পরিযায়ী

0
1275

জয়িতা দত্ত সিনহা
————-
(১)
ভোর রাত থাকতেই উঠে পরে নিঃশব্দে ঘরের কাজ সারে রমলা, পাছে মেয়েটার এই সময় ঘুমের ব্যাঘাত হয়ে যায়। পার্কসার্কাসের রেল বস্তির এক চিলতে দাওয়া সহ একটা ঝুপড়ি ঘরে তাদের শাশুড়ি বৌ এর সংসার। তাড়াতাড়ি রান্না সেরে নিয়ে ডাউন ফার্স্ট ট্রেন ধরে তাকে যেতে হয় রোজ গড়িয়া পেড়িয়ে তার কাজের বাড়ীতে। সকাল ছটা থেকে রাত আটটা। এই তার রোজনামচা। দাওয়ার এক কোণে স্টোভটা ধরিয়ে ঘরে একবার উঁকি মেরে দেখে নিয়ে আস্বস্ত হয় সে। উঁচু হয়ে থাকা পেটে একটা হাত রেখে ঘাড়টা একটু ডান কাত করে মুখ হাঁ করে অঘোরে ঘুমোচ্ছে মলি। যে কোনও দিন তাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়তে হবে। তাই বোধহয় গতো ক’দিন ধরেই শারীরিক অস্বস্তিটা ওর এতো বেড়েছে। দরদর করে ঘাম হওয়াটা শুধু যে এই ঘুপচি ঝুপড়িতে আলো বাতাস না পৌঁছনোর কারনে নয়, তা বোঝে রমলা।
—” এইসময় একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোনো দরকার মেয়েটার। কিন্তু সারা রাত তা পারে কই?”
নিজের মনেই বিড়বিড় করে রমলা।
পেটের মধ্যে বড় হতে থাকা অনাগত দস্যিটার দস্যিপনার কল্পনায় বিভোর থাকতে থাকতে শরীরের সব কষ্ট ভুলতে চাইলেও মলির ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা শরীরের সাথে যে ওর মনটাকেও স্পর্শ করেছে তা চোখ এড়ায় না রমলার। তাই কালই রাতে শুয়ে শুয়ে সে ভেবে রেখেছে কালীতলার তার কাজের বাড়ীর বৌদিমণিকে বলবে দিন তিনেকের ছুটি দেওয়ার জন্য। বৌদিমনির মেয়েরও এই একই অবস্থা। তারই দেখা শোনার জন্যই সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় গত ছ’মাস ধরে রমলার ওবাড়ীতে কাজে লাগা। বৌদিমণিও মানুষ খারাপ নয়। মলির কথা জানার পর সে মাঝে মাঝে আপেলটা লেবুটা রমলা বেরোনোর সময় হাতে ধরিয়ে দেয় মলির জন্য। এখনকার দিনে এমন উদার ভালো মানুষের দেখা পাওয়া ভার। তাই রমলাও চায়না বিশেষ ছুটি করে তাদের অসুবিধায় ফেলতে। কিন্তু এখন যে রমলা নিরুপায়। যতীনটা এখানে থাকলে কিছু ভাবনা ছিল না। কিন্তু সেও এখন পাঁচ মাস হলো রোজগারের ধান্দায় অন্য রাজ্যে থাকে।

কাল খেতে বসে মলি বলছিল, পরশু থেকেই রেলবস্তির গলিতে নাকি দুটো পুলিশ রিক্সায় চোঙা ফুঁকে সাবধান করে গেছে বারবার, রাস্তায় না বেরোতে। সারাদিন ঘরে থাকতে। কি এক ভয়ানক রোগ নাকি সারা পৃথিবীতে হাজারে হাজারে মানুষকে মেরে ফেলছে। সে রোগ এখন এ শহরেও থাবা বসিয়েছে। রমলা মনে মনে ভাবে, এসব রোগ ভোগ তো সব শহরের বড় ঘরের বাবুদের জন্য। তাদের ঝুপড়িতে নামী দামী গাড়ী আর মানুষদের মতো এসব নামীদামি রোগও ঢুকতে নাক সিঁটকোবে। এমনকি ভোটের বাবুদের কাছেও এ বস্তির তেমন কোনও কদর নেই। জীবনটাতো কম দেখল না রমলা। সেই কোন কালে যতীনের বাপ যখন তার কোলে পাঁচ বছরের যতীন কে ফেলে রেখে নমিতাকে নিয়ে উধাও হলো, তখন থেকেই জানে সে জীবন কি। সেই যতীনই এখন বাপ হতে যাওয়া ২৪ বছর তরতাজা মদ্দ জোয়ান। ১৯ বছর আগের সেই সময়টা আজও রমলার মনে গতোকালের স্মৃতির মতোই তরতাজা। সেদিনের পর অনেক ঝরঝাপটা সয়ে পাঁচ বছরের যতীনের হাত ধরে অবশেষে ঠাঁই মিলল এই রেলবস্তিতে। নয় নয় করে এর মাঝের বছর গুলোও তো কম হয়ে গেল না। বাবুদের বাড়ী কাজ জুটিয়ে যতীনকে বড় করল। কতো রোগব্যাধি তারমধ্যে এলো গেলো, রমলা আর যতীনের জীবনে কিচ্ছুটি করতে পারেনি।

