রবীন্দ্রনাথ-নেতাজী-স্বামীজীর পর মিথ্যা বাম কুৎসার লক্ষ্য শ্যামাপ্রসাদ – ৩

0
3513

– পিনাকী পাল ও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

(দ্বিতীয় ভাগের পর)

 মিথ্যা কুৎসা সাত: শ্যামাপ্রসাদ বড়লোকের অপদার্থ ছেলে ছিলেন যাঁর জোর ছিল পিতার নামই

এই মিথ্যার উৎস বোধ করি বামেদের শ্রেণীসংগ্রামের কল্পনাতে যেখানে বড়লোক মানেই দুষ্ট দানব আর গরীব মানেই নির্গুণ ব্রহ্ম। মজার কথা হল বাঙ্গালীর চির আরাধ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও কিন্তু সেই একই দোষে দূষিত। তাঁদের জন্মও উচ্চবিত্ত পরিবারে। আচ্ছা রবি ঠাকুর ও নেতাজীর কথাও ছেড়ে দিলাম। ওঁদের তো বুর্জোয়া কবি আর তোজোর কুকুর আখ্যা কমিউনিষ্টরাই দিয়েছিলেন। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের তালেবরদের দিকে তাকাই। কার্ল মার্ক্সের জন্ম হয়েছিল উচ্চবিত্ত পরিবারে, তাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ছিলেন বিপুল বিভবশালী শিল্পপতি। লেনিনের জন্ম তো ধনী অভিজাত পরিবারে। মাও সে তুংয়ের পিতা ছিলেন আপন অঞ্চলের অন্যতম বিত্তশালী কৃষক।   

‌একটু তথ্যে চোখ বোলালে দেখা যাবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আগের এবং পরের ভাইস-চ্যান্সেলর যথাক্রমে হাসান সুরাবর্দী এবং মহম্মদ আজিজুল হক। হাসান সুরাবর্দী ছিলেন সার্জেন। অন্যদিকে মহম্মদ আজিজুল হক প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক এবং ইউনিভার্সিটি ল কলেজের গ্রাজুয়েট। এদিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ইংরাজিতে গ্রাজুয়েট হলেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। এরপর বাংলায় মাস্টার ডিগ্রি এবং আইনের স্নাতক 1924 সালে। সেই বছরই কলকাতা হাইকোর্টে তিনি প্র্যাকটিস শুরু করেন উকিল হিসাবে। বয়স কম হলেও 1934 সালে তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হচ্ছেন তখন অ্যাডভোকেট হিসাবে তাঁর দশ বছর অতিক্রান্ত। সুতরাং অভিজ্ঞতার ঝুলি ও নেহাত মন্দ নয়। কথা হল কাউকে না কাউকে কোন এক পদে সর্বকনিষ্ঠ হতেই হয়। আর বয়স কম হওয়ার কারণে কাউকে অযোগ্য ধরা হলে শচীন তেণ্ডুলকার এত কম বয়সে ভারতীয় দলে সুযোগই পেতেন না। অবশ্য যারা মনে করেন চুল না পাকলে যোগ্যতা আসে না তাদের কাছে এর থেকে বেশি আশা না করাই ভালো।

