নীতিবোধ

– শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

লোকটার সঙ্গে একটা সামাজিক আন্তর্জালকে অর্থাৎ সোশাল নেটোয়ার্কে আলাপ। শুক্তি অনলাইন থাকলেই নানা রকম বার্তা পাঠাত। শুক্তিও জবাব দেয়নি তা নয়। না হলে আলাপটা প্রলাপে রূপান্তরিত হল কী করে?

স্যাম থাকে কানাডায়। দেশে বিদেশে প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিয়ে থাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায়। শুক্তি সফ্‌টওয়ার প্রোগ্রামার হয়েও পারিবারিক বাধ্যবাধকতায় চাকরি ছেড়ে ফ্রীলান্সিং করে জেনে নিজের সংস্থায় ফ্রীলান্সার হিসাবেই যোগদানের প্রস্তাব দিয়েছিল। অনুরাগের কথাও যে জানায়নি তা নয়। শুক্তির কাছে কয়েকটি ছোটখাটো প্যাকেজের নমুনাও চেয়ে পাঠায়। লিখেছিল ‘ডামি প্যাকেজ’, পারিশ্রমিকের উল্লেখ ছিল না; তবে কাজের বহর দেখে সন্দেহ হচ্ছিল সমস্যাটা বাস্তব। নিজের বায়োডেটাও পাঠিয়েছিল স্যাম ভার্গবকে। স্যাম আসলে ভারতীয়। কানাডায় নাগরিকত্ব পেতে গেলে নাকি সকলকে একটা খ্রীস্টান নাম নিতে হয়।

বায়োডেটায় ফোন নম্বর দেখে স্যাম শুক্তিকে ফোন করে। একথা সেকথার পর প্রস্তাব দেয় থাইল্যান্ডে যাওয়ার। তার বিমান টিকিট, হোটেল ও ভিসার বন্দোবস্ত স্যামই করবে। কাজ সম্পর্কে পরিস্কার কোনও বক্তব্য নেই। শুক্তি থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করায় সরাসরি জবাব, “উইথ মি মাই ডিয়ার”।

“মীন্‌স? আই ক্যান শেয়ার আ টেবল উইদ ইউ, নট আ রুম।”

“বাট ইউ নীড টু বি ভেরি ক্লোজ় টু মি”।

“দ্যাটস্‌ নট পসিবল”।

“সো ইউ ওয়ান্ট আ ক্যাজু়য়াল ফ্রন্ডশিপ? ও মাই গড!”

“ট্রু ফ্রেন্ডশিপ ইজ় নট আ ক্যাজু়য়াল অ্যাফেয়ার। মেইনটেইনিং মিউচুয়াল রেসপেক্ট ইজ় আ সিরিয়াস ক্রাইটেরিয়া”

“বাট আই ওয়ান্ট উই টু বি মাই সোলমেট, মাই লাভ –”

“আটারলি রিডিকিউলাস! ডোন্ট কল মি আগেইন।”

তারপরেও ফোন এসেছিল। স্যাম দিল্লী আসছে কাজে। উঠবে মৌর্য শেরাটনে। শুক্তি কি কয়েক ঘণ্টার জন্য দেখা করতে পারবে, দুপুরের দিকে? লবিতে বা রেস্তোঁয়ায়? মায়ানমারে একটা বড় সিভিল প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা ছিল।