তাই আজও সে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে সব কাজ সেরে মলির জন্য রান্না গুছিয়ে মলিকে ডেকে সব বুঝিয়ে আশ্বস্ত করে যখন রেলপার দিয়ে হেঁটে সে পার্কসার্কাস স্টেশনে এসে পৌঁছল, তখন সূর্য পূব আাকাশে উঁকি মেরেছে। পাখীর ডাকে ভোরের কলকাতা ঘুমের চাদর সরিয়ে সবে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি কাটিয়ে আজ সোমবার কাজে গেলে এমনিই রমলার চাপ থাকে একটু বেশী। আজ তারমধ্যে মলির জন্য একটা চাপা অস্থিরতা বারবার তাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। মাস ফুরোতে আরও ৮ দিন। মলির কখন কি হয় কে জানে? তাই ভেবে রেখেছে, আজ কয়েকদিনের ছুটি চাওয়ার সাথে বৌদিমণির কাছ থেকে কিছু টাকাও আগাম চেয়ে নেবে।

আজ সন্ধ্যেবেলা বৌদিমণি একটু আগেভাগেই রমলাকে বাড়ী চলে যেতে বলল। সব গাড়ী ঘোড়া নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বেরোনোর আগে রমলা ছুটির আবেদন নিয়ে টাকার কথা বলার আগেই বৌদিমণি হাতে একটা ব্যাগ আর টাকার কটা নোট নিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। তার হাতে দিয়ে বলে,
–“এতে এই মাসের মাইনে সহ আরও কিছু টাকা বেশী দিয়ে দিলাম রমলাদি। এটা রাখো আর কয়েকটা দিন বাড়ীতে থাক। খুব দরকার ছাড়া বেড়িয়ো না। আমি না বলা পর্যন্ত এখানেও আর কাজে এসো না”।
বৌদিমণির এই আকস্মিকভাবে বলা কথার প্রতিক্রিয়ায় রমলার হতবুদ্ধিকর, বা কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে পরা দৃষ্টি বোধহয় বৌদিমনির চোখ এড়ায় না। একটু হেসে হাতের ব্যাগটা রমলার হাতে ধরিয়ে বলে,
” এখন সময় খুব খারাপ রমলা দি। চারিদিকে খুব খারাপ ছোঁয়াচে রোগে অনেক লোক মারা যাচ্ছে। তাই বলছি, তুমিও মলিকে নিয়ে সাবধানে বাড়ীতে থেকো। এতে কিছু চাল ডাল সব্জী দিলাম। কয়েকটা দিন তো তোমাদের চলে যাবে। তারপর দেখো, ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। সাবধানে এসো”।
কৃতজ্ঞতায় রমলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বড়রাস্তার দিকে।

