সাভারকর সম্বন্ধে কংগ্রেস দলের দ্বিচারিতা: হিন্দুত্ব নিয়ে গাত্রদাহ

0
1569

ডঃ সাভারকরের সম্বন্ধে কংগ্ৰেস দলের দ্বিচারিতা: এআইসিসি-এর ১৯২৩ সালের বার্ষিক অধিবেশনে বীর সাভারকরের পক্ষে একটি প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়েছিলো এবং এখন তারা এই দেশপ্রেমিক সম্পর্কে কটুক্তি করে।


মহাত্মা
গান্ধী ১৯২০ সালে ২৬ শে  মে প্রকাশিত ইয়ং ইন্ডিয়া’- মাধ্যমে স্বতন্ত্র বীর সাভারকর এবং বাবারাও সাভারকরের মুক্তির জন্য অনুরোধজানিয়েছিলেন (তথ্যসূত্র: মহাত্মা গান্ধীর সংগৃহীত রচনাবলী, খন্ড ২০, ইলেকট্রনিক পুস্তক প্রকাশনা বিভাগ, ভারত সরকার, নিউ দিল্লি, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৩৬৮ হইতে ৩৭১ পর্যন্ত)

একইভাবে, ১৯২৩ সালে কাকিনাড়াতে অনুষ্ঠিত কংগ্ৰেসের ৩৪ তম বার্ষিকঅধিবেশনে সাভারকরের মুক্তির দাবি নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছিলো। এই প্রস্তাবনাটি কিছুদিনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গেছে। মূল প্রস্তাবনাটিতে বলা হয়েছিলো:

এই কংগ্ৰেস বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে দীর্ঘকালীন ধারাবাহিককারারুদ্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং ডঃ এন. ডি.সাভারকর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি কংগ্ৰেসের সহানুভূতি প্রকাশকরছে।“ (পৃষ্ঠা এইচ)

অধিবেশনের সভাপতি প্রস্তাবটি পাস করার সময় বলেন:

আপনারা সবাই জানেন যে, মিঃ সাভারকর এই আমলাতন্ত্রীর দ্বারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি তাঁর ভাইও একই দণ্ডাদেশ পেয়েছেন। এবং আমি বলতে চাই, বিজাপুর কারাগারের যে কক্ষটিতে শ্রী বিনায়ক (অর্থাৎ স্বতন্ত্র বীর) দামোদর সাভারকর, শ্রী গণেশ(অর্থাৎ বাবারাও) সাভারকর থাকতেন, সেই কক্ষটিতেই আমি নিজে বন্দী হিসাবে ছিলাম মিঃ গণেশ সাভারকর মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু, মিঃ বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে মুক্তি দেওয়া হয় নি এবং এই কারণেই, আমরা একজনকে এককভাবে আটক করে রাখার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের প্রতিতীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কারণটি হল এই অসহায় ব্যক্তিকে সর্বাধিক প্রতিহিংসার কারণেই কারারুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে অথচ তিনি মুক্তি পাওয়ার যোগ্য………. বন্ধুগণ, এই ঘৃণ্য বিষয়গুলির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করার সময় চলে এসেছে। কিন্তু আমরা এই প্রস্তাবনাটি পাস করার মাধ্যমে সরকার কীভাবে এই বিষয়টিকে সর্বাধিক প্রতিহিংসাপরায়ণ এবংস্বার্থান্বেষীসুলভ আচরণের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা পুরো বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাইছি। আমি আশা করছি, আপনারা সবাই এই প্রস্তাবটি গ্ৰহণ করবেন।“ (পৃষ্ঠা ১৮৫)

লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, এই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এই একই কংগ্ৰেস অধিবেশনে শ্রীমতী স্বরস্বতী বাইও সাভারকরের প্রশংসায় একটি উর্দু সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

কাকিনাড়া অধিবেশনে কংগ্ৰেসের সভাপতি কে ছিলেন? একজন চরমপন্থী বা টিকিধারি বা হিন্দুত্ববাদী বা ডানপন্থী?

না, একদমই নয়।

কংগ্রেসের এই কাকিনাড়া অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার সময়েও উপস্থিত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে ১৯১৭১৮ সালের মুসলিম লীগের কলকাতা অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন (তবে গৃহবন্দী থাকায় সভাতে অনুপস্থিত ছিলেন) এবং খিলাফতআন্দোলনের বিখ্যাত আলী ভাতৃদ্বয়ের কনিষ্ঠ ভাই মৌলানা মহম্মদ আলী

তৎকালীন কংগ্ৰেস অধিবেশনের সভাপতির সাভারকরের উদ্দেশ্যেপ্রশংসাসুলভ উপরোক্ত শব্দগুলি প্রকৃতপক্ষে মৌলানা মহম্মদ আলীর।