একটু কৌতুহল হল। শুক্তি দেখা করতে যাচ্ছে শুনে কিংশুক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “লোকটা তোমার কাছে কী চায় জেনেও দেখা করতে যাবে?” হ্যাঁ। কিংশুক শুক্তির এই প্রবাসী অনুরাগীর কথা জানে। শুক্তিই বলেছে। কিন্তু কাজের অফারও তো আছে। শুক্তির তৈরি করা ডামি প্যাকেজ খুব পছন্দ হয়েছে স্যামের। বাড়িতে বসেই প্রগ্রামিং করবে শুক্তি। কানাডিয়ান কোম্পানি ডলারে পারিশ্রমিক দিলে অনেকগুলো টাকা পাওয়া যাবে। দোষের মধ্যে লোকটা একটু প্রেমেই পড়েছে, এই যা। কৌতুহল নিরসন ও ভাগ্যান্বষণের যুক্তি দিয়ে কিংশুককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শুক্তি গিয়েছিল শেরাটনে। সাততারা এই হোটেলে এমনিতে তো ওঠা হয় না। অথচ চিত্তরঞ্জ পার্কের বাড়ি থেকে সাকেত নগরের এই বিশ্বমানের হোটেল মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে।

মাঝবয়সী স্যাম নিজের প্রোফাইল ছবি হিসাবে কখনও এক হলিউড তারকার কখনও টিউলিপ বাগানের ছবি ব্যবহার করত। থাইল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে মেইল করে নিজের সত্যিকারের ছবি পাঠিয়েছিল। প্রশস্ত ললাটের সাদামাটা আধবুড়ো। কিন্তু শুক্তির আসল ছবি দেখেই সে নাকি প্রেমে ফিদা।

শুক্তিকে রিসেপশনে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে ট্যাক্সির ভাড়া স্যাম মেটাবে কিনা। শুক্তি হাত নেড়ে বলল, “ইট্‌স ওকে। আই হ্যাভ লেফ্‌ট দ্য ক্যাব।” বলল বটে ক্যাব; তবে শুক্তি অটোয় করে এসে হোটেলের ফটকের একটু দূরে নেমে পড়েছিল।

স্যাম গদগদ হয়ে শুক্তির রূপের প্রশস্তির বন্যা বইয়ে দিল। আগে পরিচয় হলে নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিত, ইত্যাদি। লবিতে বসেই বেয়ারাকে কফির জন্য বলল। সঙ্গে স্ন্যাকস্‌ যা থাকে।

“আই রিয়েলি লাভ ইউ। আই অ্যাম রেডি টু ওয়েট।”

শুক্তি হেসে লঘু করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্যাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আপদমস্তক সৌন্দর্যের প্রশংসা ও সেই সঙ্গে “ভেরি ক্লোজ়” হওয়ার জন্য আবেদন নিবেদন। ঐদিন না হোক অন্য কোনওদিন। কফির সঙ্গে কতগুলো অজানা ভাজাভুজি, দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো বাঁকা কেক জাতীয় কিছু, পুঁচকি পুঁচকি সিঙাড়া। খেতে বেশ লাগছিল। কফিতে দুধ কম হলেও স্বাদগন্ধ বেশ অভিজাত ও উৎকৃষ্ট।

“ইউ অয়্যার সাপোজ়ড টু অ্যাসাইন মি আ প্রোজেক্ট। বাট সো লং ইউ হ্যাভন্‌ট মেনশনড এনিথিং অ্যাবাউট ইট।”

“হানি, এভরিথিং ডিপেন্ডস্ অন আওয়ার পারসোনাল রিলেশন।”

“আ প্রফেশনাল রিলেশন শুড হ্যাভ পারসোনাল টাচ, নট মেকানিক্যাল। আই অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যট।”

“ইয়েস ফর দ্যট ইউ নীড টু বি ভেরি ক্লোজ় টু মি। টেক ইওর টাইম টু ডিসাইড। বাট টেক ডিসিশন ইন মাই ফেভার।”

“আই হ্যাভ নাথিং এলস্‌ টু ডিসাইড। বাই।”

“প্লীজ় ডোন্‌ট। দে উইল সার্ভ লাঞ্চ আফটার টুয়েলভ থার্টি। আই হ্যাভ অর্ডাড ফর ইউ টু”।

“আই শ্যাল হ্যাভ মাই লাঞ্চ উইদ মাই ফ্যামিলি। মাই সান উইল বি রিটার্নিং বাই থ্রি ফিফটিন। আই মাস্ট গেট অন নাও।”

“বাট ইউ জাস্ট টোল্‌ড দ্যাট ইওর হাজ়ব্যান্ড ইজ় দেয়ার অ্যাট হোম টুডে টু রিসিভ হিম…”

“অ্যান্ড সো আই শুড টেক দ্য অপরচুনিটি অ্যান্ড স্পেন্ড টাইম উইদ আ স্ট্রেঞ্জার?”

