সর্বধর্মবাদ কি বাঙালীর ঐতিহ্য?

ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি যে বাঙালীর ঐতিহ্যের অঙ্গ হচ্ছে সর্বধর্মসমভাব। এই কথাটি এতটাই স্বতঃসিদ্ধের মত দলমতনির্বিশষে বাঙালীরা সবাই বলে থাকেন যে এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করলেই উন্মাদ প্রতিপন্ন হতে হয়। এইরকম পরিস্থিতিকে বর্ণনা করতে  কথাসাহিত্যিক শরৎবাবু লিখেছেন যে,

“কোন একটা কথা বহু লোকে মিলিয়া বহু আস্ফালন করিয়া বলিতে থাকিলেই কেবল বলার জোরেই তাহা সত্য হইয়া উঠে না। অথচ এই সম্মিলিত প্রবল কণ্ঠস্বরের একটা শক্তি আছে এবং মোহও কম নাই। চারিদিক গমগম করিতে থাকে—এবং এই বাষ্পাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দুই কানের মধ্যে নিরন্তর যাহা প্রবেশ করে, মানুষ অভিভূতের মত তাহাকেই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসে। Propaganda বস্তুতঃ এই-ই।… যে দুই-একজন প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিল, আসল কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের অবধি ছিল না।”

(বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, শরৎ রচনাবলী)

বর্তমান সর্বধর্মবাদের উৎস

সর্বধর্মসমভাবের মূল বক্তব্য হল, ধর্ম সবই সমান। এই সর্বধর্মসমভাব কোন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নয়, এক মতবাদ মাত্র।  আমি একে সংক্ষেপে সর্বধর্মবাদ নামে ব্যক্ত করেছি।

সর্বধর্মবাদের এই গমগম করা আস্ফালনের উৎস ঠিক কোথায়? অনুসন্ধানে প্রতিপন্ন হয় যে দুই সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ থেকে জন্ম নেয় এই সর্বধর্মবাদ।

প্রথম ধারার লোকেরা ধর্মভীরু। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস যে ধর্মের মূল কথা সর্বধর্মেই সমান। এই বিশ্বাসবাদীরা বলেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। তাই তাঁরা তর্কে নারাজ।  মূলতঃ গান্ধীবাদীরা এই বিশ্বাসবাদের ধারক ও বাহক।

দ্বিতীয় ধারার লোকেরা ঠিক এর বিপরীত স্বভাবের। তাঁরা তর্কঅন্তপ্রাণ (অন্ততঃ তাই তাঁদের আদর্শ)। কিন্তু দিনের শেষে তাঁদের তরী এসে ঠেকে মার্ক্সবাদের ঘাটে।  এই মার্ক্সবাদের মূল কথা হল, ধর্মমাত্রই হচ্ছে মানুষের আফিম। অতএব সর্বধর্মই সমানভাবে খারাপ। আবার ঘুরেফিরে সেই সর্বধর্মবাদ।

এই দুই মতবাদের, গান্ধীবাদ ও মার্ক্সবাদের, বাংলার মাটিতে প্রবেশ একশত বছরও নয়। বাঙালী ঐতিহ্য বহুশত বছরের প্রাচীন। সেই ঐতিহ্য কি সর্বধর্মবাদের?

উত্তর এক কথায় নঞর্থক।  বিশদ ক্রমপ্রকাশ্য।

প্রকৃতি-উপাসক আর আব্রাহামীয়বাদ

সমস্ত প্রকৃতি-উপাসক ধর্মাবলম্বীদের স্বাভাবিক  প্রবণতা হল, সমস্ত রকম ঈশ্বর বিশ্বাসকে মান্যতা দেওয়া।  এই  স্বাভাবিক প্রবণতা প্রাচীন রোমের মূর্তি-উপাসক  থেকে  বাঙালী  হিন্দুদের মধ্যে সমানভাবেই বিদ্যমান। অন্যদিকে আব্রাহামীয় মতবাদগুলি সর্বদা একমাত্র নিজের যথার্থতায় বিশ্বাসী এবং অন্যদের মতবাদের প্রতি ঘোষিতভাবেই অসহিষ্ণু ।

