ধর্মান্তরিত না হ‌ওয়ায় আমার সন্তানদ্বয়ের তকমা ছিল ‘অবৈধ’, বিস্ফোরক কমলরুখ খান

0
1087

বঙ্গদেশ ডেস্ক:- ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হননি। সেজন্য বরাবর শ্বশুরবাড়ির তরফে দেওয়া হয়েছে চাপ। স্বামীর মৃত্যুর পরও হেনস্থা রয়েছে অব্যাহত। এমনই অভিযোগ প্রয়াত সঙ্গীত পরিচালক ওয়াজিদ খানের স্ত্রী কমলরুখ খানের।

শনিবার ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট করে ধর্মান্তরকরণ-বিরোধী বিলের স্বপক্ষে বলেছেন কমলরুখ। জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টির সঙ্গে কীভাবে তিনি ও তার দুই সন্তান সম্পর্কিত। ইনস্টাগ্রাম পোস্টে কমলরুখ লিখেছেন, তিনি জাতিগতভাবে পার্সি এবং ওয়াজেদ মুসলিম ছিলেন। সেজন্য বিশেষ বিবাহ আইনের আওতায় বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। যাঁরা কলেজ-জীবন থেকে সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ধর্ম পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে বলে অভিযোগ প্রয়াত সংগীত পরিচালকের স্ত্রী’র।

কমলরুখের ভাষায়, ‘মূল্যবোধের দিক থেকে সাধারণ পার্সি পরিবারে অত্যন্ত খোলামেলা স্বাধীন পরিবেশেই বড় হয়েছিলাম। ভাবনাচিন্তা, স্বাধীতার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করা হত। সবসময় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হত। কিন্তু বিয়ের পর আমার স্বামীর পরিবারের কাছে সেই স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং স্বাধীনচেতা মূল্যবোধ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজস্ব মতামত থাকা শিক্ষিত, সুচিন্তিত এবং স্বাধীন মহিলার একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা ছিল না এই পরিবারে। ধর্মান্তরকরণের জন্য যে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হত, তা অত্যন্ত অরুচিকর মনোভাব ও নিন্দাজনক ছিল।’

সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট থাকলেও ধর্মান্তরকরণে একেবারেই রাজি ছিলেন না বলে বলেছেন কমলরুখ। তিনি বলেছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘ধর্মান্তরকরণের জন্য’ ওয়াজেদের পরিবারের লোকজন ‘বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আমায় আদালতে নিয়ে যাওয়া-সহ বিভিন্ন জঘন্য কৌশল অবলম্বন করেছিল।’ তবুও ওয়াজিদের পরিবারের কাছে মাথা নোয়াননি তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি ভেঙে পড়েছিলাম, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার বলে ধারণা হয়েছিল এবং মানসিকভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমার সন্তানদের সঙ্গে আমি অন্যায় আচরণ মেনে নিইনি।’

কমলরুখ আরও বলেছেন, ‘ইসলামে ধর্মান্তরিত না হওয়ার জন্য আমি আবার অবস্থানে অনড় থাকলে আমার স্বামী এবং আমার মধ্যে মারাত্মকভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকে। স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় এবং আমাদের সন্তানদের বর্তমান বাবা হিসেবে ওর (ওয়াজেদ) ভূমিকা যথেষ্ট বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে ও এবং ওর পরিবারের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতা আমার মর্যাদা এবং আত্মসম্মানের পরিপন্থী ছিল।’

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কমলরুখ তার ধর্মান্তরিত হ‌ওয়ার অনীহার কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, যদিও ওয়াজেদ ধর্মান্তরিত হ‌ওয়ার অনীহা সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তবুও তার সঙ্গে বিবাহ করেছিলেন ও তার পরিবার বিয়ের বিরোধিতা করেছিল এবং এই সম্পর্কে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু তিনি বলেন “… সময়ের সাথে সাথে তার পরিবার, বিশেষত তার মা আমাকে ধর্মান্তরিত করার জন্য আমার উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল এবং কয়েক বছর ধরে, বিশেষত আমার বাচ্চাদের জন্মের পরে, এমন জোরাজুরি করতে শুরু করে যে আমার সঙ্গে আমার সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে।”