“নাও উই আর হার্টিং মি সুইটি। উই নো ইচ আদার ফর লাস্ট সিক্স মানথ্‌। অ্যান্ড আই টোল্‌ড ইউ বিফোর হোয়াট আই ফীল ফর ইউ। হাউ ক্যান উই বি স্ট্রেঞ্জার?”

“আই ডোন্‌ট নো ইউ। আই ডোন্‌ট নো ইউর লাইফস্টাইল। আই জাস্ট নো, অ্যাজ় ইউ টোল্‌ড, দ্যাট ইউ নীড আ টু ফীল দ্য ভ্যাকুওম ইউ হ্যাভ ইন ইওর ফ্যামিলি লাইফ। বাট আই ডোন্‌ট হ্যাভ এনি। আই অ্যাম, টাচ উড, হ্যাপিলি ম্যারেড। মাই ম্যান ইজ় লাইক নেবারস অ্যানভি ওনারস্‌ প্রাইড। আই হ্যাভ আ কিউট সান টু টেক কেয়ার। হোয়াই শুড আই ডিসটার্ব মাই ফ্যামিলি?”

“ইওর ফ্যামিলি লাইফ ওন্‌ট বি ডিসটার্বড। ইউ আর নট স্ন্যাচিং এনিথিং ফ্রম ইউর হাবি। জাস্ট ডুইং মি আ লিট্‌ল ফেবার”।

আহা, কী যুক্তি! দুপুরের খাওয়ার আওহ্বান। বিশাল ডাইনিং-এ সারি সারি সুখাদ্যের মিশ্র সুগন্ধ ভরভুর করছে।

“ইউ আর আ ম্যাচিউরড উওম্যান, অ্যান ইনডিপেন্ডেন্ট আইডেন্টিটি। আই হ্যাভ অ্যান এক্সেলেন্ট কেরিয়ার অপরচুনিটি টু অফার ইউ। নেকস্ট মানথ্ আই অ্যাম ফ্লাইং টু তাশখন্ড। আ লাভলি প্লেস টু স্পেন্ড। ইফ ইউ উইশ ইউ ক্যান কাম উইদ মি।”

“ফর হোয়াট? টু বি ইওর ডান্সিং অ্যাটেন্ডেন্ট? ইওর রুমমেট?” বেড পার্টনার কথাটা উচ্চারণ করতে রুচিতে বাধল।

“ইফ ইউ ডোন্‌ট কাম আউট অব ইউর ইনহিবিশন, হাউ ক্যান ইউ প্রসপার ইন ইন লাইফ? অ্যান্ড আই অ্যাশিউর ইউ, ইউ উইল এনজয় ওয়ান্‌স আই মেক লাভ টু –”

“আই অ্যাম ডান। আই হ্যাভ টু ব্যাক সুন। বাই – ” উঠে দাঁড়াল শুক্তি। কৌতুহলে বেড়াল মরে। আর মরে মেয়ে মানুষ। ছি ছি! কিংশুককে চটিয়ে এখানে এসে…!