এই একই কংগ্ৰেস অধিবেশনে, এই একই সভাপতি কংগ্ৰেসের প্রাক্তন সভাপতি (১৯০০ সালের লাহোর কংগ্ৰেস অধিবেশনে) স্যার নারায়ণ চন্দভাকরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন। (পৃষ্ঠা ১১৭)

এই একই চন্দভারকর (বিচারক হিসাবে) সাভারকরের শাস্তি ঘোষণাকরেছিলেনসুতরাং, একই অধিবেশনে যে ব্যক্তি এই শাস্তি দিয়েছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো এবং শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ার দাবি করা হয়েছিলো এবং তাও আবার সভাপতির দ্বারা? এই বৈপরীত্য কেদারনাথশুল্কা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যে অধিবেশনে তাঁর উদ্দেশ্যে শুধু বসে পড়ুন, বসে পড়ুন এর ডাকই শোনা গিয়েছিলো। (পৃষ্ঠা ১৮৬)

এই একই অধিবেশনে লন্ডনে সাভারকরের সহযোগী ভি ভি এস আইয়ার পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি নিয়ে একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন (পৃষ্ঠা ১২৮১৩০)। তবে সভাপতি এই প্রস্তাবনার জন্য ভোট গ্ৰহণের পরে এই প্রস্তাবটিকে খারিজ করে দেওয়া হয় (পৃষ্ঠা ১৩৮)। তথ্যসূত্র: ১৯২৩ সালের ২৮ থেকে ৩১ শেডিসেম্বর এবং ১৯২৪ সালের ১ লা জানুয়ারি কোকনাড়ায় অনুষ্ঠিত ৩৮ তম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবেদন। অভ্যর্থনা কমিটির সাধারণসম্পাদক বুলুসু সাম্বমূর্তি দ্বারা প্রকাশিত

এই সারাংশটি অক্ষয় যোগের মারাঠি পুস্তক বীর সাভারকরঅক্ষেপ অনি বাস্তাবা’ (যার অর্থবীর সাভারকর- মিথ্যে অভিযোগ বনাম বাস্তবতা)

শুধুমাত্র সূচনার জন্য আমি কেবল এই ছোট্ট অংশটি অনুবাদ করেছি, তবে আমার সমগ্ৰ পুস্তকটিকে হিন্দি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই উপলব্ধ করার ইচ্ছা আছে

নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলিতে আমি এই বিষয়ে আমার নিজস্ব মন্তব্য তুলে ধরেছি:

প্রাক্তন কংগ্ৰেস সভাপতি (১৯০০ সালের লাহোর অধিবেশনে) স্যার নারায়ণ চন্দভারকর স্বতন্ত্র বীর সাভারকরকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন এবং বিচারক হিসাবে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিও ঘোষণা করেছিলেন জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতাসংগ্ৰামীদের কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে ব্রিটিশপন্থী এই ধরনের কাজ করেছিলেন এমন একজন ব্যক্তি ইতিপূর্বেই কংগ্ৰেসের সভাপতি ছিলেন। এই দলটি সাভারকরবিরোধী এবং তারা সাভারকরকে তিরস্কিত করার এবং চন্দভারকরের মতো তাদের নেতৃবৃন্দদের নথিপত্র গোপন করার সর্বাত্মকচেষ্টা করবে, এই বিষয়টি মোটেই আশ্চর্যজনক নয়।

কংগ্ৰেসের প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর পরে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে কংগ্ৰেস প্রথম ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার (পূর্ণ স্বরাজ) দাবি করেছিলো। ১৯২০ এর দশকে, ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনের আগে পর্যন্ত কংগ্ৰেসের দাবি ছিলো ভারতের মধ্যে একছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এবং এর প্রারম্ভিক বছরগুলিতে, ১৮৮০ এবং ১৮৯০ এর দশকে, কংগ্ৰেস নেতারা প্রকাশ্যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে দৈব্য উপহার রূপে আখ্যা দেন।

১৯১১ সালের শেষদিকে তৎকালীন কংগ্ৰেসের সভাপতি বিশন নারায়ণ দর বলেছিলেন যে, ব্রিটিশ শাসন ছিলো এখনও অব্দি আমার জাতির জন্যঈশ্বরের দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার (এইচ এল চ্যাটার্জি দ্বারা সম্পাদিত সভাপতি বিশন নারায়ণ দরের বক্তৃতা ও রচনাবলী”, লখনউ ১৯২১, সভাপতি ঠিকানা ১৯১১ এর ৩০৭) স্বাভাবিকভাবেই, এই দল (কংগ্ৰেস)স্বতন্ত্র বীর সাভারকরের ন্যয় ব্যক্তিদের অসম্মানিত করতে খুবই আগ্ৰহী,যারা ভারতের সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্ৰাম করেছিলেন এবং তাঁর নিজস্ব নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, ১৯০০ সালের প্রথম দিকে (যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর) তাঁরা এই স্বাধীনতাকে তাঁদের লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন

আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগোয়ার স্বাধীনতা অর্জনের অন্যান্য পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে শক্তিশালী গণআন্দোলন ছিলো, তাই তিনি কংগ্ৰেসে যোগদিয়েছিলেন কংগ্ৰেসের মধ্যে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে তিনি নাগপুর জাতীয়মিলন গঠন করেছিলেন ১৯২০ সালের এআইসিসি-র অধিবেশনচলাকালীন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। নাগপুর জাতীয়মিলন কমিটির কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলো, যার মাধ্যমে তারা কংগ্ৰেসকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই একমাত্র লক্ষ্যঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিলো:কংগ্ৰেসের লক্ষ্য ভারতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলির দখল থেকে সমগ্ৰ জাতিকে স্বাধীন করার চেষ্টা করা১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে কংগ্ৰেস প্রথম সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করার প্রায় ১০ বছর পূর্বেই আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগোয়ার ১৯২০ সালেই দলটিকে এটি করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন

পরিচালন সমিতি প্রস্তাবটিকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য এআইসিসির সামনে এটিকে উপস্থাপনের অনুপযুক্ত বলে মনে করে এবং শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়। কিন্তু, আধুনিক পর্যালোচনা তার ২১ মার্চের সংখ্যায় এই প্রস্তাবটির বিষয়ে মন্তব্য করেছিলো:এই প্রস্তাবটির উপর পরিচালন কমিটি আরও বেশি মনোযোগ দিয়েছে।

১৯২৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর, রবি নদীর তীরে, কংগ্ৰেস তার ঐতিহাসিকলাহোর অধিবেশনেসম্পূর্ণ স্বাধীনতাদাবি করে একটি প্রস্তাব গ্ৰহণ করে এবং ১৯৩০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ডাঃ হেডগোয়ার কংগ্ৰেসের কাছ থেকে এক দশক আগেও ঠিক একই প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত খুশি ছিলেন এবংআরএসএসের সমস্ত শাখাকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমেই দিনটিকে উদযাপন করার নির্দেশ দেন এবং স্বাধীনতার বাণী চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন

আরএসএস ১৯২৯ সালের কংগ্ৰেসের প্রস্তাবটিকে দুহাত খুলে নিরবিচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছিলো। ৩৭ কি শাখার প্রত্যেকটিতেই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলো, যেখানে বলা হয়েছিলো:এই বছর কংগ্ৰেস সম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে তার লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। সিডব্লুসি সমগ্ৰ জাতিকে ১৯৩০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি, রবিবার দিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করার জন্য আহ্বান জানান আমরা, সংঘ পরিবারের সকল সদস্যগণ স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি যে, সর্বভারতীয় কংগ্ৰেস আমাদের লক্ষ্যসম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছে। এই উদ্দেশ্যে কর্মরত যে কোনওসংস্থাকেই সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। সুতরাং, প্রতিটি শাখার সকল স্বয়ংসেবকদের ২৬ শে জানুয়ারি, ১৯৩০, রবিবারে সন্ধ্যে ৬ টার সময় নিজ নিজ সংস্থাগুলিতে সাক্ষাত করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। গেরুয়া পতাকাকে সম্মান জানানোর পরে, স্বাধীনতার ধারণা এবং এই আদর্শকে এককভাবে কেন সর্বাগ্ৰে রাখা উচিত, তা ব্যাখ্যা করা হবে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শকে গ্ৰহণ করার জন্য কংগ্ৰেসকে অভিনন্দন জানিয়ে এই অনুষ্ঠানকে সমাপ্ত করা উচিত”। [এই সত্যটি এমনকি সুমিত সরকারের মতো আরএসএসের সবচেয়ে খারাপ সমালোচক তাঁর খাঁকি জামা এবং গেরুয়া পতাকানামক গবেষণামূলক পুস্তকে স্বীকার করেছেন।]

কংগ্ৰেস আসলে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে যা দাবি করেছিলো, তা ১৯২০সালে ডাঃ হেডগোয়ারের মতো ভি ভি এস আইয়ারও ১৯২৩ সালের অধিবেশনে অনুরোধ করেছিলেন, তবে ১৯২৩ সালের শেষের দিকে কংগ্ৰেস তা প্রত্যাখ্যান করেছিলো। ১৯২০ এর দশকের দাবিটি কেবল আধিপত্যের মর্যাদার জন্যই ছিলো।

মূল লেখাটি মানুষি পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন এম ডি দেশপাণ্ডে। অনুবাদ করেছেন অর্ণব।