কোভিড এবং আমাদের রাজ্যের প্রধান

0
881

সোমু দেব

চতুর্থ মার্চ, ২০২০। আমাদের মাননীয়া ‘দিদি’ দক্ষিন দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে একটি জনসভায় বললেন যে দিল্লি দাঙ্গা থেকে মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে করোনা -আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। দিল্লি দাঙ্গায় মৃত ব্যাক্তিরা কোন করোনা ভাইরাসের কারণে মারা যায়নি। তারা সুস্থ অবস্থায় মারা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে বিষয়ে কিছু বলছেন না, শুধু করোনা নিয়ে বলে চলেছেন।

উপরের অংশটিকে যদি একটি keynote address বলে ধরে নিই, পরবর্তী ঘটনাবলী কোন পথে অগ্রসর হবে বোঝা খুব কঠিন কি? ঘটনা তাই স্বাভাবিক প্রবাহেই প্রবাহিত হয়েছে। যত দিন গেছে পশ্চিমবঙ্গবাসী সাক্ষী হয়েছে এক একটি অভূতপূর্ব নাট্য-তামাশায়। এ নাটকসমূহের নাট্যকার, নির্দেশক ,মঞ্চসজ্জা, অভিনয় , সবই একজনের ‘অসামান্য ‘ কীর্তি। কারণ একটিই তো পোস্ট, বাকি সব ……।

মার্চ ২৪, ২০২০। Disaster Management Act 2005 এর 6(2)(i) সেকশন প্রয়োগ করে সমগ্র দেশে ২১ দিনের লকডাউন জারি করা হল। রাজ্যবাসী দেখল এক আচমকা ‘মায়ের মতো’ রাজ্যপ্রধান। সত্যিই তো , সব বিষয়ে রাজনীতি করা উচিত নয় , পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা বিস্ময়ের চোখ দিয়ে দেখা শুরু করলেও বিশ্বাস করতেও দেরী করল না। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো তো পাপ তাই না।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও নিঃসন্দেহে লজ্জা পেতেন আমাদের নির্বাচিত রাজ্যপ্রধানের বহুমুখী প্রতিভার সন্ধান পেলে। কি জানেন না বলুন তো। Medical Science এর যে কোন শাখায় কি স্বচ্ছন্দ চলাফেরা। যে আত্মবিশ্বাসের জোরে ১৫০০ কেজি বাচ্চা জন্ম নিয়েছিল,সেই বিশ্বাসের দাপটেই তো না একা হাতে উনি সামলাতে নেমে পড়লেন। ওনার কমিটিতে কোন অতিমারীর বিশেষজ্ঞ নেই বলে অনেকে চেঁচামেচি করছেন।কি মুশকিল। দরকার কি আছে এসব বিশেষজ্ঞের। উনি তো স্বয়ং পথনির্দেশ করে দিচ্ছেন কি ভাবে চললে রক্ষা পাওয়া যাবে এই অতিমারীর প্রকোপ থেকে। দেখুন তো , অন্য কোন রাজ্যের প্রধান এভাবে সামনে থেকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামিল হয়েছেন। অনুপ্রাণিত হয়ে ওনার টিমের একজন ‘মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ‘ চিৎকার করে মহাশক্তিধর এক রাষ্ট্রের প্রধানকেই মহামূর্খ বলে ফেললেন। কাঁটা তো গোলাপেরও থাকে, অনুপ্রেরণার জ্বালা থাকবে না তা তো হতে পারে না। সেই বিশেষজ্ঞ, মানে অতিমারীর মোকাবিলায় তৈরি করা কমিটির মুখপাত্রস্বরূপ সেই মেডিসিন-বিশেষজ্ঞ আসলে অনুপ্রেরণার জ্বালায় জ্বলেছেন।বার্ণল ‘উনিই’ বাড়িয়ে দিয়েছেন নিশ্চয়ই।