“প্লীজ় অ্যাটলিস্ট হ্যাভ দ্য লাঞ্চ। আই শ্যাল ড্রপ ইউ বাই কার অ্যাট ইওর ডোর স্টেপ।”

“আই অ্যাম ইন হারি। বাই। অ্যান্ড থ্যাংকস্‌ ফর দ্য কফি।”

শুক্তির মনে পড়ল গুরুগ্রামের একটা আইটি দপ্তর একটা প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলার জন্য কয়েকবার ডেকেছে। পারিশ্রমিক তেমন আকর্ষণীয় নয় বলে চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে বত্রিশ তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে উজিয়ে যেতে বোধ করেনি। সরাসরি বাস মেট্রো বা ট্রেইন কোনওটাই নেই; অনেক কাণ্ড করে যেতে হবে। তাছাড়া স্যাম আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল ভারতে আসার আগেই। গুড়গাঁওয়ের ডেটা ম্যাট্রিক্সকে দু’একবার নিমরাজি ভাব দেখিয়ে চুপ করে গেছে স্যামের দেওয়া কানাডিয়ান কোম্পানির মায়ানমারে চলা প্রজেক্টটার ভরসায়। কিন্তু এখন আর যাচা লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলা নয়।

কিংশুককে ফোন করল। “শোনো, আমি শেরাটন থেকে বেরিয়ে পড়েছি। একদম ফালতু লোক। কাজকর্মের নামগন্ধ নেই। শুধু আলতুফালতু কথা। ভাবছি বেরিয়েইছি যখন তখন গুড়গাঁওয়ের কোম্পানিটা ঘুরে আসব। ওরা গতকালও ফোন করেছিল। যাব?”

“সেখানে তো অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিল। তা নয়, চলল মাল্টি মিলিনিয়রার এক লম্পটের সঙ্গে গল্প করতে। হল তো ইন্টারন্যাশনাল প্রোজেক্ট আর ডলারে পেমেন্ট পাওয়া? কিন্তু এখন এই ব্রহ্ম রোদে অত দূরে যাবে? দুপুরে কোথায় খাবে? সেই তো সকালে দুটো পরোটা খেয়ে বেরিয়েছ।” কিংশুক আজ বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করবে বলে বাড়ি আছে।

“কফি আর টুকটাক স্ন্যাক্স্‌ খেয়েছি হোটেলে। খিদে নেই। পেলে বাইরে কিছু খেয়ে নেব। তুমি সব খাবার ফ্রীজে তুলে দিও। আর মাংসটা ডীপ ফ্রীজ থেকে বার করে তলার তাকে রাখো। আমি সন্ধ্যায় গিয়ে রান্না করব।”

যাচ্ছি তো বলল। কিন্তু যাওয়া বিস্তর ঝামেলা। সাকেতে মেট্রো স্টেশন থাকলেও গুরুগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আট মিনিট হেঁটে জে ব্লকে গিয়ে বাস ধরে যেতে হবে জনক সেতু। বাসে উঠে বসার জায়গা পেয়ে বাসের ধারে জায়গা পেয়ে গেল। বেশ গুমোট, আকাশের সূর্যের তেজও যেন কমে এসেছে। জালনার ধারে লুয়ের বদলে হাওয়া খেতে ভালোই লাগছিল। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শনতে শুনতে জনক সেতু চলে এল। এর পর আবার মিনিট দশেক হেঁটে দিল্লী ক্যান্টমেন্ট স্টেশন।

সেখান থেকে ট্রেন ধরে তবে গুরুগ্রাম বা গুড়গাঁও। এই হ্যাপার জন্যই আসা হয়নি এতকাল। আজ ঐ লুচ্চা বুড়ো ভামটার কথায় জেদ চেপে যাওয়ায় একদিকে ভালোই হল। ট্রেনের জন্য অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। গুরুগ্রাম স্টেশনে নেমে আবার অটো। খুচখুচ করে অনেকগুলো টাকা শুধু একপিঠেই বেরিয়ে গেল।