এবার দেখা যাক শ্যামাপ্রসাদের কর্মকাণ্ডে (কবিশেখর কালিদাস রায়ের “শ্যামাপ্রসাদ” পুস্তক থেকে সংকলিত)। তিনি মাত্র চার বছর  (১৯৩৪ – ১৯৩৮) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এই অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি অনেক কাজ করে গিয়েছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা গ্রহণের প্রতি শ্যামাপ্রসাদের দৃষ্টি ছিল। এজন্য বৈজ্ঞানিক শব্দের বাংলা পরিভাষা রচনা সংকলন করেছিলেন। বাংলা ভাষায় প্রথম পিএইচডি করার অনুমতি প্রদানও করেছিলেন। বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও তাঁরই অবদান। শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্যকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রথম বাংলায় সমাবর্তনের ভাষণ দেন। বস্তুতঃ এটাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম ভাষণ সমাবর্তনে। সেটাও তখন যখন বিশ্বকবি তাঁর জীবনের ছিয়াত্তরটা বসন্ত পার করে এসেছেন। কিন্তু না বাংলা পক্ষ বা অন্য কোন তথাকথিত বাংলাপ্রেমীকে শ্যামাপ্রসাদকে স্মরণ করতে দেখতে পাবেন না।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা গ্রহণের প্রতি শ্যামাপ্রসাদের দৃষ্টি ছিল। এজন্য বৈজ্ঞানিক শব্দের বাংলা পরিভাষা রচনা সংকলন করেছিলেন। বাংলা ভাষায় প্রথম পিএইচডি করার অনুমতি প্রদানও করেছিলেন। বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও তাঁরই অবদান। শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্যকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রথম বাংলায় সমাবর্তনের ভাষণ দেন। বস্তুতঃ এটাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম ভাষণ সমাবর্তনে। সেটাও তখন যখন বিশ্বকবি তাঁর জীবনের ছিয়াত্তরটা বসন্ত পার করে এসেছেন। কিন্তু না বাংলা পক্ষ বা অন্য কোন  তথাকথিত বাংলাপ্রেমীকে শ্যামাপ্রসাদকে স্মরণ করতে দেখতে পাবেন না।

তিনি  নতুন নতুন বিভাগ ও পাঠ্যক্রম চালু করেছিলেন। বিজ্ঞানের বিভাগগুলি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। নীচে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও মেঘনাদ সাহার অভিজ্ঞতার উল্লেখ করছি। ইসলামিক ইতিহাস ও কৃষ্টির অধ্যয়নের জন্য নতুন “ইসলামিক স্টাডিজ” বিভাগের সৃষ্টি করেন যাতে বাঙ্গালী ঐ ইতিহাস সচেতন হয়। প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণ, চর্চা এবং গবেষণার জন্য আশুতোষ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন।   চীনা ও তিব্বতীয় শিক্ষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাও করেন। কৃষি বিদ্যার পড়াশুনা চালু করা তাঁরই কৃতিত্ব।

শারীরিক শিক্ষার প্রতিও তাঁর দৃষ্টি ছিল। ছাত্রদের খেলাধুলা ও ব্যায়াম চর্চার জন্য ঢাকুরিয়া লেকে ইউনিভার্সিটি রোয়িং ক্লাব স্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা খেলার মাঠের ব্যবস্থা করেন। পাঠক্রমে সামরিক শিক্ষার সূত্রপাতও করেন তিনি।

এর বাইরেও বহু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম দেন তিনি। যেমন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিভাগ চালু করা, স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠন ও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বয়সের বাধা প্রত্যাহার। 

আচ্ছা পাঠকগণ আর কারুর কথা বিশ্বাস করতে হবে না  যদি আপনারা বাঙ্গালীর পরম প্রিয় বিজ্ঞানসাধক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের শ্যামাপ্রসাদকে লেখা একটা চিঠি পড়ে নেন। শ্রী প্রফুল্ল রায় লিখছেন যে শ্যামাপ্রসাদের কর্মদক্ষতা ও নিষ্ঠা তাঁর পিতা বাংলার বাঘ আশুতোষের চেয়ে কম কিছু নয়: 