আজ রমলার মন যেন সকাল থেকেই বড় উতলা হয়ে পরছে মাঝে মাঝে। কখনো কু ডাকতেও শুরু করেছে। অনেক খারাপ সময় রমলা জীবনে পেড়িয়েছে। এমনটা তো হয়নি কখনো।
আজ কে একটু বেশী সময় মলির সাথে কাটানো যাবে ভেবে ট্রেন থেকে নেমে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রমলা যখন বস্তির কাছে পৌঁছায়, তখন তাকে আসতে দেখে এগিয়ে আসে তাদের বস্তির শেফালী, সবিতা, মিনতিরা। তারা তাকে জানায়,
–“মলির যন্তনা খুব বাড়ায় আমাদের ছেলেরা তাকে নে গেছে কাছের ‘ ন্যাশনেল মেডিকেলে’। আর দেরী না করে তুমিও সেকেনে চলে যাও রমলাদি।”
খবরের আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে যায় রমলা। মাথার ভেতর যেন শুরু হয় হাজার নাগরদোলার পাক। চোখের সামনে সব অন্ধকার লাগে। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। জীবনে অনেক কঠিন সময় সে পেড়িয়েছে। আজ একটুতেই মনের জোর হারালে চলবে না। যতীন না আসা পর্যন্ত সামনে তার অনেক দায়িত্ব। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে নিমেষে ঠিক করে নেয় তার আশু কর্তব্য।
ঘরে ঢুকে বৌদিমণির দেওয়া ব্যাগটা রেখে সাথে ঘরে জমানো আরও কিছু টাকা নিয়ে রমলা সাথে সাথে দৌড়ায় ‘ন্যাশনেলে’। ঢুকতেই দেখা পায় বস্তির কালু বিশু রাজুর। ওরা সব যতীনেরই সমবয়সী। একসাথেই ওদের সব বড় হওয়া। তারা জানায়,
—” মলিকে ওরা নিয়ে নিয়েছে মাসী। ডাক্তার এলে ওকে দেখবে। তুমি চাইলে ততোক্ষন থাকতে পারো। নাও পারো। যতীনকে ফোন লাগিয়েছিলাম অনেকবার। কিন্তু ফোন লাগছে না। কেন কে জানে? তবে আমরা তো আছি। চিন্তা করো না”।

রমলা অসহায় হয়ে বসে পরে সামনের চাতালটায়। ঘরে ঢুকে জলও খায়নি। এখন কোমরের খুঁট খুলে ছোট জলের বোতল বের করে দু ঢোঁক জল গলায় ঢালে। পরম শান্তিতে একটু চোখ বুঁজতেই একে একে চোখের সামনে ভেসে ওঠে যতীনের মুখ, যতীনের বাবার মুখ, মলির মুখ। মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন এক সন্ধ্যেতে দাদা বৌদির সংসারে অবহেলায় বেঁচে থাকা বাপ মা- মরা মলিকে কালীঘাট থেকে সিঁদূর পরিয়ে বিয়ে করে এনে ঘরে তুলল যতীন। রমলা তখন ঘরের ভেতর এক গাদা ব্লাউজের অর্ডারি হেম সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। বাইরে থেকে ছেলে ডেকে মাকে বলল,
—” মা, দেখ কাকে এনেছি। এতোদিন আমরা দুই ছিলাম। আজ থেকে হলাম তিন। আমি তো তোমার তেমন খেয়াল রাখতে পারিনা। মলি তোমার এট্টু যত্নআত্তি করতে পারবে”, বলেই হি হি করে হাসিতে কেঁপে উঠেছিল ফাজিল ছেলেটা। না, সেদিন রমলা ছেলের ওপর একটুও রাগ করেনি। বরং মনে মনে আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, তার উড়নচন্ডে আপনখেয়ালে চলা ছেলে এবার অন্তত হাতুড়ি ছেনি নিয়ে পাথর খোদাই এ শিল্প কর্মের খেয়াল ছেড়ে একটু সংসারী হয়ে উপার্জনে মন দেবে। ছোট থেকেই যতীনের এই এক নেশা৷ হাতের কাছে হাতুড়ি ছেনির মতো কলকব্জা পেলেই ইঁট পাথরের ওপর খোদাই এ বসে যেত। গতরে শক্তিও তো প্রচুর। চওড়া কাঁধের সাথে গুলি পাকানো হাতের রোদে পুড়ে তামা হয়ে যাওয়া উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার ২৩ বছরের টগবগে ছেলেকে যে কোনও কাজ দিলে অবলীলায় হাসিমুখে করে দিত। কিন্তু দোষ একটাই, কোনও কাজে মতিস্থিরতা নেই। তাদের মতো দিন আনতে পান্তা ফুরোনো ঘরে কি শিল্পীর কদর হয়? কিন্তু সে ছেলে বুঝলে তো!

