বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

২য় অধ্যায়

র‍্যাডক্লিফ লাইন: পশ্চিম ও পূর্বে তার আভিঘাত

দেশভাগ ব্যাপারটা ভগ্নাংশের অংক নয়। জেলা বা রাজ্য ভিত্তিক জনগণনার পরিসংখ্যান কোথায় কোন সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু বা লঘু সেই খতিয়ান দিতে পারে, কিন্তু সেই স্থানগুলোর ভৌগোলিক সংলগ্নতা না থাকলে সংযুক্ত করার সূত্র দিতে পারে না। এর ফলে হিন্দু প্রধান বেশ কিছু অংশ পাকিস্তানে চলে যায়, যেখানে মুসলিম অধ্যুষিত অনেক অংশই ভারতে থেকে যায়। হিন্দুস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন এইসব হিন্দু বা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু মুসলিমদের যা দুর্দশা হয়েছিল তা বর্ণনাতীত। দাঙ্গা থামাতেই ভূমিবণ্টণ মেনে নেওয়া; কিন্তু Radcliffe Line-এর ঘোষণা মাত্র ভয়াবহতা যেন দুঃস্বপ্ন ছাড়িয়ে গেল। ট্যালবট ও গুরু হরপাল সিং-এর মতে অনেক জায়গায় দেখা দিল Genisidal tendency; অপর সম্প্রদায়ের পুরো প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ণ করে দাও, প্রজনন রোধ করো। “The catalogue of horrors includes the disemboweling of pregnant women, the slamming of babies’ heads against brick walls, the cutting off of victims limbs and genitalia and the display of heads and corpses. While previous communal riots had been deadly, the scale and level of brutality was unprecedented.” ‘অপর সম্প্রদায়’ কথাটা হিন্দু-মুসলিম দু ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল ভারতের পশ্চিম সীমান্তে, পূর্ব দিকে বাংলায় হিন্দু বাঙালীরা কখনই বিনা প্ররোচনায় মুসলিমদের আক্রমণ করেনি। আর শুধু প্রাণহানি নয়, সদ্যগঠিত দুটি রাষ্ট্রের অর্থনীতিও ধসে পড়েছিল।

ভূমি বণ্টণে অসঙ্গতি ও পরিণাম

ভৌগোলিক অবস্থানের জেরে পাঞ্জাবের লাহর, রাওয়ালপিণ্ডি, মুলতান ও গুজরাট হিন্দু প্রধান অঞ্চল হলেও ভাগাভাগিতে চলে যায় পাকিস্তানে, যার ফলে সেখানকার হিন্দু ও শিখরা হাজারে হাজারে মরে, বাকিরা প্রাণ নিয়ে র‍্যাডক্লিফের এপারে আসতে পালিয়ে আসে। অন্যদিকে অমৃতসর, লুধিয়ানা, গুরুদাসপুর ও জলন্ধর মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্তেও থেকে যায় ভারতীয় পাঞ্জাবে। যথারীতি সেখানে মুসলমানরা আক্রান্ত হয় ও কিছু পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। ওদিকে মালদা, মুর্শিদাবাদ মুসলিম প্রধান হয়েও পশ্চিমবঙ্গে পড়ে। আর খুলনা হিন্দু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধ প্রধান হলেও চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানে। ধর্মের ভিত্তিতে যে সুষ্ঠ ভূমি বণ্টন সম্ভব নয়, তা জেনেও কিছু করার ছিল না।

