প্রণাম

মাছের বাজারেও এত হট্টগোল নেই, বিশেষ করে শনিবার বিকেলের দিকে মনে হয় নিজের কথাও হেডফোন লাগিয়ে শুনতে হবে শাহানারা দুটো চিকেন স্যান্ডুইচ প্যাক করে দিতে বলল বাড়ি ফিরে কফি বানিয়ে নেওয়া যাবে বেশ কয়েকদিন পরে সবিতার সঙ্গে দেখা হয়েছে

শাহানারা স্কটিস চার্চ কলেজে অঙ্কে অধ্যাপনার চাকরি পেয়েছে সদ্য চাকরি পাওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ অধ্যাপকের অধীনে গবেষণা শুরু করছে সবিতা বিএসসি ও এমএসসিতে যথাক্রমে বিশ্বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। গবেষণাও শেষের পথে বিদেশের সায়েন্স জার্নালে ওর আর ওর গাইডের যৌথ গবেষণাপত্র বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে কলেজ সার্ভিস কমিশনে পাস করেও এখনও পাকা চাকরি পায়নি, অতিথি অধ্যাপিকা হিসাবে আনন্দমোহন বা সিটি কলেজে যোগ দিয়েছে

দুই বন্ধু সহপাঠিনী ছিল প্রেসিডেন্সি মহাবিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটোতেই দুরন্ত ফল নিয়ে, গবেষণার কাজও অনেক দূর এগিয়ে এবং সেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সবিতার চাকরি ঝুলে আছে কোনও মতে সিটি কলেজে গেস্ট লেকচারারর প্রাণের বন্ধু বিএসিতে সেকেন্ড ক্লাস ও এমএসসিতে কোনও মতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েই স্কটিশের মতো কলেজের অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস আছে সবিতার সেটা গোপন করতে এবং দুজনেরই নিজস্ব ব্যস্ততার কারণে কাছাকাছি কর্মস্থল হওয়া সত্ত্বেও দেখাসাক্ষাত কম হয় আগে কলেজের পর বা ক্লাসের ফাঁকে প্রায় প্রতিদিন কফি হাউস কিংবা মাঝে মাঝে প্যারামাউন্ট ছুটত

কফি হাউসের সুবিধা হল এক টেবিলে বারো তেরোজন পর্যন্ত ভিড় করে বসে ছসাত কাপ কফি কাপে ও গ্লাসে ভাগ করে নিয়ে যতক্ষণ খুশি গ্যাঁজাও, কেউ তাড়া দেবে না তবে তাড়া না দিলেও বেশিক্ষণ বসলে ঠিকই খেপে খেপে অর্ডার দেওয়া হয় ছাত্রী জীবনে সিঁদুর শাঁখা পলার নিয়ম, পণপ্রথা, বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে স্বামী স্ত্রী বলা যেগুলোর অর্থ যথাক্রমে প্রভু ও মহিলা – ইত্যাদির বিরুদ্ধে দুই বন্ধু সমস্বরে কম গলা ফাটায়নি পণপ্রথা যেখানে মেয়েদের অসম্মানের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকিও, সেখানে দেনমোহর তুলনায় যেন মেয়েদের অনেকটাই আর্থসামাজিক নিরাপত্তার আশ্বাস – এসব নিয়ে মতান্তর হয়নি কখনও

একবার ওদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া বান্ধবী শাবানার সঙ্গে দেখা মেয়েটার মুখ থমথমে অনেক প্রশ্ন করায় বলল, “আমি আজ তিন মাস বাপের বাড়ি কামারহাটিতে পেটে বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম আলট্রাসোনোগ্রাফিতে মেয়ে শুনে খুব রাগারাগি করেছিল আসলাম তারপর ভালো মানুষের মতো বলল, তুমি এখন তোমার আম্মির কাছে থাকো, ও বাড়িতে গিয়ে খাটাখাটনির দরকার নেই তারপর নিজে বহরমপুর ফিরে গিয়ে আমাকে ফোনে তিনবার তালাক শুনিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে কোনও মতে মানুষ করছি বাড়িতে আবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে আজ ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির দ্বারভাঙা হলে মুসলিম মহিলাদের একটা মিটিং আছে সেখানে সব বড় বড় লোকেরা লেকচার দেবে আমার মতো ভিক্টিমদেরও ইনভাইট করা হয়েছে শাহানারা যাবি?”

