বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকান্ড এবং আজকের বাংলাদেশ

0
1128

রক্তস্নাত আগষ্ট। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫। জাতীয় শোক দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।

১৬ আগষ্ট ১৯৭৫ সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। প্রায় একই সময়ে পাকিস্তান, চীন, লিবিয়ার স্বীকৃতি আসে। বঙ্গবন্ধু জাতি’র পিতা। আইন তাই বলে, বাংলাদেশে সবাই তাঁকে জাতি’র পিতা মানেন না? জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতির পিতা, ইবনে সৌদ সৌদি আরবের, কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের, সুকর্ণ ইন্দোনেশিয়ার,  বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতির পিতা বললে অনেকেই বলেন, মুসলমানদের জাতির পিতা হয়না, একমাত্র হজরত ইব্রাহীম মুসলমানের জাতির পিতা?

আওয়ামী লীগ একাধারে ক্ষমতায় এক দশকের একটু বেশি। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মাতামাতি করার মানুষের বা বঙ্গবন্ধু প্রেমিকের কোন কমতি নেই, ৭৪-৭৫’-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমরা এমন দৃশ্য দেখেছিলাম। তাই হয়তো একদা রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদ দু:খ করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্যে কোন বীরউত্তম, বীরবিক্রম এগিয়ে আসেননি’। কথাটা সত্য। প্রকৃতপক্ষে সেদিন আমরা কর্নেল জামিল ও কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। এখানে আমি যা লিখছি তা নুতন কিছু নয়। তবু লেখা, জাতির জনকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে। তিনি একটি ভূখণ্ড এবং একটি সবুজ পাসপোর্ট দিয়েছিলেন বলে আমরা আজ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছি।

আগষ্ট মাস এলেই রাজনীতিকরা তারস্বরে বলতে শুরু করেন যে, বিদেশ অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জোর তৎপরতা চলছে। সদ্য আইনমন্ত্রী তাই বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত ও দণ্ডিত ১২ খুনির মধ্যে ৬জন বিদেশে পলাতক। ২৭ জানুয়ারি ২০১০-এ ৫ জনের দন্ড কার্যকর হয়েছে। এঁরা হচ্ছেন, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমদ এবং একেএম মহিউদ্দিন। পলাতক ৬জন হচ্ছেন: লেঃকর্নেল (অব:) রাশেদ চৌধুরী; লেঃকর্নেল (অব:) নূর চৌধুরী; লেঃকর্নেল (অব:) শরিফুল হক ডালিম; লেঃকর্নেল (অব:) খন্দকার আব্দুর রশিদ; রিসালদার মোসলেউদ্দিন; ক্যাপ্টেন (অব:) আব্দুল মাজেদ। এদের মধ্যে লেঃকর্নেল (অব:) রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং লেঃকর্নেল (অব:) নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। বাকি ৪ জন কোথায় আছেন, তা কেউ জানেই না? বলা হচ্ছে, মেজর ডালিম হয়তো পাকিস্তানে আছেন। ১৫ আগষ্ট ভোরে ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন, তাঁর দণ্ড কার্যকর করা কতটা জরুরী। দণ্ডিত আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুইতে মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। এদের চিহ্নিত করা হয়নি। বিদেশী কানেকশন খুঁজে বের করা হয়নি?

বঙ্গবন্ধু’র আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর খন্দকার মুশতাক মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন। শত্রূ বা অর্পিত সম্পত্তি আইনটি বাতিলে যেমন তিনি ব্যর্থ, তেমনি ‘ইন্ডিমিনিটি’ অধ্যাদেশ তাঁর হাত দিয়েই পাশ হয়েছে। দুই দশকের বেশি সময় পর শেখ হাসিনা সেটি বাতিল করতে সক্ষম হ’ন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ মন্ত্রী মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল পঁচাত্তরের পর বলেছিলেন, ‘দেশ আজ ফেরাউন মুক্ত হলো’। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হ’ন। এইচ টি ইমাম পঁচাত্তর পরবর্তী মুশতাক সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব ছিলেন। জাসদের হাসানুল হক ইনু’র ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দেয়ার ছবিটি ইতিহাস, তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন। তোফায়েল আহমদ’র বয়স হয়েছে। আশা করবো, সেদিনের ঘটনার একটি সত্য ও বস্তুনিষ্ট বর্ণনা তিনি লিখে রেখে যাবেন, যাতে তার মৃত্যুর পর জাতি সেটি জানতে পারে!