খানিক খোঁজাখুঁজি ও অফিসের ডেস্কে ফোন করে হদিশ জেনে একটা বড় কিন্তু পুরোনো বহুতল বাড়ির সরু খাড়া অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো গেল। অফিসের রিসেপশনে নাম লিখিয়ে বসে রইল। সাকেতে বাসে ওঠার আগে ফোন করে দুপুর আড়াইটে থেকে তিনটের সাকষাতের সময় নিয়েই এসেছিল। ঠিক পৌনে তিনটেয় পৌঁছেছে। এইচআর একটা মিটিং করছেন। শুক্তি এসেছে শুনে অপেক্ষা করতে বলেছেন। অফিসের ভেতর কফি মেশিন থেকে ভুরভুর করছে কফির গন্ধ।

অপেক্ষা করছে তো করছেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষার ওর বিকেল ছ’টা নাগাদ ডাক পেল, যদিও মিটিং অনেক আগেই শেষ হয়ে অনেককে বেরোতে দেখেছে। মোটামুটি ফোনে ও ইমেইল মারফৎ যা আলোচনা হয়েছে সেটাই একটু বিশদে আলোচনা হল। কিন্তু চাহিদা বোঝালেও কোনও তথ্য দেওয়া হল না, বা কাজটা আধকারিকভাবে দেওয়া হল না। মানব সম্পদ আধিকারিক বললেন, “উই শ্যাল গেট ব্যাক টু ইউ ইফ উই হ্যাভ এনি সাচ রিকোয়ারমেন্ট। অ্যাকচুয়ালি উই হ্যাভ আওয়ার ওওন প্রোগ্রামার। ইয়েট আওয়ার প্রোজেক্ট ডিরেক্টর ওয়ান্টেড টু আউটসোর্স দ্য প্যাকেজ। বিকজ় দিস প্রোগ্রাম অ্যাকচ্যুয়ালি নীডস্‌ আ সিস্টেম অ্যানালিস্ট টু হ্যান্ডেল অ্যান্ড কমপাইল মাল্টিপল প্রোগ্রামস্‌। আওয়ার প্রোজেক্ট হেড উইল এক্সপ্লেইন ইউ বেটার ইফ ইউ আর অ্যাসাইনড উইদ দ্য জব।”

জোলো চা আর ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট দিয়ে গেল একজন বেয়ারা। ভদ্রমহিলার অনুরোধে এক দু চুমুক দিয়েও আর খাওয়া গেল না। কফি মেশিন থাকতে এই কদাকার চা দিল কেন কে জানে? মৌর্য শেরাটনের ডাইনিং-এ থরে থরে সাজানো পদগুলো একবার চোখে ভেসে উঠল। গন্ধটাও যেন স্মৃতিতে উঁকি দিয়ে গেল। কাজের কথা সেভাবে কিছুই পাকা হল না। এতবার ইমেইল করে ফোন করে ডেকে এনে, তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখে বলছে, দরকার থাকলে জানাবে?

ছোট্ট ঘুপচি অফিস ও ততোধিক সরু খাড়া অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার সময় যেন রাগারগো ক্ষমতা নেই। সবটাই ক্লান্তিতে ডুবে গেছে। নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা ও আশায় বেশ বুক বেঁধেছিল। কিন্তু এখন বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কোনও চাহিদা নেই যেন।

বাইরে যখন এল তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। আকাশে ঘনঘটা। জোরে বাতাস বইছে। ঝড়ের পূর্বাভাস। স্টেশনে যেতে কোনও অটো রাজি হচ্ছিল না। দুড়দাড় বৃষ্টি শুরু হল। কিংশুককে ফোন করল।

“এতক্ষণ কী করছিলে? এখন বেরিয়েছ? এদিকে আকাশ মেঘলা, গুমোট!”

“মেঘলা গুমোট কী গো? এদিকে তো প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে! কোনও অটো স্টেশন যেতে রাজি হচ্ছে বা। অগত্যা ওলা ডাকব ভাবলাম। সেও ব্যাটা রাইড ক্যানসেল করে দিল। ফিরতে কত রাত হবে কে জানে?”

