অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পেরেছিল

0
1090

শেখর ভারতীয়

সাংবাদিকতার চাকরিতে সেই ঢুকেছি। পার্কসার্কাস থেকে সায়েন্স সিটির দিকে এগিয়ে পেল্লাই সাইজের অফিস। রুমের ভেতর খোপ খোপ করা আলাদা আলাদা ডেস্ক। এই পেশাটায় করে-কম্মে খেতে গেলে প্রতিদিন পড়াশুনো করতে হয়। রোজ কিছু না কিছু নতুন শেখায় সাংবাদিকতা। অন্তত আমার তাই মনে হয়। আর আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা নট ‘দদাতি বিনয়ম্’, বরং অহঙ্কার দেয়। তো সেই রকম সাংবাদিকতার গরবে গরম খাওয়া অনেকেই আমার সঙ্গে কাজ করতেন।

– এটা কি লিখেছো? সাংবাদিকতাটা সাহিত্য নয়।
– এই তোদের মতো নতুন ছেলেদের নিয়ে এই মুশকিল। তোরা কোনদিন পড়াশুনো করবি না।

এই রকম কথা আমি এবং আমার সঙ্গে চাকরিতে যোগ দেওয়া কিছু ট্রেনি সাংবাদিকের রোজকার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার ছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা গলিরাস্তা আমাদের মেন রোডে নিয়ে এসে ফেলত। গলি আর রোডের সঙ্গমস্থলে জগার সেলুন দোকান। সেলুন বলতে এসি রুম, বড় বড় কাচে ঢাকা দেওয়াল, চরকির মতো ঘুরতে পারে এমন গদিওয়ালা চেয়ার, দশ রকমের ক্রিম, ফেসওয়াশ, ট্রিমার মেশিন, না এসব কিছুই ছিল না জগার সেলুনে। একটা রাধাচূড়া গাছ, সেই গাছের গুঁড়িতে পেরেক দিয়ে আটকানো একটা আয়না আর তার সামনে রাখা একটা পুরনো কাঠের চেয়ার। এটাই জগাদার সেলুন। পাশেই জগাদার বউ, কৃষ্ণা বৌদির চায়ের দোকান। বাঁকুড়ার কোন গ্রাম থেকে কলকাতা এসে পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে চাইছে জগাদারা।

(২)

অফিসের কাজের ফাঁকে বৌদির দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা চলত আমাদের। মাঝে মাঝে জগাদার সেলুনে দাড়িও কাটতাম আমরা। সময় নিয়ে যত্ন করে দাড়ি কাটত জগাদা। কলকাতার নামী এলাকার দামী সেলুন দোকানের মতো ধর তক্তা মার পেরেক রকমের তাড়া থাকত না জগাদার। আমাদের অফিসে সবচেয়ে নামী সাংবাদিক ছিলেন বিবস্বান বন্দ্যোপাধ্যায়। ভদ্রলোক প্রেসিডেন্সি থেকে ফিজিক্স গ্র্যাজুয়েট। তারপর ওখান থেকেই সাংবাদিকতার কিসব যেন খটমট কোর্স করেছিলেন। ওঁর করা স্টোরি প্রায় প্রতিদিন পেপারের প্রথম পাতায় যেত। চোস্ত ইংরাজি আর যে কোন বিষয় সম্পর্কে ভালো পড়াশুনো, পাশাপাশি প্রশ্ন করার ক্ষমতা বিবুদাকে জাত সাংবাদিক করে তুলছিল। ওর সাইড এফেক্ট ছিলও প্রচুর। ভদ্রলোক অ্যাসাইনমেন্টে বেরনোর আগে অবধি পুরো অফিস মাথায় তুলে রাখত। এই নাক উঁচু বিবুদা মাঝে মাঝে সিগারেট খেতে যেত জগাদার সেলুনের কাছে। তা বলে মোটেও ভাববেন না বিবুদা বৌদির থেকে ফ্লেক কিনে খেত! বিবুদা ওখানে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে একটা লম্বা সিগারেট বের করে টানত আর জগাদাকে এটা সেটা জ্ঞান দিত।