পঁচাত্তরের পর সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তিনি দলছুট এবং মাঝেমধ্যে আবোলতাবোল বকছেন। তখন আরো কিছু নেতার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিলো, যাদের কথা কেউ বলেনা, বা জানেনা। এরা অনেকেই তখন কলকাতা পাড়ি জমিয়েছেন। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাঁর পরেই ছিলেন রংপুরের সুনীল গুহ। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীপঙ্কর তালুকদার তখন কাদের সিদ্দিকীর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন। কলকাতায় তখন যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে নরসিংদীর এমপি মোসলেউদ্দিন; যশোরের এমপি রওশন আলী; যশোরের সাবেক এমপি সুবোধ সরকার; শেখ ফজলুল করিম সেলিম; জাতীয় ছাত্রলীগের ইসমাত কাদির গামা; জাতীয় যুবলীগের খালেদ খুররম; আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকী; ছাত্রলীগের ওবায়দুল কাদের; হরেকৃষ্ণ দেবনাথ, আওরঙ্গ এবং আরো অনেকে। ছাত্রলীগ নেতা নুরু হত্যা কাদেরিয়া বাহিনীতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধে যেমনি বরিশালের চিত্ত সুতারের বিশাল ভূমিকা ছিলো, পঁচাত্তর পরবর্তীতেও তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তার সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখতেন। কাদেরিয়া বাহিনী কেন ব্যর্থ হয় সেটা অন্য কাহিনী। কিন্তু ওই সময়কার অনেক ছাত্রনেতা হারিয়ে গেছেন। সফল তালিকার শীর্ষে ওবায়দুল কাদের। ভারত থেকে ফিরে তিনি ধরা পড়েন, অত্যাচারিত হন। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি, এখন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিবিধ কারণে তখনকার নেতাকর্মীরা এদিক-ওদিক ছিটকিয়ে পড়লেও এদের ভোলা অনুচিত। কাদের সিদ্দিকী পারেন ঐ অনুল্লিখিত ইতিহাস লিখে রেখে যেতে।

আওয়ামী লীগ যেমন বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার মত নেতা জন্ম দিয়েছে, তেমনি মুশতাক আহমদর মত বিশ্বাসঘাতকেরও জন্ম আওয়ামী লীগের ভেতরে। কাদেরিয়া বাহিনীর সংগ্রামের ব্যর্থতার পেছনেও এই বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারত-ভীতি কাজ করেছে। অবাক কান্ড যে, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তার মৃত্যুর ঠিক পরই ভোল পাল্টে ‘জয়বাংলা’ চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে? বর্তমান আওয়ামী লীগের দিকে তাঁকালে বঙ্গবন্ধুর সময়কার নেতারা হোঁচট খাবেন। মদিনা সনদ, হেফাজতের সাথে সখ্যতা, মডেল মসজিদ ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র নির্মাণ, কওমি সনদের স্বীকৃতি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ঠিক মানায় না? আওয়ামী লীগের শ্লোগান ‘জয়বাংলা’, নেতাকর্মীরা এখনো সেটি দেন, কিন্তু তাদের চেতনায় ‘জিন্দাবাদ’। ফলাফল, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মত যুদ্ধাপরাধী’র বিশাল জনপ্রিয়তা এবং এমনকি তাঁকে মৃত্যদণ্ড দেয়ার সাহস সরকার বা আদালতের হয়নি? আজকের বাংলাদেশ সাঈদীর ওয়াজ শুনে ঘুমাতে যায়?