তারপর একদিন দুমাস না যেতেই পোয়াতি হলো মলি। সেদিন বোধহয় টনক নড়ল ছেলের। উতলা হলো কাজের জন্য। শ্যালদা স্টেশানে কুলি গিরি থেকে বৈঠক খানা বাজারে সব্জীর গাড়ি খালাস সব কাজই করতে শুরু করেছিল। তারমধ্যেই একদিন পাড়ার রবি ওকে নিয়ে গেল আলিপুরে মারোয়াড়ি বনোয়ারি লালের বাড়ীর ম্যুরাল তৈরীর কাজে। সেখানে একমাস কাজের পর বনোয়ারীজি তার কাজে খুশী হয়ে তাকে বলেছিল, জয়পুরে তার মার্বেলপাথরের কারখানায় থাকা খাওয়া সহ ৬০০ টাকা রোজে কাজে লাগতে। সেদিন ছেলের আনন্দ দেখে কে। খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে যাওয়া স্বপ্নের ঠাসবুনোটের চকচকে চোখে সুখের দিনের কতো আশার গল্প মলিকে আর রমলাকে শুনিয়ে রমলার জিম্মায় মলি কে রেখে ঘর ছেড়েছিল সেদিন।

তারপর মাস দুয়েক বাদে দিন দশেকের জন্য বেশ কিছু টাকা নিয়ে বাড়ীতে এসেছিল সে। যাওয়ার আগে একটা মোবাইল কিনে দিয়ে গিয়েছিল। সেও তো তিন মাস হয়ে গেল। কথা দিয়ে গিয়েছিল, মলির প্রসবের সময় খবর দিতে। ঠিক চলে আসবে।
গতো তিনদিন ধরে মলি ফোনে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছুতেই তাকে ধরতে পারে নি। ক্রমশ মন মরা হয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা। রোজ রাতে শোবার আগে শেষ ট্রেন যাওয়া পর্যন্ত দূর স্টেশনের দিকে চোখ রেখে বসে থাকত। ঘরে থাকলে কান যেন পাতা থাকত দূর থেকে আগত আচমকা কোনও পরিচিত স্বর শোনার আশায়। যতীনের ফেলে যাওয়া ছেনি হাতুড়ি গুলো রোজ নেড়ে চেড়ে দেখে আবার জায়গায় রেখে দিত। অবশেষে হতাশ হয়ে চুপ চাপ শুয়ে পড়ত মেয়েটা।

(২)

এবার কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর থেকেই যতীন যেন কেমন বড় বেশী চুপচাপ। না, কাজে তার কোনও গাফিলতি নেই। বরং, বাইরের এই হঠাৎ তৈরী হওয়া শান্তু প্রকৃতি ভেদ করে কখনো কখনো যেন ভেতরের চাপা অস্থিরতা বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতো প্রবল বেগে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায় তার। ভৈঁরোজী খেয়াল করে দেখেছেন, তখন যেন ছেনি হাতুড়ি আরও বেশী আপন হয়ে যায় যতীনের। রাতের পর রাত জেগে পাগলের মতো কাজ করে একেকটা শৈলী কি নিপুণ ভাবে সৃষ্টির নেশায় মেতে ওঠে তখন৷ ভুলে যায় নাওয়া খাওয়া। এই নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা তো কম হলো না ভৈঁরোর। কিন্তু এই ছেলেটাকে তিনি যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননা। এর মাঝে সে একটা কাজই নিয়মিত করে। হর রোজ তিনবেলা নিয়ম করে দেশে ফোন করে তার জেনানার তবিয়তের খোঁজ নেয়। রাতে দুজনে অনেক্ষণ বাত ভি করে। তখন ছেলেটাকে প্রাণ ভরে হাসতে দেখা যায়।