THE UNIVERSITY COLLEGE AND SCIENCE

Department of Chemistry,

92, Upper Circular Road,

Calcutta, 6.2.1935

My dear Shymaprasad

আমি College of Science-এ প্রধানত Inorganic Chemistry-র অনুশীলন করি। এই বিভাগে প্রিয়দারঞ্জন ও পুলিনবিহারী Lecturer। আমাদের বিভাগেও এবং Organic Chemistry বিভাগেও measurment of crystals অনেক সময় অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি Goniometer-এর অভাবে কোন কাজ সম্ভব নহে। Presidency College-তে ওই Apparatues নাই। আমি এখন Geological Dept. হইতে মাঝে মাঝে crystals measurment করাইয়া লইতেছি। কিন্তু তাহাদের এই প্রকারে পুনঃপুনঃ বিরক্তিতে লজ্জা বোধ হয়। বিশেষত Geological Dept.-এর Mr.Wadia বৎসরের ছয় মাসের অধিক Tour-এ থাকেন। যাহা হউক এত বড় College of Science-এ যাহা half a crore represent করে তাহাতে একটি Goniometer-এর অভাবে আমি শেষ জীবনের কার্যের অসুবিধা ও অসম্পূর্ণতা ভোগ করিব ইহা উচিত হয় না। University-র সাধারণ কাজে তুমি দেখিতেছি “বাপকা বেটা” হইয়াছ। কেননা এত অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থ ত্যাগ করিতে কেউই রাজি নয়। কী প্রকারে কোন্ fund হইতে টাকা আসিবে আমি বুঝিটুঝি না। যেমন করিয়া হউক আশা করি টাকা জোগাড় করিয়া দিবে। আমি তারযোগে Apparatus order দিতে চাই। অধিক আর কী লিখিব।

Yours sincerely

P C Ray

(তথ্যসূত্র:- শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লেখক:- অচিন্ত্য কুমার মুখোপাধ্যায়  চিঠির অংশ:- পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৪৭- ৪৮)

আর এক প্রবাদ প্রতিম বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেঘনাদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শিকার হতে হয়। ঘটনাটি ছিল ১৯৩৮ সালের। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী মানুষ। কিছুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম যেভাবে চলছিল তা তিনি অনুমোদন করতে পারছিলেন না। অবস্থার উন্নতির আশা নেই দেখে তিনি পদত্যাগ করে এলাহাবাদ ছাড়লেন। তাঁর বন্ধু শ্যামাপ্রসাদ তাঁর কোলকাতায় ফেরার পথ সুগম করে দিয়েছিলেন।  শ্যামাপ্রসাদের সহযোগিতায় তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত অধ্যাপকের পদে যোগদান করেন। (তথ্যসূত্র: মেঘনাদ সাহা, শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় এবং এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ন্যাশালাল বুক ট্রাস্ট, ১৯৫৯, পৃঃ ৩৯):

 মিথ্যা কুৎসা আট: শ্যামাপ্রসাদ নিজেই নিজেকে ডিলিট উপাধি দেন

‌বাস্তব তথ্য হলো শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৩৮ সালের সাতই আগস্ট পর্যন্ত। তিনি পদ ছাড়ার প্রায় এক মাস পর ১০ই সেপ্টেম্বর সেনেটের মিটিংয়ে সর্বসম্মতভাবে তাঁকে ডিলিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময় তিনি সেনেটের সভাপতিও নন, উপাচার্য তো ননই। তিনি ডিলিট পান ২৬শে নভেম্বর। সেপ্টেম্বরের সেনেটের মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন শিক্ষাজগতের দিকপালরা, যেমন  হাসান সুরাবর্দী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, প্রফেসর মহলানবিশ, পুলিন বিহারী মল্লিক, পি এন ব্যানার্জি প্রমুখ। তারা প্রত্যেকেই শ্যামাপ্রসাদ কে ডিলিট দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এই তথ্য যোগাড় করেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের The Calcutta Review জার্নাল থেকে (খণ্ড ১১৯, সংখ্যা ৩, সেপ্টেম্বর ১৯৩৮, পৃ ১১৯-১২০ পৃষ্ঠা দুটি নীচে প্রদত্ত হল)। বলা বাহুল্য বামেদের কুৎসাটি তথ্যের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিরাধার।   