বঙ্গবন্ধু হত্যার তিনধারায় বিচার হওয়া দরকার ছিলো। রাজনৈতিক, বিদেশী সম্পৃক্ততা এবং সামরিক সংযোগ। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত রাজনৈতিক নেতাদের পরিচয় জানা দরকার। সামরিক বাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট হওয়া উচিত। তখনকার তিন বাহিনী প্রধানের ভূমিকা কি ছিলো জানা দরকার। বিদেশী ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হওয়া উচিত। আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশের সময় কি এখনো হয়নি? ‘কান টানলে মাথা আসে’, এ উদ্ধৃতি আবারও প্রমাণিত হবে, যদি আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের বিশদ তদন্ত হয়; বেরিয়ে আসবে ৩-৭ই নভেম্বরের তথাকথিত সংহতি দিবস ষড়যন্ত্রের কাহিনী। জিয়া হত্যাকান্ড, জেনারেল মনজুর হত্যাকান্ড, ক্যামেরা ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে ১৩ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও অসংখ্য সেনা অফিসার ও জোয়ানের ফাঁসির ইতিহাস মানুষের জানা দরকার। ১৯৭৭র ২রা অক্টোবরের সামরিক অভ্যুথানের ইতিহাসও জানা দরকার। কাউকে হেয় করা বা প্রতিশোধ নয়, জাতির কল্যাণেই ওসব জানা দরকার। আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের পরপরই ১৬ আগষ্ট দুপুরে জেনারেল জিয়া ও খালেদ মোশাররফ নুতন সরকারকে অভিনন্দন জানান। অথচ খালেদ মোশাররফ নাকি আওয়ামীপন্থী? একদা আমাদের তাই বোঝানো হয়েছে!  একইদিন, ১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকা বলেছিলো: ‘এ করুণ মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে লেখা ছিলো তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টি’র কোন প্রয়োজন ছিলোনা’।

২০১৯-এ ১৫ই আগষ্ট দাঁড়িয়ে কি একইভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ যদি মিনি পাকিস্তানই হবে তাহলে কি দরকার ছিলো এই স্বাধীনতার? আরো বলা যায়, পাকিস্তান আমলের মত সংখ্যালঘুরা যদি আজো প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হয়, তাহলে কি প্রয়োজন এই স্বাধীনতার? এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?

পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধু’র ঘাতকরা যেভাবে পুরুস্কৃত হয়েছিলেন এর একটি হিসাব আমরা পাই বাংলাদেশ গেজেট (৮/৬/১৯৭৬) থেকে: কর্নেল শরিফুল হক ডালিম চীনা বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিবের দায়িত্ব পান; লেঃ কর্নেল: আজিজ পাশা, প্রথম সচিব, আর্জেন্টিনা; মেজর মহিউদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব, আলজেরিয়া; মেজর শাহরিয়ার রশীদ: দ্বিতীয় সচিব, ইন্দোনেশিয়া; মেজর বজলুল হুদা: দ্বিতীয় সচিব, পাকিস্থান; মেজর নূর চৌধূরী: দ্বিতীয় সচিব, সৌদী আরব; মেজর শরীফুল হোসেন: দ্বিতীয় সচিব, কুয়েত; ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম: দ্বিতীয় সচিব, আবুধাবী; লে. খায়রুজ্জামান: তৃতীয় সচিব, মিশর; লে. আবদুল মাজেদ, তৃতীয় সচিব, সেনেগাল; লে. নাজমুল হোসেন: তৃতীয় সচিব, কানাডা।

কারা এদের নিয়োগ দিয়েছেন অথবা কারা এদের দীর্ঘদিন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, তা সবার জানা, হয়তো সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি-জামাত। পাপ বাপকেও ছাড়েনা, এ বহু পুরাতন উবাচ, কিন্তু রাজনীতিকরা প্রায়শ: তা ভুলে যান। বঙ্গবন্ধু’র বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সরকারি প্রশ্রয়ে মৌলবাদের যে রমরমা, এটি পাপ, এটি হওয়ার কথা ছিলোনা। জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাসীন, হয়তো তিনি আরো কিছুদিন থাকবেন, থাকুন, কিন্তু তারপর? তার-আর-পর নেই? চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন, শেখ হাসিনা উত্তর বাংলাদেশের কথা? শিউরে উঠছেন? বর্তমান ভুঁইফোড় বঙ্গবন্ধু প্রেমিকরা তখন কোথায় থাকবেন, কে জানে?