ঠিক এমন ভাবেই যতীনও বেঁচে থাকে মলির ভাবনা নিয়ে। সে ভাবে, তার জীবনের হাসির কারন তার মলি। এই মলিকে নিয়েই সুখী হওয়ার স্বপ্ন চোখে রেখে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে তার ঘর ছাড়া। প্রিয় শহর আর শত দুঃখেও গায়ে আঁচ লাগতে না দেওয়া মাকে ছেড়ে এতো দূরে আশা। সে প্রতিদিন হিসেব রাখে মলির দিন এগিয়ে আসার। আর তো দিন দশেক বাকী আছে হাসপাতালের টিকিটের হিসেবে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে সে, মলির মা হওয়ার সময় এক মাসের ছুটি নিয়ে ঘরে যাবে। তারজন্য এই তিন মাস ধরে অতিরিক্ত কাজ করে তিল তিল করে টাকা জমিয়েছে সে। যতীন চায়, তাদের মলির মতোই একটা ফুটফুটে মেয়ে হোক। সাধ্যের বাইরে গিয়ে তাকে বড় করবে, মানুষ করবে, নিজের স্বপ্ন দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলবে জ্যান্ত পুতুলটাকে৷ মনের মতো করে সাজাবে। তারজন্য অনেক অনেক টাকার দরকার। তাই এবার দেশ থেকে ফিরে ছমাস আর বাড়ী যাবে না। অনেক টাকা জমিয়ে একেবারে দেশে ফিরে ওখানে যাহোক কিছু ছোটোমোটো ব্যাবসা করে মা কে আর মলিকে নিয়ে চোখের সামনে পুতুলটার বড় হওয়া দেখবে। কালই ভৈঁরো সর্দারের কাছে সাতদিন পর একমাসের জন্য দেশে যাওয়ার আর্জি করতে হবে। এমনিতে মানুষটা মন্দ নয়। কিন্তু ছুটি দিতে চাইবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।

পরদিন সকালে নিয়ম মতো কারখানায় হাজিরা দিয়ে ভৈঁরোজীর কাছে যায় যতীন। উঁচু লম্বা শরীরটা বিনয়ে নত করে জোড়- হাতে যখন সর্দারের কাছে ছুটির আর্জি জানায়, অচানক এমন অদ্ভুত মউজ এ ভৈঁরোজি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বিস্ফারিত চোখে ক্ষনকাল তাকিয়ে থাকেন যতীনের দিকে। বুঝতে খানিক সময় নেন যতীন মজাক করছে কি না। যতীন যখন তাঁর মনের ভাব বুঝে পুনরায় আর্জি জানায়, তখন তাঁর সম্বিত ফেরে৷ এবং প্রথমেই নস্যাৎ করেন এমন অবাস্তব আর্জি। যতীন তার সবচেয়ে এলেমদার কারিগর। এমনিতেই চারদিকে হাওয়ায় গুজব উড়ে বেড়াচ্ছে, দেশে নাকি কি একটা আজব রোগ চায়না থেকে ঘুসে গেছে যার জন্য কাম কারবার যেকোনও দিন বন্ধ হতে পারে। তারমধ্যে যতীনের এমন বেয়ারা আর্জি মানা যায় না। তবু ভৈঁরোজির মনটা তো পাষাণ নয়। তাই বহু অনুনয় বিনয়ের পর একমাস নয়, সাত দিন পরে দশদিনের ছুটি যতীনের মন্জুর হয়েছিল এই শর্তে যে আগামী সাত দিন যতীন দ্বিগুণ খেটে দশদিনের কাম তুলে দিয়ে যাবে। প্রস্তাবটা অবশ্য ছুটি পেতে মরিয়া যতীনই দিয়েছিল। ভৈঁরো জানতেন, এমনটা অসম্ভব। সূরয সেদিন আসমানে থাকবে না যেদিন এক আদমী সাতদিনে শুধু ছেনি হাতুড়ি দিয়ে দশদিনের কাজ করে দেবে। কিন্তু যতীন তার কথা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছে।
চার দিন ধরে প্রায় একটানা দিবারাত্র কাজ করে যখন কাঁধের বাহুমূল থেকে যতীনের হাত খসে পড়ার উপক্রম, ছেনি হাতুড়ির ঘষায় দুটো হাত তার ক্ষতবিক্ষত, ঝাঁকড়া চুলের গ্রীক ভাস্কর্যের মতো খোদাই করা মুখে উন্নত নাসার দুপাশে উদ্ধত চওড়া কপালের নীচে কাটা কাটা উজ্জ্বল গভীর দুই চোখ যখন আরক্ত, তখনও কি এক উন্মত্ত নেশায় কাজে বিভোর হয়ে থাকতে চায় যতীন। ছুটি যে তাকে পেতেই হবে। তার মলির কাছে তাকে যে করেই হোক পৌঁছাতে হবে। তারজন্য সর্দারকে দেওয়া কথা রাখা জরুরী। কিন্তু ক্লান্তিতে তার যন্ত্রনায় নীল হয়ে যাওয়া শরীর বিদ্রোহ করতে চায়। হাত দুটো হতে চায় তার অবাধ্য। বোধহয় এই প্রথম।
এরই মধ্যে চতুর্থ দিন রাতে অতিরিক্ত পরিশ্রমে যখন যতীনের বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল, ভৈঁরোজী এসে দাঁড়ালেন যতীনের সামনে। যতীন ক্লান্ত চোখ তুলে তাকালে বেশ খানিক্ষন নিঃশব্দে তাকে দেখে গলাটা একটু কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন,
—“শহরে এক অজানা রোগ তাড়া করছে।সব বন্ধ হয়ে যেতে চলেছে। এরপর গাড়ী ঘোড়াও সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তোর বাড়ী যাওয়ারও আর কোনও উপায় থাকবে না। সেজন্য ঝুটমুট এতো চাপ তোর না নেওয়াই ভাল।”
এ কথা শুনে বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে হতাশায় স্তব্ধ হয়ে যায় যতীন।
কিছু বলার মতো ভাষা তার মনে আসে না। শরীরের যন্ত্রণা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে ওর মনটাকেও।