“সকাল সাকল গেলে এতক্ষণ হয়তো ফিরে আসতে। আর গেলেই যখন ভদ্রলোককে ফোন করে যাওনি কেন? আজই যেতে হল? উঠল বাই তো কটক যাই? টুবাই তখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করছে মা কোথায় মা কোথায় করে? এখনই আটটা বাজতে চলল…”

“ভদ্রলোক নয়, মহিলা। ফোন করেই এসেছি। এইমাত্র হুস করে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বৃষ্টির জন্য আটকে আছি দেখেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না। অবশ্য আমিও অ্যাপ্রোচ করিনি। বৃষ্টি ধরে এলে আবার অটোওয়ালাদের সাধব। এই এই রাখছি – একটা অটোওয়ালা মনে হয় স্টেশন যাবে বলে ডাকছে।”

যদিও বৃষ্টির তুমুল প্রাবল্য একটু কমে এসেছে, তবে মোটেই ধরেনি। ঝমঝম করেই পড়ছে। অটোওয়ালাটা বোধহয় বিপন্ন মহিলা দেখে সাহায্য করতে এসেছে। নির্ঘাৎ ভাড়া বেশি নেবে। তা নিক, এছাড়া উপায়ও তো নেই।

“হাঁ হাঁ, স্টেশন জানা হ্যায়। ভাড়া কেয়া লিজিয়েগা?”

“যো ভী মিটার পেঁ আয়েগা ওহী দে দো ম্যাডাম। হাম গরীব জরুর হ্যায়, পর লাচার লোগোঁকো লুটতে নহী হ্যায়। আল্লাতালা কো জওয়াব ভী তো দেনা হ্যায়।”

আসার সময় রাস্তায় যেসব দৃশ্য চোখে পড়েছিল, ফেরার সময় সেগুলো চোখে পড়ছে না। হয়তো রাতের অন্ধকারে বৃষ্টিতে চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু এইরকম টালির বাড়ির পাড়া কি ছিল? এতটা সময়ও তো লাগেনি। চালককে প্রশ্ন করায় উত্তর পেল, “সব পানি পানি হো গয়া। দুসরে গলিসে যানা পড় রাহা হেয়। ইস লিয়ে তো কোই ভী অটো রাজ়ী হী নেহী হো রহা থা।” মোবাইলে ফোন করে জনৈক সামশেরকে কীসব বলল।

অটো চলছে তো চলছেই। এক জায়গায় অটো থামাতে আরও দু’জন পুরুষ উঠে এল। একজনের মাথায় সাদা জালি টুপি। পরস্পর পরিচিত বোঝা গেল। দিল্লী বা আশেপাশে শেয়ার অটোর ব্যবস্থা নেই। যে বুক করে সে মিটারে যায়। শুক্তির অটোতে বন্ধু বাৎসল্য করার আগে অনুমতিও নিল না! অবশ্য এই দুর্যোগে যেমন শুক্তি বিপাকে পড়েছে, ছেলেদুটোরও নিশ্চয়ই সাহায্য দরকার। তবু শুক্তির অস্বস্তি শুরু হল। যারা উঠেছে তাদের মুখে ভকভক করছে মদের গন্ধ, সঙ্গে একটা বোটকা গন্ধও মিশে আছে।

হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে অটো থেকে গেল। “উতরিয়ে ম্যাডাম।”

“লেকিন ইয়ে তো স্টেশন নেহী হ্যায়। কউন সী জগা পর লে আয়া?”

