কলকাতা সাত লক্ষ ছয়

0
858

 

শেখর ভারতীয় 

কলকাতার বর্ষা আর ক্যাটরিনা কাইফের হিন্দি দুটোই সমার্থক,প্রথম প্রথম বেশ ভালো লাগলেও, বেশি হলেই চাপের। বৃষ্টিটা আবার বাড়ল,রাত ১০.২০র শেষ মেট্রোটা এই মিনিট পাঁচেক হল আমাকে শোভাবাজারে নামিয়ে দিয়ে গেছে।বাইরে বেরিয়ে যে হাঁটা লাগাবো তারও উপায় নেই,বেশ জোরেই হচ্ছে বৃষ্টিটা। বাড়ি অবধি পৌঁছতে রোজ শোভাবাজার মেট্রো থেকে ১৫ মিঃ হাঁটতে হয় আমাকে। কিন্তু আজ এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে তার উপর এই বৃষ্টি।বাড়িতে যে জানাবো
তারও উপায় নেই,সারাদিন ধরে গেম আর FB করার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ব্যটারিটা অনেক আগেই মারা
গেছে৷ তাই মোবাইলটা সুইচট্ অফ। দেখুন আবার আপনাদের সাথে বকতে শুরু করে দিলাম। নাহ্ বৃষ্টিটা একটু কমল মনে
হচ্ছে চটপট বেরিয়ে পড়ি। ওদিকে আবার আমার বাড়ি ফেরার রাস্তায় ওই জায়গাটাও পড়ে,যে জায়গাটার নাম আপনারা গালি দেওয়ার সময় ছাড়া বড় একটা উচ্চারন
করতে চান না৷ আমাকে রোজ রাত্রিরে ওই জায়গাটা পেরিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়। আর ওই রং চং মেখে রেলিং ধরে
দাঁড়ানো লাল ঠোঁটের মেয়েগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে কি যে অস্বস্তি হয়!অনেকটা দুর দিয়ে পেরোলেও ওরা ঠিক আওয়াজ দেবে,
-কি গো বাবু একাই যাবে? নিয়ে চল না গো
২০০ টাকা দিও পেট ভরে মধু খেয়ো”
পাশ থেকে আর একজন..
-তুই ও যেমন, দেখছিস না ও ভদ্রলোকের ছেলে৷ মধু নয় দুদু খায়৷
বলেই নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করবে। আর তাই ওই ৩মিনিটের রাস্তাটা পেরোতে গিয়ে রোজ
আমি ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে যাই। এই দেখুন কথা বলতে বলতে জায়গাটাতে এসে পড়লাম। কিন্তু জায়গাটা আজ
ফাঁকা লাগছে৷ একজন মেয়েকেও দেখতে পাচ্ছি না রেলিং এর ধারে! বোধহয় বৃষ্টির জন্য কেও বেরোয়নি। যাক বাবা বাঁচা গেল,রোজ বৃষ্টি হলেই বাঁচি। আজ মনটা
বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল গুন গুন করে গান ধরলাম
-চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন….

হঠাৎ, এই বাবু শোন বলে দুটো মেয়ে সামনে পিছনে আমাকে ঘিরে ধরল। এই মরেছে এরাতো কখনো রেলিং ছেড়ে রাস্তায় নামে না, তবে! আমি ভয়ে আঁতকে উঠে,
আ আ আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ, আর কোনদিন এ রাস্তায় আসব না। মেয়ে দুটোর মধ্য একজন একটু বড় আর একজন আমারি বয়সি হবে। বড় মেয়েটা বলল,
-আমাদের সাথে একটু ভেতরে যেতে হবে তোমাকে…….
বলে কি! আমি চমকে উঠে বললাম,
-না না না মানে আমি ওরকম ছেলে নই ওই সব কোনদিন করিনি প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন৷
“দিদি” বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম৷ কোন একটা সিনেমায় দেখেছিলাম যেন এদের দিদি বললে এরা বেশি রেগে যায়, গালিগালাজ করে। পাশের কমবয়সি মেয়েটা বলে উঠল -ভালোয় ভালোয় চলুন না হলে অন্য উপায়ও জানা আছে আমাদের।
মনে হচ্ছে এদের আজ খদ্দের জোটেনি তাই আমাকেই…
-প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন, আমার কাছে এই ১০০০ টাকা আছে আর আমার এই মোবাইলটা আছে আপনারা চাইলে
এগুলো নিন কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ৷ কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম।
-চুপ সালা! দিদি এ ভালোয় ভালোয় যাবে না চল সালাকে চ্যাংদোলা করি….
-না প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন। চুপ একদম চুপ যা বলছি শোন না
হলে..
অগত্যা কোন উপায় না দেখে ওদের সাথে ঢুকতে হল অন্ধকার গলিতে। হে মা সর্বমঙ্গলা রক্ষা কর মা। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখছেনা তো? আমার পাড়াটা আবার এখান থেকে খুব একটা দুরে নয়৷ কেও দেখে ফেললে মহা কেলেঙ্কারি হবে।গলির ভেতরে অনেকটা চলে এসেছি পুরোন কলকাতা স্টাইলে সার সার দেওয়া ঘুপচি ঘর সব।আমাদেরই ঘরের মতো৷ বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। একটা ঘরের মধ্যে ঢুকলাম আমরা৷ সামনে একফালি উঠোন, পুরোন বনেদীবাড়ির মত৷ সেটা পেরোতেই সামনের একটা রুমে আমাকে ঢোকানো হল। রুমটাতে একটা বেড তার উপর
সুন্দর করে পাতা একটা ফুল ফুল চাদর। রুমে ঢুকেই ফ্যানটা চালিয়ে দিল একটা মেয়ে৷ হুম মিলে যাচ্ছে ঠিক
যেমনটি সিনেমায় দেখায়। এরপরের অবস্থাটার কথা ভাবতে গিয়ে আমার চোখে লজ্জা ঘৃনায় জল আসতে চাইল৷ ঠিক তখনই আমাকে অবাক করে দুটো মেয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ৫ মিনিট হল একায় বসে আছি ঘড়িতে ১১ টা। রুম ফাঁকা দরজাটাও খোলা এই সুযোগে পালাতে হবে….কিন্তু একা রাস্তা অবধি যেতে পারবো তো?, যা গলি। সে যা হয় হবে আগে এখান থেকে বেরোইতো,জয় বাবা লোকনাথ বলে যখনি উঠতে যাবো এমন সময় দুটো নয় চারটে মেয়ে ঘরে এসে ঢুকল…. ওদের পেছনে থালা হাতে তিনজন বাচ্চা মেয়ে৷ থালায় প্রদীপ আর কি যেন একটা দড়ির মত চকচক করছে। বাচ্চা মেয়েগুলো আরোও কাছে এগিয়ে এল এক এক করে তিনজনে তিনটে রাখি বেঁধে দিল আমার হাতে। মনে পড়ল আগামীকাল রাখিপূর্নিমা৷

চুপচাপ বসে থাকলাম, হঠাৎ হাতটা ভারী হয়ে গেছে আমার৷ রাখি হয়ত প্রতি বছরই পরি কিন্তু তার ভার যে এত তা আজ বুঝলাম। এই প্রথম বছরের প্রথম বর্ষা ছুঁলো আমায় বৃষ্টির ধারা নামল দুচোখ বেয়ে।