সর্দার চলে যেতেই বাইরে এসে দাঁড়ায় খোলা আকাশের নীচে। চোখ চলে যায় গাঢ় কালো আকাশের দিকে, যার বুকে তখন জ্বল জ্বল করছে অগুন্তুি তারা। দিশাহীন যতীন অপলক সেদিকে তাকিয়ে যেন দিশা খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। হাল্কা হাওয়া ছুঁয়ে যায় যতীনের মুখ। পলকে ওর চোখে ভেসে ওঠে পার্কসার্কাসের রেলবস্তির ঘরের হুকিং করা হলদে আলোর সেই উষ্ণতার রাত, ঠিক এমনি হাওয়ার মতোই মলির ঘন কালো চুল ছুঁয়ে গিয়েছিল তার ঠোঁট, তার গাল, তার মুখ। সেসব রাতের কথা মনে পড়ায় আবার আবেশে চোখ বোঁজে যতীন। মনে পড়ে যায় মলিকে দেওয়া তার কথা, তার পাশে থাকার কথা, তাকে সুখের স্বপ্ন দেখানোর কথা। আর থাকতে পারেনা যতীন। অস্থির হয়ে ওঠে তার সমস্ত শরীর। ইস্পাত কঠিন দৃঢ় হয়ে যায় তার চোয়াল। তাকায় তার দুহাতের দিকে। মনে মনে ভাবে, হাতে ক্ষত হলেও পা দুটো অক্ষত। ঠিক করে, পালাতে হবে। রাত থাকতেই বেড়িয়ে যাবে তার যা জমেছে সেই সম্বল নিয়ে। আর ফিরবে না এখানে।

যেমন ভাবা তেমনি কাজ। রাত থাকতেই রওনা দেয় রেল স্টেশনের দিকে। ট্রেন তো চলছে এখনও। কোনও মতে দিল্লী পৌঁছাতে হবে। শুক্রবার ভোর রাতে সে চিরকালের জন্য জয়পুরকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা করে দিল্লীর উদ্দ্যেশ্যে। শনিবার বেলার দিকে দিল্লী পৌঁছে দেখে সব জায়গায় তার মতো কাজ করতে আসা ভিনদেশী শ্রমিকরা উদ্ভ্রান্তের মতো জড়ো হয়েছে দিল্লি স্টেশনে। সবারই কি এক অজানা আশঙ্কায় ঘরে ফেরার তাড়া। কিন্তু কোনও ট্রেনে তিলধারণের জায়গা নেই। এই করে কেটে যায় শনিবার সারাটা দিন। ভুলে যায় মলিকে ফোন করার কথা। শুনতে পায়না ব্যাগের ভেতরে ক্রমাগত বাজতে থাকা ফোনের আওয়াজ। রবিবার শুনল, জনতাকার্ফু না কি কারনে ট্রেন বন্ধ। দিশাহারা হয়ে ওঠে সে। তার সাথে আরও অগুনতি শ্রমিক। সবার তখন একটাই আর্তি, পেটে ক্ষিদে নিয়ে তৃষ্ণা ভুলে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে শুধুই ঘরে ফেরার আর্তি। অবশেষে আরও অনেকের মতো সেও ঠিক করে, হাঁটতে হবে। হেঁটে পেরিয়ে যেতে হবে সমস্ত বাধা। পৌঁছাতে তাকে হবেই তার মলির কাছে।