“ইয়েহী স্টেশন হ্যায়। উধার পুরা পানি পানি। ইঁহা সে পয়দল জানা হ্যায় আপকো।”

শুক্তি ব্যাগ খুলে প্রশ্ন করল, “ইয়ে জগা তো বিলকুল সুনসান হ্যায়। রেল কা সাইডিং লগ রহা হ্যায়। স্টেশন তো বহুত দূর লগতা হ্যায়।”

ড্রাইভার ছেলেটা বলল, “জন্নত জানে কী স্টেশন হ্যায় সালী…” বলেই বিশ্রীভাবে বুকে গুঁতো মারল।

“শরাফত সে পেশ আও। কিরায়া কেয়া হুয়া?–”

“তেরী সারী বটুয়া।” বাঁ পাশে বসা ছেলেটা নেমে কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। বাকি দু’জন খিক্‌খিকক করে হেসে উঠল।

“বহুত দের শরাফত কিয়া সালি রণ্ডী। রাতকো বহার ঘুমতী অউর কহতী এয় শরাফত সে বাত করোঁ?” চালক ছেলেটা বলল।

ওরা শুক্তির শার্ট ছিঁড়ে ওর মুখে গুঁজে বেঁধে দিয়েছে। ছিল তিনজন, কোথা থেকে আরও দুজন বাইক ভটভটিয়ে জুটে ছেঁড়াখোঁড়ার কাজে মত্ত হয়ে গেল। কানে কতগুলো নাম ভেসে এল – গুড্ডু, মুন্না, নিশাত, সামশের। কে কোনজন বোঝার উপায় নেই। দুর্গন্ধযুক্ত শরীর ও তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নাক মুখের কাছে এলে মনে পড়ল, মৌর্য শেরাটন হোটেলের লবিতে স্যাম কথা বলতে বলতে একবার হাঁটুতে হাত দিয়ে ফেলেছিল বলেই শুক্তি কতটা জ্বলে উঠেছিল। থাইল্যান্ড বা তাশখন্দে পাঁচ তারা হোটেলে সময় কাটানোর প্রস্তাব দেওয়াতে তো পারলে চড়িয়েই দিচ্ছিল। নোংরা পেচ্ছাবের দুর্গন্ধযুক্ত কাদাজলে মুখ থুবড়ে ডুবতে ডুবতে কিংশুক, টুবাই, মা, বাবা সবার মুখের সঙ্গে সঙ্গে মৌর্য শেরাটনের সুসজ্জিত ডাইনিং-এ থরে থরে সাজানো পদগুলো একবার চোখে ভেসে উঠল, যেগুলো সে হেলায় অবজ্ঞা করে ফেলে এসেছে সতীত্বের সংস্কার কিংবা নীতিবোধের অহমিকায়! সততার তাহলে এই পুরস্কার?

শুক্তির মোবাইল বেজে উঠল। একজন ছুঁড়ে ফেলে দিল রেল লাইনের দিকে। অটোগুলো আজকাল গ্যাসে চলে। কিন্তু বাইকের ট্যাঙ্কে তো পেট্রল থাকে।

 

বৃষ্টি ধরে এসেছে। এতক্ষণে রাস্তায় যান বাহন আবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে যদিও জন জমে গেছে জায়গায় জায়গায়। কিংশুক মাংস ফ্রীজের তলার তাক থেকেও বার করে ম্যারিনেট করে রেখেছে। বৌটা কখন ফেরে ঠিক নেই। ছেলে জানে রাত্রে চিলিচিকেন হচ্ছে। তাই নিজেই পেঁয়াজ রসুন কেটে রান্নার জোগাড় করে রাখছে। চাই কি নিজেই করে নেবে। আর গাজর বিনস কাটার বদলে ভারতীয় পদ্ধতিতে কাজু কিশমিশ গরম মশলা দিয়ে করলে ফ্রায়েড রাইসে বেশি ঝামেলা নেই। বাসমতী চাল তো পনেরো মিনিট ফুটলেই হয়ে যাবে।

টুবাই প্রশ্ন করল, “মা এল না বাবা?”

“ঠিকই চলে আসবে সোনা।”

“মা কখন আসবে বলল বাবা? ফোন করো না!”

“জানি না বাবু। ফোন তো করছি, বলছে নট রিচেবল।”