শুধু শাহানারা নয়, সবিতাও সঙ্গে গিয়েছিল অনেক পুরুষ বুদ্ধিজীবীও এসেছিল তারা কেউ বহুবিবাহ বা যখন তখন তালাক দেওয়ার মধ্যে কোনও সমস্যার সন্ধান পেল না নারীর জীবনে পুরুষ ও গর্ভধারণ কতটা জরুরি, তাই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাঁটাল যে যার মতো একজন যদিও বা তাৎক্ষণিক তিন তালাকে সমস্যা হতে পারে মেনে নিল, কিন্তু সমস্যা সমাধানের উপায় থাকতে পারে মানল না ভুক্তভুগী মেয়েদের কথা শোনা হল আয়োজক ভদ্রমহিলা একপ্রস্থ দাবি সনদ ঘোষণা করলেন যা পুস্তিকাকারে সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছিল সবিতা পাঁচ টাকা দিয়ে কিনেছিল অনুষ্ঠান শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে সবিতা প্রশ্ন করে, “আপনারা শুধু শরিয়তি আইনের মধ্যে নারীর জন্য কিছু অধিকার চাইছেন বোঝা গেল যা ভারতের শরিয়তি আইনে আছে, সেটাই যেন যথাযথ পালন হয়, তার দাবি করছেন কিন্তু ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু হলে তো এত কিছু ভাবতেই হয় না সেটা দাবি করছেন না কেন?”

সভার মধ্যে মুহূর্তকাল নীরবতার পর প্রশ্নটাকে এমনভাবে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল, যেন ওর কথাগুলোর কোনও মানেই হয় না সে পাত্তা না দিক, অনুষ্ঠানের শেষে ঠাণ্ডা মাটন বিরিয়ানির প্যাকেট দিয়েছিল তবে শাহানারা বেশ বিরক্ত গলায় বলেছিল, “তুই বড্ড লুজ় টক করিস

কেন?”

একটা সেকিউলার দেশে কোনও ধর্মে হস্তক্ষেপ করার অধিকার স্টেটের নেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড কোনও সলিউশন নয় শরিয়তি আইন একটা অত্যন্ত সায়েন্টিফিক আইন, তার অপব্যবহার হচ্ছে, সেটাই আটকাতে হবে ইন্ডিয়া গর্ভনমেন্ট নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না

সেদিন ঝগড়া কলকাতার মিটিং থেকে কাশ্মীর উপত্যকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল বেশ খানিক্ষণ তর্কাতর্কির পর দুজনের মধ্যে কিছুদিন বাক্যালাপ বন্ধ ছিল সবিতা দেখেছিল নারীবাদী আন্দোলনকে শাঁখা সিঁদুর মনুবাদের বিরুদ্ধে গলা ফাটানোর মধ্যে সীমিত রাখাই নিরাপদ শুধু শুধু জটিলতা কার ভালো লাগে?

আজ প্রায় বছরখানেক পর দেখা সেই কফিহাউসে। কোনও বিবাদ নয়, ছাত্রীজীবনে পড়ার চাপের মধ্যেও কতরকম মজা করত সেই স্মৃতিই উথলে উঠল যার যার গবেষণার বিষয় থেকে শাহরুক, হৃত্বিক, অক্ষয়, আমীর নিয়ে খলখল করে যেতে লাগল শাহানারা কিছুতেই ছাড়বে না বেলেঘাটায় নিজের বাড়িতে ধরে নিয়ে চলল ছাত্রী জীবনে দু একবার গিয়েছিল সবিতা বন্ধুর বাড়ি

এতদিন পর যাচ্ছিস, শুধু স্যান্ডুইচ খাওয়াব? এখানে একটা দোকানে যা কাবাব বানায় না – দাঁড়া, বাসায় ঢোকার আগে কিনে নিই

কীসের কাবাব?”

