কেন করোনার হাফ টাইমে মোদী বিজয়ী আর অমর্ত্য সেনের দল ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছেন?   

0
4111

– রাঘবন জগন্নাথন

 

মোদী-নীতি

অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে আমাদের কমোন সেন্স নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদদের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তববাদী এবং কার্যকরী।

কোভিড মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে দুটি প্রধান অভিযোগ আরোপ করা হয় মোদী সরকারের বিরুদ্ধে- 

  • প্রথমটা একটা অতি লম্বা লকডাউন ঘোষণা করার জন্য এবং 
  • দ্বিতীয়টি পড়তি অর্থ ব্যবস্থা এবং জিডিপির জন্য। 
  • এছাড়াও আরও একটি বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল এবং সেটি ছিল অর্থনীতির উদ্দীপনকর সে রকম কোন স্টিমিউলাস প্যাকেজ না ঘোষণার করা নিয়ে। 

কিন্তু করোনার এই হাফ টাইমে মোদীনমিক্স এই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দু গোলে হারাচ্ছে। 

 

করোনার বিরুদ্ধে লড়াই

করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা এখনো জিতি নি। কিন্তু তবুও ২১ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী ভারতে মোট ২৯২,৫১৮ জন কোভিড রুগী আছেন এবং এই সংখ্যাটা ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। উপরের সারণীতে দেখতে পাই যে ভারতের মত জনসংখ্যা থাকলে আমেরিকায় সাড়ে সাত কোটি ও ব্রিটেনে চার কোটির উপর কোভিড রোগী হত। ভারতে কিন্তু মাত্র এক কোটি রোগীই হয়েছে। প্রতিদিন নতুন রোগীর সংখ্য়া আগের দিনের চেয়ে কমছে।

 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পূর্বের মত হচ্ছে

এমনকি অর্থনৈতিক দিক থেকেও আমরা যুদ্ধে অনেক এগিয়ে আছি। ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে এবং দ্বিতীয়তেও, আমাদের নেতিবাচক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২০) এটি শূন্যের চেয়ে বেশি আসছে এবং শেষ কোয়ার্টারে আরও ইতিবাচক সংখ্যা আসার কথা। যদিও আমরা এখনও বলতে পারি না যে প্রবৃদ্ধিকে পুনরুদ্ধারের লড়াইটি নির্ধারিতভাবে জিতেছি। হয়তো বাজেটে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত উদ্দীপনা সরবরাহ করতে হবে।

রক্ষণশীল মোডিনোমিকসের সমালোচকরা যে কারণে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইবেন, তা সহজ: বেশ কিছুদিন ধরে তাদের দাবি ছিল যে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক রাজস্ব ব্যয় করতে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তাদের এই দাবী ছিল তখন, যখন শিল্প গুলিতে উৎপাদন পুরোপুরি শুরু হয় নি।

স্কুল-বইয়ের অর্থনীতি আমাদের বলে যে যখন সরবরাহের লিঙ্কগুলি সম্পূর্ণরূপে সচল হয় নি এবং যখন লোকেরা অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলিতে ব্যয় করা সম্পর্কে সতর্ক থাকে, তখন কেবল দুটি ফলাফল হতে পারে, উভয়ই নেতিবাচক: (১) আরও বেশী মূল্যস্ফীতি, এবং (২) পুরানো ঋণ পরিশোধ করার জন্য বা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় উচ্চতর সঞ্চয়।

 

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা কি বলেছিলেন?

তবে আমাদের নোবেল বিজয়ীরা, অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা, রঘুরাম রাজন থেকে কৌশিক বসু, উভয়েই প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এমনকি স্বামীনাথ আইয়ারের মতো অর্থনৈতিক ভাষ্যকাররাও চেয়েছিলেন যে ভারত বেশি করে অর্থ ব্যয় করুক।

লকডাউন ঘোষণার পরপরই এবং সরকার একটি যুক্তিসঙ্গত ত্রাণ-কাম-উদ্দীপনা প্যাকেজ ঘোষণা করার পর তারা যা বলেছিল, তা আমাদের শোনা উচিত।

২০২০ সালের মার্চ মাসে সরকারী উদ্দীপনা প্যাকেজে রঘুরাম রাজন বলেছিলেন: “দরিদ্র পরিবারগুলিতে প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য; এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলিকে ঝণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলিতে ঝণের গ্যারান্টি রয়েছে, যদিও সরকার এবিষয়ে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ” তিনি আরও যোগ করেছিলেন যে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের জন্য অর্থ সঞ্চয় কের রাখার সরকারের কৌশলটি ছিল “স্ব-পরাজয়”।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আর্থিক উদ্দীপনা সম্পর্কে বলেন: “আমরা সত্যিই একটি বৃহৎ পর্যাপ্ত উদ্দীপনা প্যাকেজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হয়েছি। আমরা এখনও জিডিপির ১ শতাংশের কথা বলছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিডিপির ১০ শতাংশ ব্যয় করেছে … আমি মনে করি ব্যয় করা অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের সহজতম উপায়। কারণ তখন এমএসএমইরা অর্থ পান, তারা এটি ব্যয় করে এবং তারপরে এটি সাধারণ কেনেসিয়ান চেইন প্রতিক্রিয়ায় চলতে থাকে। আমরা পুরো রিটেল সেক্টরটি বন্ধ করতে পারি না কারণ তারা করোনভাইরাস রেড জোনে অবস্থিত ”।

