নতুন কৃষিবিল ভারতের কৃষককে আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিতে পথ দেখাবে

0
1791

ডঃ সৌমেন চক্রবর্তী

পটভূমি

কোন বিশেষ স্বার্থের তল্পিবাহক হয়ে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা বা লবিং, জটিল রাজনৈতিক ঘোর প্যাঁচ। দেশে দেশে কৃষির রাজনৈতিক অর্থনীতির এটাই মোদ্দা চরিত্র। লবির সাইজ ও ক্ষমতার মাত্রা ভেদে অবশ্য কোথাও এই প্রচেষ্টা খুব জোরালো। কোথাও বা ততটা এলেমদার নয় ।

২০০১র নভেম্বরে বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের দোহা রাউন্ড শুরু। তার আগে কৃষিবাণিজ্য নীতি নিয়ে ভারত শলাপরামর্শ, আলাপআলোচনার আখ্যানটি এক্ষেত্রে মনে রাখার মতো। উরুগুয়ে রাউন্ড ঢোকার পর; কিন্তু রাজ্য প্রতিবাদ জানায়। এমন কী আবেদন পেশ করা হয় সুপ্রিম কোর্টেও। তাদের সওয়াল কৃষি সংক্রান্ত কোনও চুক্তি করার অধিকার কেন্দ্রের নেই। কৃষি রাজ্য তালিকার বিষয়, তাই রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে । জট কাটাতে দোহা রাউন্ডের আগে কেন্দ্রীয় সরকার শিল্প বাণিজ্য, কৃষি ও বিদেশ মন্ত্রক এবং সুশীল সমাজের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেয়।

আঞ্চলিক বা রাজ্য স্তরেও রাজনৈতিক ও কৃষকদের সঙ্গে কেন্দ্র বৈঠকে বসে, আলোচনায় সামিল করা হয় সুশীল সমাজ ও পরামর্শদাতা সংস্থার বিশারদদের। এসব কথাবার্তায় কিছু তাজ্জব ব্যাপারস্যাপার উঠে আসে। এতকাল সংরক্ষণের সমর্থনে সবাই ছিল সোচ্চার । যুক্তিতর্কে দেখা গেল শুধু সংরক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামানো যথেষ্ট নয়। প্রতিযোগিতায় ফায়দা তোলার এলেম রাখে আমাদের দেশ।

এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি ২০২০ সালের শেষ লব্ধে । ২০০১এর দিনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন হলো কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক কৃষি সংস্থার বিল লোক সভা ও রাজ্য সভায় পাস্ হয়ে, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের অধ্যায়ও সমাপ্ত। ঠিক তখনই দেশজুড়ে নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এই নতুন কৃষিনীতি সংস্থার বিলের বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দুর অভিমুখ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে বিরোধীদের। কারণ হিসাবে প্রসঙ্গক্রমে তাই আমি ২০০১ সালের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে এই বিষয়ে লিখতে শুরু করেছি।

শহুরে মধ্যবিত্ত কথা বলবে কৃষককে নিয়ে?

আসলে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এইবারেও বিরোধিতার ক্ষেত্রগুলি সেই আঞ্চলিক বা রাজ্য পর্যায়ের রাজনীতিতে উঠে আসছে। সেইদিনও তাই হয়েছিল। আসলে কৃষি অর্থনীতি বা কৃষকের সম্পর্কে কিছু বলার বা বোঝার অধিকার যেন একতরফা ভারতের শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের। কারণ ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের অধ্যায়টি যেমন ছিল ভারতের ইতিহাসে এক জলবিভাজিকারমুহূর্ত, ঠিক তেমনি Agriculture Produce Marketing Committee (APMC) Act “2020”. একই ঘটনার পুনরাবৃত্তের ইতিহাসের মুহূর্ত। এইদিনের উদারীকরণ কৃষিক্ষেত্রকে তার পছন্দের অধিকারএবং আধুনিকীকরণের অধিকারের মাত্রার সাথে যুক্ত করা হল।

এই আলোচনায় প্রবেশের আগে বিলের বিতর্কের জায়গা আগে তুলে ধরা দরকার এবং একইসাথে এর সম্ভাবনাময় সুবিধা ও অসুবিধার ধারণাগুলিও ব্যক্ত করা প্রয়োজন।