হাঁটতে শুরু করে যতীন। একটা যতীন নয়, আরও আরও অনেক অনেক যতীন। অগুন্তি যতীন। রাজপথ ধরে হেঁটে যেতে থাকে সহস্র যতীনদের কালো কালো মাথা। খাদ্য নেই। তৃষ্ঞা কখনো মিটেছে পথের ধারের জলের কল থেকে। বেশীর ভাগ সময়েই তার দেখা পায়নি হাঁটতে থাকা যতীনরা। তবু মরিয়া হয়ে হাল ছাড়েনি। হাজার হাজার যতীনের হেঁটে চলার সাক্ষী হয়েছে পথের দুধারের গাছ পালা। পাখীরাও বোধহয় অবাক হয়ে ডাকতে ভুলে গেছে। যতীনদের সন্ত্রস্ত হয়ে ফেলতে থাকা অনিশ্চয়তায় হতাশার নিশ্বাসে বাতাস যেন সেদিন বড্ড বেশী ভারী হয়ে গিয়েছিল। বাক্যহীন হয়ে শুধু দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া ছাড়া যতীনদের সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। অবশেষে সোমবার মাঝরাতে তারা পৌঁছোয় উত্তর প্রদেশের কোনও এক শহরে। অন্নহীন, প্রায় জল হীন মাইলের পর মাইল রাস্তা হেঁটে পার হওয়ার পর রাস্তার ধারে ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছগুলোর মতো নুইয়ে পড়েছিল সেদিন যতীনদের শরীরগুলো। অসাড় পা গুলো তখন পাহাড়ের থেকেও বেশী ভারী। এরই মধ্যে যন্ত্রনায় ক্লান্তিতে কখন চোখ বুঁজে এসেছিল জানেনা যতীন। চোখ খুলল, ভোরের আলো চোখে পড়ার সাথে। অনেক লোকের গলার আওয়াজ কানের সাথে মনের গভীরে ধাক্কা মারল প্রবল ভাবে। সেসব আলাপচারিতায় সে বুঝল, তাদের আর কোথাও যেতে দেওয়া হবে না। সেই মারণ রোগ এ শহরেও ঢুকে পরেছে। তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য যতীনদের নিয়ে যাওয়া হবে তাদের মতো সব পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য তৈরী হওয়া কোনও এক ক্যাম্পে। তার আগে হবে তাদের জীবাণু মুক্তিকরনের কাজ। কিছুক্ষণ বাদে এলো অনেক লম্বা পাইপ লাগানো গাড়ী নিয়ে অনেক লোক। তাদের সারসার দিয়ে বসিয়ে, সেই গাড়ীর যন্ত্র চালিয়ে তীব্র ঝাঁঝাঁলো গন্ধযুক্ত এক তরল পদার্থের ঝরনায় তাদের আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিয়ে গেল তারা। যেন জীবাণু নয়। গরীব হওয়ার কারনে, শ্রমজীবি জীবনের অপরাধের বহুদিনের জমে থাকা পাপমুক্তি করাতে চাইল এই প্রক্রিয়ায়। তারপর মঙ্গলবার সকালে সেই ভেজা শরীরে অভুক্ত পেটে যেন হাজার বছরের জমে যাওয়া ক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল সেই অজানা গন্তব্যের দিকে।

হাজার হাজার যতীনের মাঝে এক যতীন কখন যেন হাঁটতে হাঁটতে দলছুট হয়ে পথের পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল সে খোঁজ রাখল না কেউ। শুধু কয়েকশো কিলোমিটার দূরে ‘ন্যাশনেল মেডিকেল’ নামের এক সরকারী হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের বেডে ঘন্টা কয়েক আগে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের সদ্য মা হওয়া বছর কুড়ির তরুনী লাল মাংস পিন্ডকে পাশে নিয়ে প্রাণ পণে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছিল সেই লোকটাকে। যে লোকটা কথা দিয়েছিল পাঁচ দিন আগেও ফোনে, সে আসবেই একবুক ভালোবাসা নিয়ে তার কাছে। সাথে আনবে অনেক অনেক সুখ। দুচোখ ভরা স্বপ্ন। কিন্তু মেয়েটা জানেনা, তার সেই ফোন আর কখনো ঐ লোকটার কাছে পৌঁছবেনা। সেদিনের সেই লক্ষকোটি হত জীবাণুর মতো সেও এক জীবাণু হয়ে হারিয়ে গেছে চিরতরে। বিলীন হয়ে গেছে না ফেরার দেশে।