দেশভাগের ৩.৬ বছর পর পাকিস্তানের ১৯৫১-র সেনসাস দাবি করেছিল ঘরছাড়া ৭২,২৬,৬০০ মানুষের সবাই ভারত থেকে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমান। আর ১৯৫১-র ভারতীয় সেনসাস অনুসারে ৭২,৯৫,৮৭০ জন হিন্দু ও শিখ পাকিস্তান থেকে এদেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসে। পাকিস্তানের দেওয়া পরিসংখ্যান কতটা সত্য তা পরখ না করেও বলা যায় ভাগাভাগির পর পাঞ্জাবে ব্যাপক জনসংখ্যা বিনিময় (population exchange) হয়েছিল যেটা পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। শুধু ১৯৪৭-এর দাঙ্গায় সময় ভারতীয় পাঞ্জাবে হিন্দু-শিখ শরণার্থী এসেছিল প্রায় ৪৭ লক্ষ, যেখানে ৬৫ লক্ষ মুসলিম পাঞ্জাব থেকে পাকিস্তানে চলেও যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আসে ২৬ লক্ষের বেশি আর যায় মাত্র ৭ লক্ষ। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয় অনেক বেশি। অন্যদিকে হিন্দু সিন্ধিদের সাথে হিন্দু বা মুসলমান কারোরই বিশেষ বিরোধ ছিল না। তবু মুসলিম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ৭,৭৬,০০০ হিন্দু সিন্ধি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসে। তারা সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পাকিস্তান ১৯৯৮ সেনসাসের দাবি তখনও ওদের সিন্ধু প্রদেশে ২২.৪ লক্ষ হিন্দু সিন্ধি নাকি রয়ে গেছে, যেখানে ২০০১-এর ভারতীয় সেনসাস জানাচ্ছে ভারতে সিন্ধির সংখ্যা ২৫.৭ লক্ষ। বাস্তব সত্য হল, সীমান্তের ওপারে হিন্দু সিন্ধিরা ক্রমশ সংখ্যায় কমছে যাকে ‘minority in decline’ বলা যায়।
কত অগুণতি মহিলা যে ধর্ষিত, খুন ও লুঠ হয় তার সামান্যই নথিভুক্ত করা গেছে। ভারত থেকে ১৯৪৯ সালে যদিও বা ১২,০০০ মুসলিম মহিলাকে উদ্ধার করা গেছে, পাকিস্তানে উদ্ধার হয় মাত্র ৬০০০ হিন্দু ও শিখ রমণী। এটা সরকারি সূত্রের হিসাব। সংখ্যাটা ১৯৫৪ সালে গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২০,৭২৮ ও ৯,০৩২। পরিবার ফিরিয়ে নেবে না অশঙ্কায় অনেক হিন্দু মেয়েই ‘দেশে ফেরা’র পথও খুঁজে পায় না।
দেশভাগের আগে থাকতেই পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের দাবিতে লাগাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য জন-বিনিময় কিছুটা অনুমান করা গিয়েছিল। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নেহেরু পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জনবিনিময়ে সম্মতি দিলেও বাংলার বেলা দেননি, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নীতি-কর্তব্য নিয়ে দারুণ ভাবিত হয়ে পড়েন। তাই দিল্লি ও পাঞ্জাবে শরণার্থী পুনর্বাসন দেওয়ার কাজটা তুলনায় সচল ছিল; ঘর পালানো মুসলমান এলাকায় পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জায়গা দেওয়া গিয়েছিল। যদিও দেশভাগের জন্য আকস্মিক জনসংখ্যার ভার দিল্লিকেও নিতে হয়েছিল। ১৯৪১-৫১ এই এক দশকে দিল্লির জনসংখ্যা ৯,১৭,৯৩৯ থেকে ১৭,৪৪,০৭২ হয়ে যায়। পুরানা কিলা, লালকেল্লার মতো ঐতিহাসিক সৌধের পাশাপাশি কিংসওয়ের মিলিটারি ব্যারাক শরণার্থীতে ছেয়ে যায়। তাদের যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে, যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে লাজপত নগর, রাজিন্দর নগর, নিজামুদ্দিন, পাঞ্জাবি বাগ, গুংপুরা ও কিংস্‌ওয়ে ক্যাম্প এলাকায় পুনর্বাসন দেওয়া হয়। মোটামুটি এক বছরের মধ্যে পাঞ্জাব ও দিল্লিতে উদ্বাস্তু স্রোত থিতু হয়।
অন্যদিকে বঙ্গে দাঙ্গাটা মূলত কলকাতা ও নোয়াখালিতে কেন্দ্রীভূত ছিল বলে ব্যাপক শরণার্থীর ঢল আশঙ্কা করা হয়নি। তাছাড়া গরম হাওয়ার আঁচ পেয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে দেশভাগের আগেই সম্পন্ন হিন্দুরা এপারে চলে আসছিল। পড়ে থাকত কৃষিজীবী ও শ্রমিকের দল। কিছু মুসলিম পরিবারও যে ওপারে যায়নি তা নয়। তাই ১৯৪৭-এ পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর জন্য কেন্দ্র বা রাজ্য কারোরই তেমন প্রস্তুতি ছিল না। উপরন্তু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার কিংবা সদিচ্ছার অভাবে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় উপর্যুপরি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায় রাজ্য সরকারগুলি। আন্দামানে ও পতিত ভূমির দণ্ডকারণ্যেও চলে যেতে হয় কিছু শরণার্থীকে। নদিয়া, ২৪ পরগণা ও কলকাতার আশেপাশে গজিয়ে উঠতে থাকে জবরদখলি এলাকা। ঘটি বাঙালের অম্ল-মধুর কোন্দলের সম্পর্কে ক্রমশ তিক্ততা জমে উঠতে লাগল।