জাতীয় শিক্ষানীতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারিত করতে বলেছেন। ভবিষ্যতে যাতে হাতেকলমে কাজ শিখে বাস্তব দুনিয়ায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে পারে সে কারণেই বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যের প্রধানকে দেখলে মনে হয় এসব শিক্ষাদীক্ষা অপ্রয়োজনীয়। ওনার জীবনী পড়ানো গেলেই ছেলেমেয়েদের ‘আত্মবিশ্বাস’ শুধু বাড়বে তাই নয়, তারা তীব্র ‘আত্মনির্ভর’ ও হবে। যেমন ধরুন, কি অবিশ্বাস্য দক্ষতার সাথে উনি রাস্তায় ছবি এঁকে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এটাকে আত্মনির্ভরতা বলব না তো কোনটাকে বলব। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বলে কি ছবি আঁকা কম গুরুত্বপূর্ণ ? পারবেন অন্য কোন মুখ্যমন্ত্রী এভাবে রাস্তায় নেমে নিজের হাতে ছবি একে বোঝাতে?

সব ঠিকঠাক চলছিল। গণ্ডগোল করে দিল ওই এক সেন্ট্রাল টিম।২০শে এপ্রিল তারা এসে পৌছল আর সোনায় মোড়া বাঙলার কি বদনাম শুরু করল। ওনার তৈরি করা মেডিকেল কমিটি কত যত্ন করে সাজিয়েছিল সবকিছু। ফুলের বাগান তছনছ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় দলের হানাদারিতে।

সেন্ট্রাল টিম বলে কিনা যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের methodology ঠিক নেই। ইয়ার্কি হচ্ছে। আমাদের মাননীয়া নেত্রী, আমাদের মা যে methodology ঠিক করে দিলেন তার উপরে কথা। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কেন ব্যাখ‍্যা দিতে হবে কিছু ‘মোদির চর’ কে? কি দু:সাহস? একজন অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের আধিকারিক আমাদের জননেত্রীর প্রশাসনের ভুল ধরছেন। বলে কিনা আমাদের রাজ্যের মৃত্যুহার ১২.৮% , যে কোন রাজ্যের মৃত্যুহারের থেকে অনেক বেশি। এটা একটা চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু হতে পারে? সব গেরুয়া রাজ্যগুলিতে নাকি মৃত্যুহার কম। এটা বিশ্বাসযোগ্য? ছি ছি। তবে বেওয়ারিশ লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ অবশ্য এরা সেইভাবে তোলে নি।

বলে কিনা রাজ্যের মেডিক্যাল বুলেটিন আর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিবের কাছে পাঠানো রিপোর্ট এক নয়। ত্রিশে এপ্রিলের মেডিক্যাল বুলেটিন বলছে যে কোভিড কেসের সংখ্যা ৭৪৪, অথচ একই দিনে কেন্দ্রীয় সচিবকে রাজ্য সরকার যে রিপোর্ট পাঠায় তাতে কেসের সংখ্যা ৯৩১। তাহলে ১৮৭ সংখ্যার তফাত। আচ্ছা,এই সব যোগবিয়োগ নিয়ে এরকম একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী,সামনে থেকে লড়াই করা মানুষকে বিব্রত করা কি উচিত? এরা প্রতিভার দাম দিতে জানে না।

আবার শেষমেশ ‘গরু মেরে জুতো দান ‘ করল। প্রথমে testing , tracking , surveillance সন্তোষজনক নয় বলে যাবার বেলায় প্রশংসা করে।বলে কিনা বিশে এপ্রিল যেদিন ওরা পা রাখল , সেদিন প্রতিদিন ৪০০টা টেস্ট হত আর দোসরা মে মানে যেদিন ওরা চলে যাচ্ছে সেদিন ২০৮০টি টেস্ট প্রতিদিন হচ্ছে। অর্থাৎ অনেক উন্নতি হয়েছে। বেশি চালাকি। ওদের নজরদারিতে টেস্টের সংখ্যা বেড়েছে এটা মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা ছাড়া আর কি। মানে সব ওদের জন্যই হল। শুধু নিজেদের দিকে ঝোল টানা। সাথে সাথে ওদের আই টি সেল চতুর্গুণ প্রচার শুরু করে দিল। যেমন মোদি তেমনিই তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। কতখানি ফ্যাসিস্ট এরা দেখুন। এত সহযোগিতা আমাদের রাজ্য করল, আমাদের ঘরে ঢুকে উৎপাত করল, অথচ তাও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব আমাদের মুখ্য সচিবকে কি ভাবে শাস্তির হুমকি দিয়ে চিঠি দিলেন।ওদের সাথে নাকি comply করা হচ্ছে না। এমনকি ওই যে মহিলা যুগ্মসচিব, কি পূণ্যসলিলা শ্রীবাস্তব নাকি কি যেন নাম, সর্বভারতীয় মিডিয়ার সামনে বলেই বসলেন যে সব রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় টিম সহযোগিতা পাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া। কি অপমান ভাবুন এই রাজ্যের, আমাদের এই জনপ্রিয় রাজ্য প্রধানের সম্মানহানির একটি অপচেষ্টা।

আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী ওই মোদীর উপস্থিতিতেই স্পষ্ট ভাষায় বললেন যে আমাদের রাজ্য বিনা পয়সাতে কোভিড এর চিকিৎসা করছে। সেটা নিয়েও কত ব্যঙ্গ। কোন হাসপাতালে দশ লাখ বিল, কোথাও আঠারো লাখ, এই নিয়েই শুধু আলোচনা।প্রাইভেট হসপিটালের অস্বাভাবিক বিল নিয়ে নাকি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কিছুই করছেন না। প্রাইভেট হসপিটালদের উদ্দেশ্যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না, কিছু দেখছে না।

দুষ্টু লোকেরা কত কিছুই তো বলে। গান্ধীজির ছাগলের দুধ খাওয়া নিয়েও তো কত কথা হয়েছে। সেরকম এখানেও এত বড় একজন জননেত্রীর সম্বন্ধেও লোকে যারপরনাই খারাপ কথা বলছে। প্রাইভেট হসপিটালের এক তারকা চিকিৎসক নাকি মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। তার হসপিটালেই নাকি ভয়ংকর ভয়ংকর সব বিল আসছে।আর মুখ্যমন্ত্রী সব দেখেশুনে চুপ করে থাকছেন। কি বিচ্ছিরি ইঙ্গিত বলুন তো। এরকম ‘চরিত্রহনন’ কি নৈতিক , বিচার করুক পশ্চিমবঙ্গের জনতা।

পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে কি স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিচয় দিল বলুন তো এই মোদি সরকার। জোর করে ওদের পাঠালো এই সময়। আমরা কি ওদের পর? ওদের দূরে সরিয়ে কি রাখতে চেয়েছি? আমরা শুধু বলেছি রোগ আপন নয়,মানুষ আপন। রোগ বাদ দিয়ে মানুষগুলো যতদিন বাইরে রোজগার করছিল, আপনই তো ছিল আমাদের। অথচ আমাদের বন্ধু, মানে শত্রুর শত্রু বন্ধুই তো হয় নয় কী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পিনারাই সাহেব এমনকি উদ্ধবজী পর্যন্ত আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধুত্বের মর্যাদা না দিয়ে বাংলার শ্রমিকদের দায় নিতে রাজি হলেন না। ছেলেগুলোকে তাড়িয়ে দিলেন ওরা। আমাদের দিদি ফ্যাসিস্ট মোদী-শাহের থেকে এই ব্যবহার পেতে প্রস্তুত ছিলেন।অপ্রত্যাশিত আঘাত পেলেন বন্ধুদের ব্যবহারে।

এত লোককে ফিরিয়ে নেওয়ার পরেও কি বদনাম কমল।এখন এই মোদীর চ্যালারা বলে বেড়াচ্ছে যে এই শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কেন্দ্রীয় সাহায্য থেকেও নাকি দিদির দলের ছেলেরা ‘কাটমানি’ নিচ্ছে। আর শান্তি নেই আমাদের নেত্রীর।

উপরের অংশগুলো, আমাদের রাজ্যের প্রধান নাট্যকার এবং তার সহযোগীদের দৃষ্টিতে , গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া নাটকের বিভিন্ন অংশ। ভগবান সবার মঙ্গল করুন।

(মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের। বঙ্গদেশ পত্রিকা দায়ী নয়।)