্ত্বার কথা, এবং শরীয়তী শাসনের লক্ষ্যের কথা লিখেও কেমন করে যেন তিতুর বিদ্রোহকে দেখেন অন্য চোখে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষাপর্ষদের ইতিহাস ও পরিবেশ গ্রন্থে তিতুর নানা কীর্তিকলাপের কথা লেখা থাকায় সে নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে ২০১৭ সালে। স্বাভাবিকভাবে কেবল বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং নেতারা নন,  তৃণমূল সরকারও দাঁড়ায় তিতুমীরের পক্ষেই, এবং বিশ্বজিত বাগ রচিত এই অধ্যায়টি বাদ যায় মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে। উল্লেখ্য যে এই সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়ান। এছাড়া বারাসাতের একটি বাস স্ট্যান্ড, এবং কলকাতা পাতাল রেলের একটি স্টেশন তিতুমীরের নামে নামকরণ করে তৃণমূল তিতুমীরের প্রতি তাদের সমর্থনের অঙ্গীকার করেছে আগেও।

এই পদক্ষেপগুলির কথা আমাদের আবার ভাবার অবকাশ দিচ্ছে বর্তমানের নিজামুদ্দদিন মার্কাজের ঘটনা, তবলীগী জামাতের তত্ত্ববধানে। তবলীগী জামাতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে আতঙ্কবাদীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার। তাদের আদর্শের সাথে নানা কট্টরপন্থী উগ্রবাদীদের মিলের অভিযোগও পাওয়া গেছে এই সূত্রে। কিন্তু তাদের আদর্শের সাথে বাংলার এই প্রাচীন জ্বেহাদী, এবং অধুনা স্বাধীনতাসংগ্রামী আখ্যায়িত তিতুমীরের আদর্শের মিল যেন কোনভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না আমাদের। ইসলামের মূল ছয়টি স্তম্ভে ফেরার লড়াইয়ে অবিচল দুই আন্দোলন তবলীগী জামাত, এবং তরিকা-ই-মহম্মদিয়া যেন একই ধারায় বহমান, একই আদর্শের অনুসারী। তাই একটি ঘটনার কথা মনে করলে বারেবারে ফিরে আসে অতীতের সে রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের স্মৃতি, এবং এক অজানা আতঙ্কের সম্মুখীন করে আমাদের।

 

তথ্যসূত্র:

নবরূপে তিতুমীর – রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়, তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার লড়াই – বিহারীলাল সরকার এবং নানা পত্রপত্রিকা