সত্যি বলতে গান্ধী বা নেহেরু পশ্চিম প্রান্তে পাঞ্জাবের সমস্যা যতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন, বাঙালী হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে তার ছিঁটেফোঁটা ভাবিত ছিলেন না। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার নেহেরুর এই ভূমিকার সমালোচনায় লিখেছেন, “যখন স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ হিন্দু নরনারী লাঞ্ছিত, উৎপীড়িত ও সর্বস্বান্ত এবং চরম দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল তখন পশ্চিমবাংলায় আন্দোলন আরম্ভ হইল যে, যত সংখ্যক হিন্দু বিতাড়িত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে আসিয়াছে সেই সংখ্যক মুসলমানকে পূর্ববঙ্গে পাঠাইয়া নবাগত হিন্দুদের পুনর্বসনের ব্যবস্থা করা হোউক। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল গান্ধীজীর কথার প্রতিধ্বণি করিয়া বলিলেন যে, ইহা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাজ্যে অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বিধানচন্দ্রকে নির্দেশ দিলেন যে, পূর্ববঙ্গ হইতে উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় লওয়া বন্ধ করিতে হইবে। যে দু’খানি চিঠিতে নেহেরু এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন তাহা চিরকাল মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলালের দুরপনেয় কলঙ্ক ও নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন বলিয়া গণ্য হইবে।” অবশ্য তাড়া খেয়ে আসা
হিন্দু বাঙালীই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর যেখানে নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রতি সদয় থাকেনি, বিতাড়ক ধর্ষক খুনীদের হয়ে ওকালতি করেছে, তাদের অখণ্ড বাংলার সাম্প্রদায়িক স্বপ্নে নিজেদের উদ্ভুদ্ধ জারিত করেছে, সেখানে গান্ধী-নেহেরুর নির্দয়তার প্রতি অভিযোগ আর কতটা সঙ্গত?

এক ধাক্কায় আশ্রয়প্রার্থী যা এসেছিল, ভাগাভাগির পর তিনদশকে তার চেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে। এপারে আত্মীয় পরিচিতের মাধ্যমে অনুপ্রবিষ্টরা স্থিতিও লাভ করে। মুশকিলে পড়ে নমশূদ্ররা ও কৃষিজীবীরা, যাদের স্থাবর ভূমি বা ভাগচাষের কাজ ছাড়া কোনও সম্পদ ও দক্ষতা ছিল না। তারা ১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তানে আবার আক্রান্ত হয় ও হতেই থাকে। কিন্তু হিন্দু সমাজের জাতপাতের সৌজন্যে দলিত ও মুসলমানরা মধ্যে প্রায়ই পারস্পরিক নৈকট্য ও অভিন্নতা আবিষ্কার করে। স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতিতেও এই সমীকরণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। আর গেরুয়া দলের দিগ্বজয়র পর তো তাদের রুখতে এই তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। হিন্দুরা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না – বর্ণহিন্দু হলেও না, তথাকথিত নিম্নবর্ণের হলেও না। সেই সূত্রে বাঙালী দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছে বাংলাদেশপ্রীতি ও অখণ্ড বাংলার জন্য হাপিত্তেশ।