জগাদা ফুটবল, ক্রিকেট ভালোবাসতেন। খেলা থাকলে আমাদের কাছ থেকে জেনে নিতেন স্কোর৷
একদিন বৌদির দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। সেদিন কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ম্যাচ। ডার্বির জন্য দলের পতাকা হাতে পিক আপ ভ্যানে করে ইস্ট-মোহনবাগান সমর্থকরা মাঠমুখী। আমাদের থেকে অল্প কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল বিবুদা। হঠাৎ বৌদির কাছ থেকে তিনটে চায়ের গ্লাস নিয়ে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে জগাদা বলল,
– ভাইরা ট্যাক ইয়োর টি। ইপ ওু অয়ান্ট এনি তিং এলোস পিলিজ আস্ক মি..
আমরা তো অবাক, জগাদার মুখে ইংলিশ! বিশেষ করে আমি তো পুরো চমকে গেছি। আমি কিছু বলতে যাবো, হঠাৎ বিবুদা এসে জগাদার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আরিব্বাস জগা, তুই ইংরেজি বলছিস! স্পোকেন ইংলিশ জয়েন করলি নাকি? উৎসাহ পেয়ে জগাদা বলল,
– উচ্চারণটা কি খুব খারাপ করছি বিবুদা?
– আরে না, চেষ্টা তো কর।
– আর ব্যাকরণ? ভুল বলছি না?
– ও ঠিক হয়ে যাবে, ভয় পাবি না৷ ভুল বলতে থাক, একদিন সঠিক ইংরাজি বলবি।
বেশ ভালো লাগলো বিবুদার জগাদাকে উৎসাহ দেওয়া দেখে। বিবুদা ওখান থেকে অফিসের পথ ধরল। যেহেতু বিবুদা প্রশংসা করেছে, তাই আমাদের বাকি কলিগরা কেউ ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করতে পারল না।

(৩)

বিবুদার কিছুক্ষণ পর আমরা অফিস ফিরলাম আমরা। ঢুকতেই এক কলিগের প্রশ্ন,
– কি রে, শুনলাম জগাদা নাকি ফ্লুয়েন্ট ইংলিশ বলছে!
অফিসের ভেতরে তখন হা হা, হো হো, হি হি চলছে। বিবুদার গলা পেলাম, আমাদেরই এক কলিগকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
– সত্য ইংরাজিটা শিখে নে, তুই তো দিনে পাঁচ-ছবার জগার দোকান যাস। বাংলায় বললে কিন্তু চা দেবে না। দাড়িও কেটে দেবে না। আবার হাসির রোল উঠল অফিসে। ওই দিনটার পর থেকে জগাদা অফিসের কলিগদের এক বড় অংশের জন্য জোকার হয়ে গেল। অফিসে কলিগরা কিছুক্ষণ কাজ করার পর বলত, চল অনেক কাজ করলাম, এবার জগাদার ইংরাজি শুনে আসি একটু। এভাবে অফিসের প্রায় যেই বৌদির দোকানে চা খেতে যেত, জগাদাকে বাড় খাইয়ে ইংরাজি বলাতো। তারপর সেগুলো মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়ে এসে সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করা চলত। এসব দেখে খুব খারাপ লাগত, তাই জগাদার দোকান যাওয়া ছেড়ে দিলাম। একদিন অফিস থেকে ফিরছি হঠাৎ বৌদি ডাকল, ভাই একটু আসবে। গেলাম, কিছুটা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই। জানতাম গেলেই জিজ্ঞেস করবে কেন আসি না আর। আমি কী বলব। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গেলাম। বৌদি একটা ফর্ম বের করল, ইংরাজিতে লেখা।
– এটা একটু ফিল আপ করে দেবে ভাই?
দেখলাম সল্টলেকের এক নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভর্তির ফর্ম। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম বৌদির দিকে,
– আমাদের ছেলেকে ভর্তি করব এই স্কুলটায়, ফর্মটা তো ইংলিশে। তোমার দাদা তো পারবে না, তাই যদি একটু ফিল আপ করে দিতে। আসলে কী বল তো তুমি তো আর আসো না। আমি জানি কেন আসো না। অবাক হলাম। আসলে কী বল তো ভর্তির সময় তোমার দাদার আর আমার ইন্টারভিউ নেবে স্কুলটাতে, তাই তোমার দাদা কোথা থেকে একটা বই কিনে এনেছে। রোজ পাগলের মতো ভুলভাল ইংরেজি বলতে চেষ্টা করে। আর তোমাদের অফিসের সবাই ওকে নিয়ে মজা করে। আমি বলতে গেলাম, না মানে। কিন্তু ‘না’ শব্দটা কিরকম যেন গলায় আটকে গেল, বলতে পারলাম না৷
– জানি এই স্কুলে ভর্তি পাবে না বাবু, তাও তোমার দাদার জেদ দেখো না৷ এই ফর্মটা দুদিন ধরে বিবুদাকে দিয়ে ভরাতে চাইছে। আমিই আটকে রেখেছি। এসব দেখলে তোমােদের অফিসের লোকরা বেশি হাসবে, তাই তুমি যদি একটু ভরে দিতে। ততক্ষণ আশার দৃষ্টি নিয়ে জগাদা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চুপচাপ ফর্মটা ফিল আপ করে দিলাম। এরপর একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম ভর্তি হল? বৌদি চা দিতে দিতে শুকনো মুখে চেয়েছিল। আর কিছু জানতে চাইনি। মাস দুয়েক পরে জগাদারা আমাদের ওখান থেকে সেলুন আর দোকান উঠিয়ে কোথায় চলে গেল। আমিও অপিস চেঞ্জ করলাম। জগাদাদের খোঁজ আর রাখা হয়নি।