খেয়ে দেখ না খেলে জীবনে ভুলতে পারবি না

থাক না শাহানারা কতদিন পর দেখা, গল্পটাই জমিয়ে করি স্যান্ডুইচেও মাংস, কাবাবেও মাংস – এই সময় আর ইচ্ছা করছে না বরং আমি মিষ্টি কিনব, একটা ভালো দোকান দেখে নিয়ে চ

বুঝেছি তোদের আর এ জীবনে ইনহিবিশন কাটবে না” ঐ সমাজের ঐটুকু ঘুপচি বাড়ির মেয়ে হয়েও অল্পবয়সে বিয়ে করার বদলে সম্মানজনক চাকরি করে শাহানারা আত্মনির্ভর এটুকু গর্ব করা তার সাজে

ইনহিবিশন বলিস বা রুচি যাই হোক তুইও কি পোর্ক খেতে পারবি? এমনকি একটু আগে দেখলাম দোকান থেকে ময়দা কিনলি সেটাও হালাল সার্টিফিকেশন আছে কিনা দেখে আমি আজকেই প্রথম জানলাম নিরামিষ আইটেমেরও হালাল হারাম হয়।

বাসায় আমি একা থাকি না। সবার কথা ভাবতে হয়। ইটস্‌ দেয়ার চয়েস। তোদের হেঁসেলে কি বীফ্‌ ঢুকবে? এই সে এতদিন ধরে তোদের সঙ্গে কফিহাউসে কত সময় কাটিয়েছি, এক প্লেট থেকে খেয়েছি, তার পরেও তোরা আমাদের কালচার আপন করতে পারলি না।”

ঠোঁটের কোনে ঈশৎ হাসল সবিতা, “আজ লক্ষ্য করলাম, কফি হাউসে সবকটা বাবুর্চি তোদের কমিউনিটির তাই হালাল চিকেন ছাড়া হেঁসেলে ঢুকবেই না তাই হয়তো নিশ্চিন্তে ওখানে খেতে পারিস আর আমি ভাবতাম কফিহাউসে ছেলেমেয়ে সব বন্ধুর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিস, কমিউনিজ়ম নিয়ে কথা বলছিস – মানে কত প্রগ্রেসিভ। আমরা কিন্তু ওসব নিয়ে মাথাই ঘামাই না, শুধু কিছু মাংসে রুচি হয় না; যেমন শূয়োরের মাংস আমিও খেতে পারব না এনি ওয়ে বাদ দে কতদিন পরে আসছিমিষ্টি তো হারাম হয় না” বলে লঘু করার জন্য হাসল

শাহনারাও হাসল তবে ঠাট্টা রসিকতার পথ বেয়ে ক্রমশ ঢুকে পড়ল ব্যঙ্গ বিদ্রূপ। “ভারতীয় পিতৃতন্ত্রে মেয়েদের মুক্তি নেই তোদের তেত্রিশ কোটি দেবতার যা কীর্তি কলাপ, তাতে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণসো কলড্‌ পুরুষোত্তম রাম সীতাকে কখনও পুড়িয়ে মারতে চায় তো কখনও জ্যান্ত গোর দেয় পাতাল প্রবেশ মানে কী, জ্যান্ত কবরই তো আর কৃষ্ণের মতো লম্পটও তোদের পরম আরাধ্য।”

তেত্রিশ কোটি মানে তেত্রিশের পিঠে সাতটা শূন্য নয়, তেত্রিশ প্রকার বোঝায়। আর আমাদের দেবদেবীদের ভালোমন্দের সমালোচনা করার হিম্মত আমরাই দেখাই। তোদের মতো প্রোফেট রূপ ডিক্টেটরকে অভ্রান্ত দেবতা বানাই না।”

মহম্মদ পয়গম্বর, আল্লার প্রেরিত মানুষ, আল্লা নন। ওসব দেবতা টেবতা বানানোর কনসেপ্ট আমাদের নেই।”

কিন্তু আমরা দেবতাদেরও দোষ ত্রুটি দেখতে পাই যেখানে তোদের মানুষ পয়গম্বরের বচনকে তো চ্যালেঞ্জ এমনকি রেক্টিফাইও করা চলবে না। আমাদের দেবদেবীরা বেশির ভাগই সিম্বলিক, প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক। তাদের মধ্যে মনুষ্যোচিত দোষগুণ মানুষই আরোপ করেছে, আবার মানুষই বিচার করতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস যেমন আছে, তার বিরোধিতা করার জায়গাটাও কিন্তু আমাদের ধর্মেই রয়েছে।”

তাই যদি হয়, তাহলে কৃষ্ণের সঙ্গে তার নিজের মামীর অবৈধ প্রেম নিয়ে আদিখ্যেতা করতে পারতিস না

ফার্স্ট অব অল রাধা কৃষ্ণের মামী ছিল সেটা কোন সোর্স থেকে পেয়েছিস? মহাভারতে রাধার কোনও উল্লেখ নেই কৃষ্ণের প্রেমিকা হিসাবে বিশেষ গোপিনীর উল্লেখ আছে ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণে, আর সেই বিশেষ গোপিনীর রাধা নাম প্রথম পাওয়া যায় গীতগোবিন্দে কোথাও রাধাকে কৃষ্ণের মামী বলা নেই কৃষ্ণ তো ক্ষত্রিয় সন্তান, আসল মা বাবা দেবকী আর বাসুদেব আয়ান ঘোষ কোন সূত্রে দেবকীর ভাই ছিল? তার বৌ গোপিনী রাধাই বা কী করে ক্ষত্রিয় কৃষ্ণের মামী হবে? যদি ধরেও নিই পালিকা মা যশোদার কোনও সম্পর্কের ভাই ছিল আয়ান ঘোষ, তাহলেও কত দূর সম্পর্কের ভাই যে তাদের কৃষ্ণ তাদের চিনতই না…”

ওসব সাফাই গেয়ে লাভ নেই রিলেশনটা অবৈধ ছিল, সেটা তো মানবি

পৃথিবীর সেরা প্রেমকাহিনীগুলোর কটাতে নায়ক নায়িকা পরস্পর বরবৌ? লায়লা মজনু, হীর রাঞ্ঝা, ইসল্ট্ত্রিস্তানতেমনই রাধাকৃষ্ণকৃষ্ণ রাধাকে কষ্ট দিলেও আমাদের ধর্ম তো রাধার প্রেমকে অমর করে দিয়েছে, তাকে শাস্তি দেয়নিভালোবাসার বৈধ অবৈধ কী? যাকে দেবতা বলি তারও কৈশোরে চপলতার কথা স্বীকার করি, আবার পরিণত বয়সে নিজের রাজকার্যে নিবিষ্ট হয়আর রাধা শুধু তার ভালোবাসার জোরেই দেবী।”

হুহ্‌! ঐ লম্পট তোদের দেবতা! নিজের চেয়ে বয়সে বড়ো মামীর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি…” শাহানার কিছুতেই লাম্পট্য তত্ত্ব থেকে সরবে না আর রাধাকেও কৃষ্ণের মামী বানাবেই

সবিতা গলা তুলল, “কৃষ্ণ লম্পট তো? ফাইন, তোর কথা মতে বয়সে বড়ো এক নারীর সঙ্গে অবৈধ প্রেম করেছিল কিন্তু তোদের ঐ পিডোফাইলের তো দারুণ রেঞ্জ – কখনও ষোলো বছরের বড় মহিলাকে বিয়ে করে ব্যবসার সুবিধারর্থে, আবার কখনও ন’ বছরের কচি মেয়েকেও রেহাই দেয় না কৃষ্ণ কোনও মেয়ের সঙ্গে জবরদস্তি করেনি, বরং যদি ধরি রাধার কথা সত্যি হয়, তাহলেও তার মান ভাঙাতে পায়ে ধরে সেধেছিল নিজের বিরোধীপক্ষের নারী মানেই গনিমতের মাল বলে মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেনি, করার নির্দেশও দেয়নি কৃষ্ণের জীবনে কি শত্রু কম ছিল? কিন্তু বিনা অপরাধে খুন করতেন নাশত্রুপক্ষের নারী গান্ধারীকেও মায়ের মতো সম্মান করতেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জেতার পর কাউকে হারেমে নিয়ে গিয়ে ভরেননি এই কনসেপ্টটই ছিল না

মুখ সামলে সবিতা। কাকে পিডোফাইল বললি?” শাহানারা প্রায় চীৎকার করে উঠল। রাগে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। “আর যদি সত্যি হয় মানে? তোরা নিজেরাই জানিস না কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে কোথাও একটা চরিত্র আছে তো কোথাও নেই সব গুলতাপ্পিতে ভরা একটা কেতাবও ঠিকমতো নেই

কী করে থাকবে? বখতিয়ার খলজি একাই বিহারের নালন্দা থেকে বাংলার বীক্রমশীলাসহ একাধিক মন্দির বিহার ধ্বংস করে কোটি কোটি প্রাচীন পুথি পুড়িয়ে দিয়েছিল, খুন যে কত করেছিল তার ইয়ত্তা নেই আর সে কি একা? নাদির শাহ, তৈমুর লং, আলাউদ্দিন খলজি থেকে আওরঙ্গজ়েব কে বাদ ছিল? বাই দ্য ওয়ে, ঐ তোদের মহাপুরুষদের হারেমের আদলে কৃষ্ণের ষোলশো গোপিনীর সঙ্গে রোমান্সের আইডিয়া বাংলার নবাবদের অনুপ্রেরণা হলেও আশ্চর্য কিছু নাআর যারা নিজেদের তুতো ভাইবোনেদের মধ্যে বিয়ে করে, মামী ভাগ্নের ফষ্টিনষ্টি তাদেরই উদ্ভাবনআমাদের বৈষ্ণব পদাবলী দুই গ্রাম্য কিশোর কিশোরীর প্রেমের মধ্যেও ঐশ্বরিক প্রেমের মাহাত্ম্য খুঁজে পেয়েছে

রাখ ঐশ্বরিক মাহাত্ম্য…” ভেংচে চলল শাহনারা “যে ধর্মের পোক্ত ভিত্তি আছে, তাতে অত সহজে বেনো জল ঢোকে নাকোনও স্পেসিফিক স্ক্রিপচারই নেই

তা ঠিক অনেক বেনো জল ঢুকেছে নাহলে নারায়ণ পুজোর পাঁচালীতে সত্য পীরের জয়গান গাওয়া হয়? সেদিন একটা গৃহপ্রবেশে গিয়ে মন দিয়ে শুনে তো আমি থ! সত্য নারায়ণ পুজোয় যে ঈশ্বর সেই আল্লা বাণী প্রচার করা হচ্ছে!”

ও সব বুজরুকি তোদের পুজোয় থাকতে পারে আমরা একজনকেই মানি আল্লার সমতুল্য কেউ হতেই পারে না

একজ়্যাক্টলি, কখনোই সমতুল্য নয় আমাদের ভগবান তো দয়ালু তাকে যে মানে না, সেও তাঁর করুণা পেতে পারে সৎ কাজ দ্বারা আর আমাকে মানো, ভয় পাও, যারা মানে না তাদের খুন করো, রেপ করো, তাহলে পরপারে বাহাত্তর হুর; নইলে যতই ভালো কাজ করো না কেন, অনন্ত নরকে জ্বলে পুড়ে মরবে – এই যার বার্তা সে ভগবান নয়, শয়তান ভিলেনদের মতো অ্যাটিটিউড

একদম বাজে বকবি না এসব ওপর ওপর জেনে হয় না ভালো করে ইমান সহকারে পড়তে হয় নাহলে বোঝা যায় না আরবরা এসে কত কিছু দিয়েছে, কত কী শিখিয়েছে, সেটা স্বীকার কর

তা তো করতেই হবে আমাদের সমাজে রেপ বিশেষ করে গণধর্ষণ জাতীয় কোনও শব্দ ছিল না ওদের সৌজন্যেই পাওয়া

যে ধর্মে মেয়ে গরুকে মা মনে করা হয়, আর মেয়ে মানুষকে জ্যান্ত পোড়ানোকে পুণ্য ভাবা হয়, সেটা আর যাই হোক সভ্য মানুষের ধর্ম হতে পারে না।”

যার দুধ খাচ্ছি তাকে মা ভাবার মধ্যে অনেক মানসিক উদারতা লাগে এই নীতিবোধের অভাবেই কারও কারও ভাই বোনে বিয়ে করতেও সংস্কারে আটকায় না আর মেয়ে পোড়ানোটা ধর্ম নয় প্রথা, কুপ্রথা ধর্মের অপব্যবহার আমরাই ত্যাগ করেছি। ব্রিটিশদের দিয়ে আইন করিয়েছিকিন্তু তোরা খতনা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিস কখনও?”

মা?” শাহনারা হেসে উঠল “প্রাচীন যুগে তোদের বামুনরাও তো মায়ের মাংস খেত পরে নিজেদের কুকীর্তি চাপা দিতে, ইমেজ গড়তে গোবৎস হয়ে গেছে

ওই তত্ত্বটি রোমিলা থাপার ইরফান হাবিবদের ম্যানুফ্যাকচার করা, প্রমাণিত নয় যদি ধরেওনি প্রাচীন বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরাও গোরুর মাংস খেত, তাহলেও পরে তাদের বোধদয় হতে পারে না, গোরুর মতো উপকারী প্রাণীকে প্রিজ়ার্ভ করার চেষ্টা করতে পারে না, তার কোনও মানে আছে? এখানেই তো হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য আমরা দরকারে রিফর্ম করি আমরা সতীদাহ বন্ধ করেছি, আমাদের পুরুষরাই ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে কিন্তু তোরা রিফর্ম চাস? ইন্স্ট্যান্ট তিন তালাক নিষিদ্ধ করো, কিন্তু শরিয়তে হাত লাগিও না তোদের মেয়েদের এত শালীনতা আর পর্দার বহর, অথচ তোদের ধার্মিক পুরুষরা চাইলে যখন তখন যার তার সামনে সেগুলো খুলতে হবে!

কোথায় পেলি এসব আবোলতাবল তথ্য? সেটাও আমাদের ধর্ম কে বলেছে? ওদের সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই

নেই মানে? তালাক দেওয়া বিবিকে ফিরিয়ে আনতে হালালা করানো হয় না? সেটা কী?”

তোদের মতো আমাদের বরপণ নেই। বরং কন্যাপণ আছে। সতীদাহ অফিশিয়ালি বন্ধ, কিন্তু পণের জন্য বৌ পোড়ানো হয় না?”

সেটা তোদের সমাজে নেই? মুখে দেনমোহর প্রমিস করে বাস্তবে পণ নিচ্ছে। যে কোনও অজুহাতে বৌও পোড়াচ্ছে। আবার যখন তখন এক তরফা তালাক আর হালালা।”

জন্ম জন্মান্তর বেঁধে মারার চেয়ে তালাক দেওয়া ভালো। তুই যে এত আমাদের ধর্ম আমাদের ধর্ম করছিস, তুই তো বেসিক্যালি নাস্তিক ছিলি। হঠাৎ চাড্ডি হলি কখন? এবার তো দেখব বিয়ে করে মাথাভর্তি সিঁদুর নিয়ে নারীবাদ কপচাবি।”

তো? বিদ্যাসাগরও নাস্তিক ছিলেন, কিন্তু নিজেকে অহিন্দু বলেননি। ইন ফ্যাক্ট কেউই বলেনি বরং তিনি ব্রিটিশ সরকারের হিন্দু আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। হিন্দু দর্শনগুলোর বেশ কয়েকটাই তো নাস্তিক দর্শন। বৌদ্ধ বা জৈন দর্শন যে তৈরি হয়েছে, সেগুলোর উপাদান কিন্তু ঐ ষড় দর্শনের মধ্যেই নিহিত ছিল। আর সিঁদুর? একতরফা মেয়েদের ম্যারিটাল স্টেটাস ঘোষণা আমারও পছন্দ নয়। তবে অনেক মেয়েই সাজের অঙ্গ হিসাবে সিঁদুর পরে। সেই সংখ্যাটাও ক্রমশ কমছে। কিন্তু তোদের বোরখার চল তো দিনদিন বেড়েই চলেছে? সিঁদুর কতটা আনকমফর্টেবল শাহানারা? তোদের বোরখার চেয়েও বেশি?

দুই বান্ধবী ধর্ম যে আসলে নারী নির্যাতনের অস্ত্র সেই আলোচনায় বসে কোন ধর্ম অপমান অত্যাচারে বেশি এগিয়ে বা পিছিয়ে তার তুলনামূলক আলোচনায় পৌঁছে গেছেঅতঃপর নিজের নিজের ধর্মের হয়ে অস্ত্র ধারণ করে কাজিয়ায় মেতে উঠেছে। আসলে বন্দীরাই তো গ্ল্যাডিয়েটর হয়। শাহানারার বাড়িতে বাকিরা ছিল না, আলিপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল শুধু ভেতর ঘর থেকে বৃদ্ধ দাদুর কাশির খক্‌খক্‌ ও কফ তোলার ওয়াক থু কানে আসছিল ভাগ্যিস ছিল না নাহলে কাজিয়া মৌখিক পর্যায়ে থাকত কিনা সন্দেহ।

ইসলামে মানবতা ও নারীর মর্যাদার প্রমাণ দিতে তাক থেকে কোরান শরীফ পাড়তে গেল শাহানারাউঁচু তাক থেকে পেড়েও হাত ফস্কে মাটিতে পড়ে গেল। একেবারে সবিতার চেয়ারের নীচে।

ঝট করে বইটা কুড়িয়ে নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করল সবিতামা সরস্বতী না?