যদিও ওয়াজেদ খান প্রথমে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল, তবুও তাঁর মা এবং পরিবার জোর করে চাপ দিতে শুরু করেছিল। কমলরুখ খান বলেন, “বিয়ের পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল; আমার মাতৃত্ব সহ আমি যা কিছু করেছি যা আমার ধর্মের সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু তার পরিবারের ধর্মান্তরকরণের জোরজবস্তি ব্যবহার দেখে সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এর ফলে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ওয়াজেদ খান দোটানায় পড়ে যান।’

তিনি আরও জানিয়েছেন,“ওয়াজেদর পরিবারের বক্তব্য ছিল আমার সন্তানরা অবৈধ, করণ ওয়াজেদ ও আমি মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ে করিনি (নিকাহ, যা আমি যদি করতাম তবে আমাকে ইসলাম গ্রহণ করতে হতো)।ওয়াজিদ খানের পরিবারের সদস্যরা তার এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল যে তিনি পার্সি উৎসব পালন করছেন দেখে তার বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে নানান কথা বলতে শুরু করেন।” তিনি এ কথা জানিয়েছেন, ওয়াজেদ খানের পরিবারের সদস্যরা ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে পুনরায় বিবাহ করার জন্য কারন আমি ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি ছিলাম না।

কমলরুখ খান জানিয়েছেন ২০১৪ সালে ওয়াজেদ খান বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছিল এবং এই পদক্ষেপ তাকে বিধ্বস্ত করে তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন, “তাঁর মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদরা তাদের সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করেছিল এবং ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য চাপ দেয়ার ফলে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে যখন বেরিয়ে এসেছিলাম তখন আরশি প্রায় আড়াই কি তিন বছর বয়সী। হেরানের জন্মের পর আবার একই পরিস্থিতির শুরু হয় এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ২০১৪ সালে ডিভোর্স ফাইল করা হয়েছিল। ”

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত মে’তে মৃত্যু হয়েছে ওয়াজেদের। তার করোনা রিপোর্টও পজিটিভ ছিল। কমলরুখের দাবি, তাদের ১৬ বছরের মেয়ে এবং ন’বছরের ছেলেকেও ওয়াজিদের উত্তরাধিকার থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে তার পরিবার বঞ্চিত করেছে। কারণ তিনি ‘ধর্মান্তরকরণ’-এ রাজি ছিলেন না। কমলরুখের আক্ষেপ, এই ‘ধর্মান্ধতা’-র কারণে দুই সন্তান পরিবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মন থেকে ওর অভাব অনুভব করি এবং ভাবি যে নিজের সুরের প্রতি ও যেমন মনোযোগী ছিল, ধর্মীয় কুসংস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে পরিবার হিসেবে তেমনই যদি আমাদের সময় দিতে পারতো। ওর এবং ওর পরিবারের ধর্মান্ধতার কারণে আমরা পরিবারের সুখ বুঝতে পারিনি। ওর অকালপ্রয়াণের পরেও ওর পরিবারের তরফে হেনস্থা অব্যাহত রয়েছে।’

জোরপূর্বক ধর্মান্তরের গুরুতর বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে কমলরুখ খান বলেন, “আমার মতো শিক্ষিত, স্বতন্ত্র মহিলা যদি প্রেমঘটিত বিয়ে করে এবং ধর্মান্তরিত না হওয়ার জন্য এত খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। তাহলে যে সমস্ত মহিলা কমজোরি এবং সেভাবে আর্থিক স্বতন্ত্র নয় তাদের না জানি কতটা খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হয়। ”

এর আগে, তিনি বলেছিলেন যে ইউপি সরকার প্রবর্তিত রূপান্তর বিরোধী আইনটিকে জাতীয়করণ করা উচিত। কারণ আমার মত অনেক মেয়ে আছে যারা এই ধর্মান্তরকরণ ব্যাপারটিকে সাপোর্ট করে না। তাদের ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা দান করবে এই আইনটি। তিনি লিখে তাঁর দীর্ঘ পোস্টের সংক্ষিপ্তসারটি লিখেছেন: “পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা নয়, ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতায় আসল। সমস্ত ধর্ম ঈশ্বরের কথা বলে। বেঁচে থাকুন এবং অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করুন। এটাই আমাদের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত। “