(শেষ)

মাঝে আমার নতুন অফিসে বিবুদাও জয়েন করল। জানি না কোন দৈববলে আমার এই কলিগ দাদাটি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে উঠে। বিবুদার বাড়িতেও যাতায়াত শুরু হল আমার। ওর ১২ বছরের
মেয়ে মাম্মামের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি কলকাতায় থাকতাম মেসে, আর বিবুদার বউ মানে লাবণ্য বৌদি অসাধারণ রান্না করত। ফলে বিবুদার বাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ হল। একদিন ডেস্কে বসে কাজ করছি, হঠাৎ বিবুদা এসে জোর করে নিজের গাড়িতে তুলে নিল।
-কোথায় যাচ্ছি আমরা?
– মাম্মামের স্কুল, ওর আজ রেজাল্ট।
আমরা যখন পৌঁছলাম পুচকি মেয়েটার স্কুল ছুটি হয়েছে। সব বাচ্চারা রুম থেকে বেরিয়ে আসছে৷ আমাদের দেখতে পেয়ে কার পার্কিংয়ের দিকে ছুটে আসল মাম্মাম।
-তুই কোন Rank করেছিস মা?
– আই হ্যাভ গট ৮২ পার্সেন্ট। অ্যান্ড আমি ফিফথ হয়েছি বাপি।
– নট ব্যাড, নট ব্যাড। দেন হু স্টুড ফার্স্ট ইন ইয়োর ক্লাস?
– নরেন্দ্র বাপি, নরেন্দ্র ফার্স্ট হয়েছে। ও ৯৮ পার্সেন্ট পেয়েছে। ম্যাথ, ফিজিক্স আর ইংলিশে হান্ড্রেড আউট অফ হান্ড্রেড।
– হু ইজ হি?
– দ্যাট গাই, হি ইজ জাস্ট আ জিনিয়াস। ও আমাকে প্রচুর হেল্প করে। বাপি ওকে ডাকবো?
– সিওর, নিশ্চয় ডাক।
– নরেন্দ্র এদিকে আয়, বাপি ডাকছে।
একটা বছর বারো-তেরোর ছেলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে এল আমাদের দিকে।
– তোমার নাম নরেন্দ্র?
– হ্যাঁ
– কনগ্রাটস ফর ইয়োর গ্রেট রেজাল্ট। কোথায় থাকো তুমি?
– থ্যাঙ্ক ইউ, আমি বেলঘরিয়াতে থাকি?
– এত দূর যাবে কিসে?
– বাসে করে।
টুকটাক কথা বলে ছেলেটি নিজের মতো চলে গেল। বিবুদা প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে গেল। আমি মাম্মামের সঙ্গে গাড়িতে বসে খুনসুটি করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়িটা মাম্মামের স্কুলের গেট ক্রশ করল। হঠাৎ নরেন্দ্র বাই বাই বলে গাড়ির ভেতর থেকে হাত নাড়তে লাগল বিবুদার মেয়ে। গাড়ির ভেতর থেকে তাকিয়ে দেখলাম নরেন্দ্রও মাম্মামকে হাত নেড়ে বাই করছে। আর ওর হাতের আঙ্গুল ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আমার পরিচিত পুরনো একটা চেহারা, জগাদা। নরেন্দ্রর মুখ আর জগাদার মুখ পাশাপাশি দেখলে আর কোন প্রশ্ন করার অবকাশ থাকে না। তবুও জিজ্ঞেস করলাম মাম্মামকে,
– তোর বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো ওই বয়স্ক লোকটা কে?
– কোনটা? ওই আঙ্কল টা? উনি তো নরেন্দ্রর বাবা।
ক্যাঁএএএএএচ, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষল। বিবুদা গাড়ি চালানো বন্ধ করে পেছনে ফিরে নিজের মেয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।বুঝলাম বিবুদারও চোখ পড়েছে জগাদার উপর।

গাড়ির পেছনের সাদা কাচ দিয়ে দেখলাম জগাদা হাসিমুখে ছেলের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে।