অভীক মুখোপাধ্যায়
পর্ব – ৪৯
ডুমস ডে ক্লক। শুনেছেন এই বস্তুটির কথা?
পরমাণু বিজ্ঞানীরা একটি কাল্পনিক ঘড়ির ধারণা দিয়েছেন। সেই ঘড়ি বলবে প্রলয় কবে আসবে। মানুষের তৈরি প্রলয়ের কথা বলে দেবে সেই ঘড়ি। এখন আমেরিকা – চিন, চিন – ভারত কিংবা হালফিলের সোভিয়েত – আমেরিকা তরজা দেখতে – দেখতে মনে হয় এই ঘড়ির কাঁটাগুলো সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। বারোটা বাজতে আর হয়তো ৬০ সেকেন্ড বাকী। পান থেকে চুন খসলেই পৃথিবীর বারোটা বেজে যাবে। পড়তে – পড়তে হয়তো হাসছেন, ভাবছেন মজা করছি, কিন্তু ১৯৬৩ সালে এমন একটা সময় এসে উপস্থিত হয়েছিল যখন বিশ্ব প্রলয় থেকে মাত্র ১২ মিনিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। মস্কোতে প্রথম বার আমেরিকা, সোভিয়েত এবং ইংল্যান্ড নিজেদের মধ্যে পরমাণু পরীক্ষণ নিষেধ সন্ধি সাক্ষর এবং হস্তান্তর করেছিল। এটাই Partial Nuclear Ban Treaty নামে পরিচিত।
তবে কেনেডি কিন্তু প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এধরণের সন্ধির কৃতিত্ব পাবেন না। এর সূত্রপাত করেছিলেন এক ভারতবংশীয়। পণ্ডিত নেহরুজি। তিনি ১৯৫৪ সালে ইউনাইটেড নেশনস –এর কাছে এ জাতীয় প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তারপর বল – ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যায় আমেরিকা আর সোভিয়েতের মধ্যে, তুমি আগে বন্ধ করো – তুমি আগে বন্ধ করো। ইতিহাসে কেউ কখনও বলবে কিনা জানি না, তবে হিসেব বলছে গান্ধীজি রাজা রামমোহন রায়ের দ্বারা, মার্টিন লুথার কিং গান্ধীজির দ্বারা এবং কেনেডি নেহরুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায় আর গান্ধীজি সফল হয়েছিলেন কিনা সে খতিয়ান ভারতবাসীর কাছে আছে, কেনেডি আর কিং –এর সাফল্যের কথা আমেরিকানরা বলেন। কেনেডি আর কিং প্রায় একই সময়ে মার্কিন মুলুকে রদবদল আনতে চেয়েছিলেন।
কিং-কে তো বটেই, কেনেডিকেও আমেরিকার দক্ষিণপন্থীরা অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। এফ বি আই এর ডিরেক্টর এডগার হুবার মার্টিন লুথার কিং –কে সোশ্যালিস্ট প্রমাণিত করতে উঠেপ্রে লেগেছিলেন। তবে সত্যি সত্যিই মার্টিন লুথার কিং –এর দুই সহযোগী সাম্যবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ভালো বলুন বা মন্দ, যখনই নাগরিক অধিকার নিয়ে কথা ওঠে, তখন বিড়ম্বনার মতোই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বামপন্থার ট্যাগ জুড়ে যায়। কিং কিন্তু বামপন্থী ছিলেন না, তিনি পাদ্রী ছিলেন। তাঁর ভাষণ গির্জায় হতো। প্রত্যেক বক্তৃতায় ঈশ্বরের উল্লেখ থাকত। কিং-কে বামপন্থী বলার পর মার্কিন মিডিয়াও তাঁকে সোভিয়েতের দালাল বলছিল।
কেনেডি মার্টিন লুথার কিং –কে ডেকে পাঠালেন। হোয়াইট হাউজের বাগানে দুজনে ঘুরছিলেন। কথা চলছিল। কেনেডি বলেছিলেন, ‘জানো ইংল্যান্ডে কী হয়েছে? আমারই এক বন্ধু তথা মন্ত্রী এক মহিলার সঙ্গে রাত্রিবাস করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। সেই মহিলা আবার সোভিয়েতের গুপ্তচর। এবার কী হবে, এই ঘটনার জন্যে ওই ভদ্রলোকের সব ভালো কাজই লোকজনে ভুলে যাবে। বুঝতে পারছ তো, কী বলতে চাইছি?’
‘ঠিক আছে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আমি কথা দিলাম, নিজের সমস্ত কমিউনিস্ট সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। আমার জন্যে একটাই বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হল সিভিল রাইটস বিল।’
এই কথোপকথনের পরে কিং নিজের দুই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত সহযোগীর সঙ্গে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন।
একটি বিশাল পদযাত্রার পরিকল্পনা করা হয়। মানুষ হাঁটতে – হাঁটতে এগিয়ে যাবে ক্যাপিটোল হিলের দিকে। মজার কথা হল এই পদযাত্রার প্রকট সমর্থন জন এফ কেনেডি করেননি, এবং ববি কেনেডি এই পদযাত্রার জন্যেই পরোক্ষ ভাবে প্রায় আড়াই লক্ষ সমর্থক জোগাড় করে দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই পদযাত্রায় কৃষ্ণাঙ্গ – শ্বেতাঙ্গ, ধনী – দরিদ্র, ক্যাথলিক – প্রোটেস্ট্যান্ট সব্বাই ছিলেন।
লিংকন মেমোরিয়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেদিনের রাজা। রাজার নাম মার্টিন লুথার কিং। হাতের কাগজ থেকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন নিজের বক্তব্য। মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আব্রাহাম লিংকনের কালজয়ী গেটিসবার্গ ভাষণের কথা। পড়তে – পড়তে আবেগে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল। হাতের কাগজ ছেড়ে তিনি নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন, ‘…আমি স্বপ্ন দেখি, জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে ক্রীতদাসদের বংশধরেরা সামন্তপ্রভুদের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে একই টেবিলে বসে গল্প করবে। …আমার চার সন্তান এমন এক আমেরিকার বুকে বড় হবে, যেখানে তারা শ্বেতাঙ্গ বন্ধু পাবে, তাদের সঙ্গে পড়বে, খেলবে। আমাদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। …সব বাধা দূর হয়ে যাবে। ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আর যখন এমনটা ঘটবে, তখন ঈশ্বরের সকল সন্তান, নিগ্রো – শ্বেতাঙ্গ, ইহুদি কিংবা অ – ইহুদি, ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট, সবাই মিলে কৃষ্ণাঙ্গদের এই গানটা গাইবে — ফ্রী অ্যাট লাস্ট! ফ্রী অ্যাট লাস্ট! থ্যাঙ্ক গড অলমাইটি, উই আর ফ্রী অ্যাট লাস্ট!’
এই ভাষণের পরে লক্ষ – লক্ষ হাত মানব শৃঙ্খলের জন্ম দেবে। তাদের সম্মিলিত কণ্ঠে গান শোনা যাবে। সেই গানটাই দশকের পর দশক ধরে সিভিল রাইটস-এর পরিচায়ক হয়ে উঠবে। আন্দোলনের ভাষা হবে, সুর হবে। গণসঙ্গীত হবে ভারতেও। উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে…।
পরমাণু পরীক্ষণে নিষেধ এবং বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিল আনা ছাড়াও কেনেডির আরও একটি মনস্কামনা ছিল। অদ্ভুত ইচ্ছে। সেই ইচ্ছের জন্যে হয়তো লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ হতে পারত। সমাজ সেই ইচ্ছে থেকে কোনও প্রত্যক্ষ ফলও হয়তো পেত না। কেনেডির ক্যাবিনেটের লোকজনেরাই তাঁর সেই ইচ্ছেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু কেনেডি চাইছিলেন সোভিয়েত আর আমেরিকা সম্মিলিত ভাবে কাজটা করলে মানবিকতার জয় হবে।
কিন্তু কী করতে চাইছিলেন জন এফ কেনেডি?
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাইস ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমরা চাঁদে পা – রাখতে চলেছি।’
(ক্রমশ)