একনজরে সুবিধাজনক দিক :

  1. কৃষক নিজেই তার বাজার খোঁজার বা বাজার পছন্দের অধিকারের স্বাধীনতা পাবে।

  1. নিজ রাজ্যের পরিসীমা দিয়ে কৃষককে রাজনৈতিকভূগোলে আটকে রাখা যাবে না। সে ইচ্ছা করলেই তার উৎপাদিত পণ্য যে কোন ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে বিক্রি করতে পারবে।

  1. কৃষক আর তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী ফড়ে বা দালালদের ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে।

  1. কৃষক এই নতুন কৃষিনীতি সংস্কারের ফলে নিজেকে সরাসরি বিশ্ববাজারের সাথে যুক্ত করতে পারবে। এরফলে তার পণ্যের দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

  1. কৃষককে আর উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য পণ্য মজুতভাণ্ডারে (cold storage) নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়তি খরচ বহন করতে হবে না।

  1. নতুন কৃষি সংস্কার নীতি বিলবাস্তবায়িত হলে বহু নতুন নতুন বেসরকারী সংস্থা মজুত ভাণ্ডার নির্মাণে আগ্রহী হবে। এরফলে কৃষক মাণ্ডিগুলি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। তাতে কৃষক উপকৃত হবে ফসলের বেশি দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে।

  • নতুন বিল বাস্তবায়িত হলে কৃষক আর বাধ্য থাকবে না, শুধুমাত্র লাইসেন্স হোল্ডার এজেন্টদের কাছে তার উৎপাদিত পণ্য বেচতে। এজেন্টরা ১.৫% – ৩% পরিষেবা কর কৃষকদের কাছ থেকে নিত। এর থেকে মুক্তি ঘটবে। ন্যায্য মূল্যের বেঁধে দেওয়া দামে কৃষক অনেকসময় বাধ্য হয়ে যে উৎপাদিত পণ্য বেচত, কিন্তু ৬০ বা ৯০ দিন বাদে সেই উৎপাদিত পণ্যের বাজার দাম যে মাত্রায় ছুঁত তার কোন অংশই কৃষকরা পেত না। পুরাতন ব্যবস্থায় কৃষকদের দর কষাকষিরক্ষমতা থাকত না বললেই চলে। মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করত একতরফাভাবে। নতুন কৃষি বিল এই স্বার্থান্বেষী শ্রেণীর কাছে অশনি সংকেত বয়ে আনলো। কৃষি অর্থনীতির অন্যতম বিশিষ্ট আলোচকদ্বয় রুডল্ফ এবং রুডল্ফ তাদের লেখা “In pursuit of Lakshmi : The Political Economy of the Indian State” –বলেন

We use Lakshmi as a metaphor that establishes a language of discourse. The name invokes an Indian world view…… Lakshmi’s jurisdiction is Wealth, Power and Good Fortune. Note that in this formula good fortune, not individual or collective rational choice or internal or external structural determinants, is associated with wealth and power.

পাঞ্জাবের ধনী কৃষকদের ঘুঘুর বাসা

আজ ভারতবর্ষে যখন কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই কৃষিসংস্কারের নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু আমাদেরকেও বুঝতে হবে আমরা কোন চোখ, কান দিয়ে সেই বিতর্ককে গ্রহণ বা বর্জন করব। বিশিষ্ট লেখক Chetan Bhagat এই প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে মন্তব্য করেন (The Times of India – 26.09.2020), “India has huge potential as a major agricultural powerhouse in the world. Supermarkets in major world cities stock milk, cheese, butter, vegetables and poultry from far flung nations. Thailand and Australia for instance. supply a lot of agricultural produce around the world. India does not. …………. The Indian urban middle class wants low food prices. Hence farmers enjoy sympathy but not a free market. The Government is letting go. The current bills pave the path for privatisation of Indian agriculture. …..

Our farmers have always had respect and sympathy from citizens. It is about time they also had something else – choice.”