কৌশিক বসু: “… আমাদের একটি বৃহত্তর উদ্দীপনা দরকার। আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য এবং সরকার যাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না করে তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের ২০০৩ এর এফআরবিএম আইন রয়েছে। তবে এফআরবিএম আইনটির একটি অংশ আছে যা স্বীকৃতি দেয় যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমাদের আরও বড় ঘাটতি বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া উচিত। “

সবচেয়ে খারাপ পরামর্শটি এসেছে তাঁর স্বামীমোনমিক্স কলামে কলাম লেখক আইয়ারের কাছ থেকে। তিনি সরকারের উদ্দীপনাটিকে “অতি ক্ষুদ্রতর; একটি কৃপণতার টেবিল থেকে উৎপন্ন পদক্ষেপ” বলেছিলেন।

তিনি লিখেছিলেন: “ভারতের পক্ষে শিক্ষা স্পষ্ট। কমপক্ষে ত্রাণ প্যাকেজ তিনগুণ করুন এবং অভাবীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আরও বেশি অর্থ পাঠান। সমস্যাটি ছয় থেকে নয় মাস অব্যাহত থাকলে ত্রাণ প্যাকেজ পাঁচগুণ বাড়িয়ে দিন। ”

তবে বাকীদের মতো নয়, আইয়ার কমপক্ষে স্বীকার করেছেন যে তিনি ভুল ছিলেন।  তিনি টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক সময়ে লিখেছেন: “কোভিড -১৯ সংকট শুরুর পর থেকে অর্থ মন্ত্রকটি মূলত আর্থিক বাজেট হস্তান্তরের চেয়ে আর্থিক ব্যবস্থা এবং ঋণের গ্যারান্টির উপর নির্ভর করেছিল। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম যে এটি বিপর্যয় রোধ করতে বা অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করতে ব্যর্থ হবে। আমি নিশ্চয়ই ভুল ছিলাম। বিহারের সরকারের প্রতি ভোটার বিদ্রোহ তৈরি না করে বা কঠিন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যর্থ না হওয়ায় আমি অবাক হয়েছি। আমি এখনও মনে করি মার্চের লকডাউন এবং ফিনান্সিয়াল পার্সিমনির তীব্রতা মারাত্মকভাবে ছাড়িয়ে গেছে। তবে প্রকৃত ফলাফলগুলি আমার প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে।”

মোদিনোমিক্স সম্পর্কিত যে রায়টি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে আই আই এম আহমেদাবাদের অধ্যাপক টি টি রাম মোহন দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি হাই-প্রোফাইল সমালোচকরা লকডাউনের পরপরই সরকারকে যে খারাপ পরামর্শ দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দিয়েছেন।

লিখেছেন রাম মোহন: “মহামারীটির প্রাথমিক মাসগুলিতে অতিরিক্ত শক্তিশালী রাজস্ব প্রতিক্রিয়ার দাবিতে একটি দল ছিল। প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রমনিয়ান ও অর্থনীতিবিদ দেবেশ কাপুর সরকারকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ ব্যয় করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের ধারণা ছিল যে ভারতের আর্থিক অনুপ্রেরণা অপর্যাপ্ত এবং পরবর্তীকালের জন্য রাজস্ব উদ্দীপনা সংরক্ষণের কৌশলটি ছিল স্ব-পরাজিত। নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে উন্নত অর্থনীতির অনুকরণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন যা আরও বেশি উদ্দীপনা নিয়েছিল। ভারতে অবস্থিত শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এই মতামত প্রতিধ্বনিত করেছেন। ”

নরেন্দ্র মোদির নিম্ন-প্রোফাইল অর্থনীতির নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিলের বিবেক দেবরায় এবং তাঁর দল যথাক্রমে অর্থ মন্ত্রকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কে সুব্রমনিয়াম এবং সঞ্জীব সান্যাল এই সব ভুলভাল পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন এবং বুদ্ধিমানের মতো পদক্ষেপ নিয়়েছেন।

রামমোহনের সমাপ্তি: “সরকার এক বিরাট ধাক্কা খেয়েও নিজের স্নায়ু ধরে রেখেছে। এটি একটি বিশাল আর্থিক উৎসাহ অবলম্বন না করা বেছে নিয়েছে। এর পরিবর্তে বাজারে আরও নোট সরবরাহ এবং পর্যায়ক্রমে চলাচলে বিধিনিষেধ হ্রাস করার দিকে মনোনিবেশ করেছে। যেখানে ঋণ আছে তা জমা দিন। অতিমারীকালীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সরকার তার ইতিবাচক জবাব পেয়েছে। ”

 যুদ্ধ জেতা তো দূরের কথা, তবে হাফ টাইমে, মোডিনোমিক্স এবং প্রধানমন্ত্রীকে যে টিম পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাদের সকলকে অভিনন্দন জানানো দরকার। সমালোচকদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন যে তাঁরা এটি ভুল করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে নিদেনপক্ষে এই আশাটুকু করা যেতে পারে।

লেখক স্বরাজ্য়ের সম্পাদক। মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন ময়ূখ দেবনাথ।