এরপরও যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় যে পদ ছাড়ার পরও তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে ছিলেন, তবে বলে রাখা দরকার তাঁর পূর্ববর্তী উপাচার্য  হাসান সুরাবর্দী এবং পরবর্তী দুই উপাচার্য আজিজুল হক ও ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় অনেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদ ছাড়ার বছরই এরকম বিশেষ ডক্টরেট সম্মান লাভ করেন। তালিকাটা আরও অনেক বড়। মনে হয়, এটাই ছিল তখনকার রীতি। তাই প্রভাব খাটানোর প্রশ্ন এলে প্রত্যেকের নামেই আসা উচিত।  তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতজন উপাচার্য নিশ্চয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন না। আপামর বাঙালী কোনভাবেই বিশ্বাস করবে না যে রাজ্যের সর্বকালের সেরা মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পুরস্কারের জন্য নিজের নাম মনোনীত করতে অন্যকে প্রভাবিত করবেন। 

তাঁর পূর্ববর্তী উপাচার্য  হাসান সুরাবর্দী এবং পরবর্তী দুই উপাচার্য আজিজুল হক ও ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় অনেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদ ছাড়ার বছরই এরকম বিশেষ ডক্টরেট সম্মান লাভ করেন।আপামর বাঙালী কোনভাবেই বিশ্বাস করবে না যে রাজ্যের সর্বকালের সেরা মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পুরস্কারের জন্য নিজের নাম মনোনীত করতে অন্যকে প্রভাবিত করবেন।

নেহেরুর নিজেকে ভারতরত্ন দানে বামেদের সাফাই: বামদের কাছে আমাদের বিনীত প্রতি প্রশ্ন

শ্যামাপ্রসাদ তো নিজের কার্যকালের শেষে অন্যদের সুপারিশে ডিলিট পেয়েছিলেন। আপনাদের প্রিয় পণ্ডিত নেহেরু নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের তিন বছরের মাথায় নিজেকেই “ভারত রত্ন” উপাধি দিয়েছিলেন। আর এই তিন বছরে তাঁর কর্মও ছিল রত্নের মতই। ভারতের উপর নির্ভরশীল তিব্বতকে চীন দখল করে নিল। প্রধান বিরোধী নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রহস্যজনকভাবে শ্রীনগরে মারা গেলেন। তার কোন তদন্তও হল না।  বামেদের সাফাই এই যে সংবিধান লঙ্ঘন করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিজে সুপারিশ করে নেহেরুকে ভারতরত্ন দেন। 

তা বামদের আজকাল এত সংবিধান প্রেম, তো আপনাদের প্রিয় নেহরু নিজের চোখের সামনে সংবিধান লঙ্ঘিত হতে দেখেও চুপ করে থাকলেন, সে কি ভারত রত্নের লোভে না কি সংবিধানের উপর কোন শ্রদ্ধা ছিল না বলে?    

 মিথ্যা কুৎসা নয়: ধর্মবিরোধী নেতাজীর সাথে ছিল শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার ঘোর বিরোধ

সমস্ত মানুষকে আজকাল বামেরা নিজেদের করে নিচ্ছেন। যেমন আগে ক্ষুদিরামকে তাঁরা “বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম” বলতেন। অধুনা গীতাপাঠী কালীভক্ত ক্ষুদিরাম হয়ে গেছেন তাঁদের আপন! আগে নেতাজী ছিলেন তোজোর কুকুর, এখন বামেরা এমন একটি ভাণ করেন যেন সুভাষবাবু ছিলেন ধর্মহীন নাস্তিক কমিউনিষ্ট। বামেরা কেন কোনভাবেই নেতাজীর উত্তরসূরী হতে পারেন না তা নিয়ে বঙ্গদেশ পত্রিকায় বিস্তারিত লিখেছেন দীপ্তাস্য যশ। আমি তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি:

১৯২৯ সালে রংপুরে একটি ভাষণে তিনি সোশ্যালিজিমের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন বিবেকানন্দের কথা। তিনি সাম্যবাদের, সোশ্যালিজিমের উদাহরন দিতে গিয়ে বিবেকানন্দের সেই অমোঘ বাণীর কথা বলেছেন, “তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছো? তোমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নতুন ভারত বেরুক।বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে; জেলে, মালা, মুচী, মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে থেকে। বেরুক মুদীর দোকান থেকে, বেরুক ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, বেরুক হাট থেকে, বাজার থেকে”। সুভাষ চন্দ্র এই উদাহরণ টেনে এনে বলেছেন, “এই তো বাংলার সোশ্যালিজিম, এই সোশ্যালিজিমের জন্ম কার্ল মার্ক্সের পুথি হতে নয়। এই সোশ্যালিজিমের জন্ম ভারতের শিক্ষাদীক্ষা ও অনুভূতি হইতে।”

এই ভাষণে তিনি আরও বলেছেন,

“আমাদের মনে রাখা উচিত যে জাতির ইতিহাসের ধারা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও আবহাওয়া এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তার কথা অবহেলা করিয়া কোন মতবাদ বলপূর্বক কোন দেশে প্রয়োগ করা যায়না। এইরূপ চেষ্টা করিলে হয় সেদেশে বিপ্লবের সৃষ্টি হইবে নতুবা ফ্যাসিজিমের মতো কোন বিরুদ্ধ মতবাদের প্রতিষ্ঠা হবে”।

নেতাজী ধর্মহীন মোটেই ছিলেন না। তিনি রীতিমত যোগচর্চা করতেন। জেলে থাকাকালীন তিনি হিন্দু বন্দীদের দুর্গাপূজার অধিকার নিয়ে সরব হয়েছিলেন এবং নিজে দুর্গাপূজায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বেশিদূর যেতে হবে না শ্যাম বেনেগালের Netaji Subhas Chandra Bose: The Forgotten Hero সিনেমা দেখলেই তা জানা যায়। স্বভাবতঃই  দেখাই যাচ্ছে দুর্গার সাধক সুভাষচন্দ্র নিজেও মার্ক্স থেকে নয়, ভারতীয় সংস্কৃতি থেকেই সমাজবাদের অন্বেষণ করেছিলেন। তাই তাঁর দৃষ্টিতে ঋষি অরবিন্দ আর বালগঙ্গাধর তিলকও ছিলেন বামপন্থী। যাঁরা সুভাষকে কমিউনিষ্ট ভাবেন, তাঁদের হজম করতে একটু অসুবিধা হচ্ছে, নয় কি? কিন্তু Indian Struggle (1920-1942) এর পাতায় (পৃষ্ঠা ১৫) তাই লেখা আছে।

কমিউনিজম নিয়ে সুভাষ বাবু স্পষ্টই (’ PP. 352-353, THE INDIAN STRUGGLE (1920-1942)) বলেছেন যে ভারতে কমিউনিজম কেন কোনদিনই আসা সম্ভব নয়। সেখানে তিনি বলছেন যে রাশিয়াতে চার্চ ছিল সরকারী ব্যবস্থার সঙ্গী। তাই নাস্তিক্যবাদকে কমিউনিজম আশ্রয় করেছে। কিন্তু ভারতে ধর্মীয় নবজাগরণ হচ্ছে জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত। নেতাজীর কথাই উদ্ধৃত করি:

Owing to the close association between the church and the state in Russian history and to the existence of an organised church, communism in Russia has grown to be anti-religious and atheistic. In India, on the contrary, there being no association between the church and the state, there is no feeling against religion as such. Further, in India a national awakening is in most cases heralded by a religious reformation and a cultural renaissance.

সুভাষবাবু হিন্দু মহাসভার তত বিরোধীও ছিলেন না। মরাঠী ভাষায় রচিত “তেজস্বী তারে” গ্রন্থ পড়লে জানা যায় ২১শে জুন ১৯৪০ তিনি হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও হিন্দু মহাসভার মধ্যে সহ-আন্দোলনের কথা ভাবেন। সাভারকর নেতাজীকে হলওয়েল স্মারক সরানোর মত তুচ্ছ আন্দোলন না করে বড় পরিকল্পনার কথা বলেন এবং দেশের বাইরে যাত্রা করতে বলেন।

 

নেতাজী ও সাভারকর

সাভারকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। সাভারকর ১৯৩৭ সালে মুক্তি পাবার পর, তিনি সাভারকরকে একসাথে কাজ করার কথা লেখেন। সেই মত সাভারকর যখন ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন, রাসবিহারী বসুও জাপানে হিন্দু মহাসভা স্থাপন করে তার সভাপতি হয়েছিলেন।  গবেষকরা জানাচ্ছেন  যে সাভারকর নেতাজীর কাছে রাসবিহারীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেন। তারপরের কথা তো ইতিহাস। নেতাজী জার্মানী ঘুরে জাপানে গিয়ে রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর রাশ নিয়ে নেন।

১৯৪৪ সালের ২৫শে জুন আজাদ হিন্দু রেডিওতে নেতাজী তাই সাভারকরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান:

When due to misguided political whims and lack of vision, almost all the leaders of congress party have been decrying all the soldiers in Indian army as mercenaries, it is heartening to know that Veer Savarkar is fearlessly exhorting the youths of india to enlist in armed forces. These enlisted youths themselves provide us with trained men and soldiers for our Indian National Army.

নেতাজী বলেন যে যখন ভারতের অন্য নেতারা দূরদর্শিতাহীন নীতি নিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে মানা করছিলেন, তখন বিচক্ষণ সাভারকর তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বলছিলেন। এই দেশভক্ত তরুণরা বৃটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বলেই আজ আজাদ হিন্দ ফৌজের গঠন সম্ভবপর হয়েছে।

এবার কমিউনিষ্টদের রটনা এই যে শ্যামাপ্রসাদকে নাকি নেতাজী পাথর ছোঁড়েন। আসল ঘটনা বলরাজ মাধক শ্যামাপ্রসাদের জীবনী “পোট্রেট অফ আ মার্টিয়র” ( পৃষ্ঠা ৩০-৩১)  এ লিখে গিয়েছেন। সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত সুভদ্র এবং সুসংস্কৃত ব্যক্তি ছিলেন। হিন্দু মহাসভার একটি সভায় কংগ্রেসের এক গুণ্ডা শ্যামাপ্রসাদের দিকে পাথর ছোঁড়ে এবং শ্যামাপ্রসাদ আহত হন। কিন্তু তারপর জনতা ঐ গুণ্ডাকে ধরে উত্তম মধ্যম দেয়।  নেতাজী পরে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেন এবং জানিয়ে দেন কেউ কারও কার্যক্রমে বাধা প্রদান করার চেষ্টা করবে না। শুধু তাই নয়, তাঁদের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়। পথ আলাদা হলেও পথের শেষের লক্ষ্য তো উভয়ের একই ছিল। তাই দেখি শ্যামাপ্রসাদের সাথে সাথে ফরওয়ার্ড ব্লক ও নেতাজীর ভাই শরৎ বসুও ফজলুল হক সরকারে সামিল হন। 

 

নেতাজীভক্তির অভিনয় কেন? বামদের কাছে আমাদের বিনীত প্রতি প্রশ্ন

তবে কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪২-৪৩ এ সুভাষচন্দ্র বসুর সৃষ্ট ফরোয়ার্ড ব্লককে ফিফথ কলাম ( ঘরশত্রু) আখ্যা দিয়েছিল এবং তাদের মুখপত্র পিপলস ওয়ারে নেতাজিকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কার্টুন প্রকাশ করেছিল, এটা আমাদের সবারই জানা আছে।

ক্ষমতায় থাকা কালীন তাঁরা নেতাজীকে বাংলার ইতিহাস বইতে নমো নমো করে রেখেছিলেন আর সারা ভারতে বামপন্থী ইতিহাসবিদেরা নেতাজীকে ইতিহাস বই থেকে প্রায় বিদায় দিয়েছেন। এখন হঠাৎ করে তাঁরা নেতাজী ভক্ত হচ্ছেন কেন?

 

 মিথ্যা কুৎসা দশ: জেল না খেটে প্রথম সারির নেতা হবার জন্য নাকি শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যান

বামরা বলেন যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নাকি বলেছিলেন,

“আমি জেল খাটতে পারব না। আর কংগ্রেসে যোগ দিলে প্রথম সারির নেতাও হতে পারব না। হিন্দু মহাসভায় আমি একমাত্র নেতা, তাই আমি কংগ্রেসে যাব না।”

দেখা যাক, বামেদের এই রটনার মধ্যে কতটা সত্যতা আছে। দেখলাম বইয়ের শিরোনামটিই লেখক জানেন না, যুক্ত বাংলার নয়, “যুক্তবঙ্গের স্মৃতি”।

গেলাম অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা মিত্র ও ঘোষের প্রকাশিত যুক্তবঙ্গের স্মৃতি বইটিতে। ৭২তম পৃষ্ঠাটি পেশ করছি পাঠকদের জন্য।

 

চতুর্থ এবং পঞ্চম অনুচ্ছেদে শ্রীরায়ের প্রশ্নের জবাবে শ্যামাপ্রসাদ বলছেন যে কংগ্রেসে যোগ দিলে কি তিনি সে দলের শ্রেষ্ঠ নেতা হতে পারছেন?

প্রথমেই বলি এ কথার ব্যঞ্জনা কি? শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণতম ও কৃতী উপাচার্য। পাঠক সেদিনের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজকের ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে তুলনাও করবেন না। কংগ্রেসে এলে তিনি নিশ্চয়ই প্রদেশের শ্রেষ্ঠ নেতা হবেন, কিন্তু গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল-আকীর্ণ কংগ্রেসের সেরা নেতা হতে পারবেন না। কাজেই নীতি পরিবর্তন করতেও পারবেন না। তাঁর রাজনীতি ছিল দেশের নীতিকে সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য। ক্ষমতার ভাগ পাবার জন্য নয়। কাজেই হিন্দু মহাসভার মাধ্যমে সে পথে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন।

পাঠক দেখতেই পাচ্ছেন,ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জেল গমন নিয়ে কোন কথা বলেন নি। এসব ছিল শ্রীরায়ের কথার ব্যঞ্জনা না বুঝে অনাবশ্যক কল্পনা মাত্র।

শ্যামাপ্রসাদ যে জেল যাত্রা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না তার প্রমাণ মেলে শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরীতে (“শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরী ও মৃত্যু রহস্য”, মিত্র ও ঘোষের প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৪৩)। তিনি দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লিখেছেন যে তিনি হিন্দু মহাসভাকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন  কারণে তা সম্ভব হয় নি।

আচ্ছা, এবার শেষ কিস্তি। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু কোথায় হয়েছিল জানেন? স্বাধীন ভারতবর্ষের জেলে! কারণ তিনি এক প্রধান, এক নিশান, এক বিধানের দাবীতে আন্দোলন করেছিলেন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে  এর জন্য নেহেরু তাঁকে জেলে দেবেন। হয়তো বা, তাঁকে জেলে চক্রান্ত করে যে মেরে ফেলা হবে তাও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।

শেষপাত

এর বাইরেও আরও অনেক মিথ্যে বামেরা বলছে। যেমন কাশ্মীর সমস্যার জন্য শ্যামাপ্রসাদ দায়ী, হিন্দু মহাসভা সিন্ধুপ্রদেশকে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়ে যেতে বলেছিল, এইরকম আর সব। তবে যারা বোঝার তারা এতেই বুঝবে, আর যাদের কাছে বাম মতবাদ নব্য ধর্মীয় বিশ্বাস ( রিলিজন), তারা  কি আর ধর্মদ্রোহী হবে?

(সমাপ্ত)

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমরা চয়ন মুখোপাধ্যায়কে সাহায্য়ের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত হওয়া মতামত সম্পূর্ণ লেখকের৷ এর দায়ভার বহন করে না বঙ্গদেশ নিউজ পোর্টাল৷