নমশূদ্র ‘মহাপ্রাণ’ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল জাতপাত বৈষম্যের প্রতিবাদে হিন্দু হয়েও পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করেছিলেন, এমনকি কলকাতা ও নোয়াখালির মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পরেও। পুরস্কার স্বরূপ সেখানে ক্যাবিনেট মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তানের স্বরূপ দেখে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পদত্যাগ-পত্র দিয়ে মন্ত্রীপদ ছেড়ে ভারতে এসে আশ্রয় নেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু জমিদারেরা ভারতে চলে আসার ফলে নাকি ওখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভূমি সংস্কার হয়ে যায়। কিন্তু সেই ভূমি সংস্কারের দুর্দান্ত প্রক্রিয়া যদি শুধু জমিদারদের বিরুদ্ধে হয় থাকে, সাধারণ হিন্দুরা তবে কেন পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল? শান্তিপূর্ণ ‘ভূমি সংস্কার’-এর স্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ পত্রের অংশবিশেষ তুলে ধরলে কিছুটা বোঝা যাবে।
“কলকাতার বিশাল হত্যাযজ্ঞের পরপর সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে এক ভোটাভুটি আয়োজিত হয়। শুধুমাত্র আমার চেষ্টা দ্বারাই কংগ্রেসের পক্ষের চারজন অস্পৃশ্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্যের সমর্থন যোগাড় করা সম্ভব হয় যা ব্যাতীত মন্ত্রীসভার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল।”….. “সব খোয়ানো নারীশিশুদের স্বজন হারাবার হাহাকারে আমার হদয় দ্রবীভূত হল। আমি নিজের কাছেই জানতে চাইলাম ‘ইসলামের নামে পাকিস্তানে কী ঘটতে চলেছে?’”…. “প্রথম যে ঘটনা আমাকে মর্মাহত করে তা ঘটেছিল গোপালগঞ্জে দিঘারকুল গ্রামে। সেখানে স্থানীয় নমঃশূদ্রের বিরুদ্ধে মুসলিমরা মিথ্যা অভিযোগ রটিয়ে বর্বরতা চালায়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে একজন মুসলিম জেলে মাছ ধরতে জাল ছুঁড়ে মারে। একজন নমঃশূদ্র একই উদ্দেশ্যে জাল ছুঁড়ে মারে। এই নিয়ে দুইজনের ভিতর কথা কাটাকাটি হয়। মুসলিম যুবক গ্রামে গিয়ে মিথ্যা গুজব রটায় যে তাকে এবং এক মহিলাকে নমঃশূদ্ররা আক্রমণ করেছে। গোপালগঞ্জের উপ জেলা প্রশাসক সে সময় নৌকায় করে সে জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে অভিযোগ করলে তিনি কোন তদন্ত ছাড়াই সশস্ত্র পুলিশ পাঠান নমঃশূদ্রদের দমন করতে। তাদের সাথে স্থানীয় মুসলিমরা যোগ দেয়। তারা নমঃশূদ্র হিন্দুদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। তাদের হামলায় বাড়িঘর ধ্বংস হয়, প্রচুর নারী পুরুষ আহত হয়। শেষ সহায় সম্বলটুকু লুট করে নিয়ে যায় মুসলিমরা। এক হিন্দু মহিলা যিনি কিনা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা তাকে পিটিয়ে গর্ভপাত করে দেয় তারা। বিশাল এলাকা জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।”…..এটা ছিল ভূমিকা। এই ঘটনার কিছুদিন পরে শুরু হয়ে যায় কুখ্যাত নোয়াখালি গণহত্যা। “দেশভাগের পর থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ হিন্দু দেশ ছেড়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারির দাঙ্গা বাদেও এর পেছনে বহু কারণ কাজ করেছে। মুসলিমদের বয়কটের কারণে আইনজ্ঞ, মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, দোকানদার, বিক্রেতা ও বণিক সহ প্রায় সব পেশার হিন্দুদেরই জীবিকার খোঁজে পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে হয়েছে। আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ না করেই হিন্দু বসতবাড়ির সম্পূর্ণ মালিকানা কিনে নেওয়া এবং বাড়ির মালিকদের কোনোরূপ ভাড়া পরিশোধ না করার ফলে তারা ভারতে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে।”

সুরাবর্দি বা সোহরাবর্দির ঘাতক সরকারকে অনৈতিকভাবে বাঁচিয়েছিলেন তৎকালীন দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। সেই সময় বাংলার মুসলিম লীগ সরকার পড়ে গেলে, গোটা বাংলাই ভারতে থাকতে পারত। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার শোকে মহাপ্রাণের ভক্তদের কেঁদে ভাসানোর প্রয়োজন হোত না। অথচ বাস্তব হল, যখনই পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক হামলার মুখে পড়েছে, তখনই খেপে খেপে বণহিন্দুরা যদিও বা কাঁটাতারের এপারে পালিয়ে আসতে পেরেছে, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কিন্তু অধিকাংশ অসহায়ভাবে মার খেয়ে মরেছে, যৌন হ্যানস্থার শিকার হয়েছে কিংবা চাপের মুখে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেরই হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। নীরোদ চন্দ্র চৌধুরীর “আত্মঘাতী বাঙালী” কথাটা যে কতটা সত্য!

আর শুধু কি হিন্দু? মুসলমান অনুপ্রবিষ্ট শরণার্থীরও বিপুল ঢল নেমেছিল ১৯৭১-এ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাছাড়া জীবিকার সন্ধানে বা নাশকতার উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ তো আছেই। শরণার্থীর সঙ্গে লাগাতার অনুপ্রবেশের ফলেই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার ভূমি, অর্থনীতি সবই সংকটে, জনমানচিত্র নিয়ে উদ্বেগ, প্রাদেশিক জাতিগত অসন্তোষ, আর তার জেরে ভারতীয় বাঙালীর কাছ থেকেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তার ভারতীয় পরিচয়, শেকড়ের অধিকার।

চলবে