পাঞ্জাবের উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে কৃষকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুইতৃতীয়াংশ জায়গা দখল করে বসে আছে “arhtiyas” গুলি। এরফলে রাষ্ট্রলোনের থেকে কৃষকদের নির্ভরশীলতার কেন্দ্র হিসাবে “arhtiyas” তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েমে সক্ষম হয়েছে। F.P.O. (The Farmer Producer Organisation) কৃষকদের থেকে সরাসরি ফসল কেনে একটা নির্দিষ্ট দামে। এই লবিরশক্তি এতটাই যে এখান থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় মধ্যবর্তী এই লবি গোষ্ঠী যতটা শক্তিশালী, ততটা ভারতের অন্য রাজ্যে নয়।

পাঞ্জাবে ৪০,০০০ মধ্যবর্তী ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে ১,৮০০ মান্ডিকে, আবার হরিয়ানায় ৩২,০০০ “arhtiyas” নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে গমের উপর পাঞ্জাবে ৮.৫ শতাংশ আর্থিক মূল্য নেয়, ৩ শতাংশ গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য কর আরোপ করে, এবং মাণ্ডিগুলি ২.৫ শতাংশ কমিশন নেয়। হরিয়ানায় তা ৬.৫ শতাংশ। নতুন কৃষিবিল এই প্রায়প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠা স্বার্থসিদ্ধির ঘুঘুর বাসায় আঘাত আনতে চলেছে। বেসরকারী কর্মকর্তারা মান্ডির বাইরে এই কৃষিপণ্য কিনতে যথেষ্ট আগ্রহী, কারণ এর বিশ্ববাজারে চাহিদা ব্যাপক। কৃষক সরাসরি তার পণ্যকে দরকষাকষির বাজারে নিয়ে যেতে পারবে।

রাষ্ট্রের প্রগতিতে কৃষিবিল

Global Hunger Report অনুযায়ী ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২-এ অবস্থান করছে ভারত। প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্তরে বিপন্ন সময়ে মজুত খাদ্যশস্যের ভারতে প্রয়োজন ৭৪১.৪১ লক্ষ টন। যার মধ্যে ২৭৫.৪১ লক্ষ টন চাল, ৪৬৫.৬০ লক্ষ টন গম অন্যতম।

(Source : Government of India, Press Release dated 2 July 2019 )

জাতীয় খাদ্যসুরক্ষা আইন অনুযায়ী জনকল্যাণ কর্মসূচির আওতায় ৬১০ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন। যা সরকারী মজুত ভাণ্ডারের সংরক্ষণের ক্ষমতার থেকে কম। মজুত ভাণ্ডারের অভাবের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায়। একদিকে এই কৃষিসংস্কার বিল বেসরকারী সংস্থাকে উৎসাহিত করবে নতুন নতুন মজুত ভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য। অন্যদিকে ঘরোয়া প্রয়োজন ও প্রান্তিক মানুষদের খাদ্যসুরক্ষার দাবী মেটানোর সাথে সাথে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য রপ্তানি বাণিজ্যে কাজে লাগবে। এরফলে সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসাবে খাদ্য কূটনীতিভারত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এক সুবিধাজনক অবস্থানের সৃষ্টি করবে।

এরই সাথে সাথে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাতকে প্রান্তিক স্তরে প্রসারিত করা, এরফলে অনাবাদী জমি শুধু যে আবাদী হবে তাই নয়, উন্নত হবে প্রান্তিক স্তরে অবস্থানকারী মানুষজনের পরিকাঠামো। ভূমিক্ষয়, ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের উপদ্রব এবং পারথেনিয়ামের মত আগাছা জন্মানোর থেকে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে রাষ্ট্রকে। এইসব ব্যবস্থাদির মাধ্যমে বেশকিছু অব্যক্ত অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, যা দেশের প্রায় অর্ধেক শ্রম শক্তির রুটিরুজির সাথে যুক্ত। একইসাথে কৃষির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকেন্দ্রিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।

লেখক সাধন চন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মতামত তাঁর, বঙ্গদেশের নয়। ফীচারের ছবি আর মাধবনের, যিনি আই আই টি থেকে পাশ করা প্রযুক্তিবিদ এবং সফল কৃষক।