প্রাচীন রোমের মূর্তি-উপাসকরা কিছুতেই অনুধাবন করতে পারতেন না কিভাবে খ্রীষ্টানরা বিশ্বাস করতে পারে যে একমাত্র তাদের মতবাদই সত্য আর সব মতবাদই মিথ্যা।  (বিস্তারিত পড়ুন Jonathan Kirschএর God against the gods: The History of the War Between Monotheism and Polytheism ) সেই একই স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে বহু বাঙালী হিন্দুরাই সমস্ত মতবাদের  প্রতি শ্রদ্ধার কথা বলে গেছেন, যেমন ব্রাহ্মমতের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় বা রামকৃষ্ণ পরমহংস।

সব মানুষকে শ্রদ্ধা করার অর্থ কি মেনে নেওয়া যে মানুষে মানুষে কোন প্রভেদ নেই?  কেউই বোধ করি সে কথা বলবেন না। সেরকম সর্ব  ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেই কি মেনে নিতে হবে যে তারা একই ভাবের দ্যোতক?

সর্ব  ধর্মের ভাব তখনই সমান মনে করা সম্ভব হবে যখন সমস্ত ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ  করে তাদের মধ্যে একই সত্য দেখা যাবে।  এ হল তাত্ত্বিক দৃষ্টি।

ধর্মজগৎ নিয়ে নিরপেক্ষ তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার মানুষ অল্প। উপরন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে বিভিন্ন ধর্মের সম্যক  তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা বা বোঝা অনেকাংশেই কষ্টসাধ্য।  সর্বধর্মসমভাব বোঝার অন্য উপায় হচ্ছে প্রায়োগিক পন্থা। যখন বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সমান ভাবে পরধর্মসহিষ্ণুতা এবং জাতীয়তাবাদ  পরিলক্ষিত হবে, প্রায়োগিক দৃষ্টিতে তা হবে সর্বধর্মবাদের রূপ।  এই দুই দৃষ্টিতেই আমরা অনুসন্ধান করব যে গান্ধীবাদ ও মার্ক্সবাদের propagandaর বাইরে বাঙালী সংস্কৃতিতে কি সেই সর্বধর্মবাদ ফুটে উঠেছে?

মধ্যযুগের বাঙালী এবং ইসলাম

আব্রাহামীয় মতবাদগুলির মধ্যে বাঙালীর সাথে প্রথম পরিচয় হয় ইসলামের যখন কুতুবুদ্দিন আইবকের তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী  খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে নালন্দা ও ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে  বাংলায় আসেন এবং সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাস্ত করে মুসলমান রাজত্ব স্থাপন করেন।  কিন্তু ইসলাম নিয়ে সাধারণভাবে বাঙালী  মধ্যযুগে কোন তাত্ত্বিক বিশদ গবেষণা করেন নি।

কেন?

মধ্যযুগের মুসলমান পর্যটক ও পণ্ডিত আল-বিরুণীর মতানুসারে, তৎকালীন হিন্দুরা মনে করতেন­­  যে তাঁদের জ্ঞান বিশ্বের সর্বোত্তম এবং আপন পরিসরের বাইরের কিছুকে গ্রহণ করতে তাঁরা ছিলেন অনেকাংশেই বিমুখ। বাঙালীদেরও অন্য হিন্দুদের মত এই গর্বান্ধ মনোভাব থাকাটাই ছিল তখনকার দিনে স্বাভাবিক। ফলে ইসলাম নিয়ে বাঙালীদের  না ছিল  জানবার বিশেষ কোন আগ্রহ বা ছিল না কোন ধ্যান-ধারণা।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সমাজের কথা বার বারই এসেছে এবং অনেক সময়ই তাতে মুসলমানদের পরধর্ম-অসহিষ্ণু এবং অত্যাচারী হিসাবে আমরা পাই। সর্বধর্মবাদের কোন রূপ নজরে আসে না।

যেমন? মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত (খ্রীষ্টীয় ১৫শ শতক) লিখেছেন‑

যাহার মস্তকে দেখে তুলসীর পাত।
হাতে গলায় বাঁধি লয় কাজির সাক্ষাত।
কক্ষতলে মাথা থুইয়া বজ্র মারে কিল।
পাথর প্রমাণ যেন ঝড়ে পড়ে শিল।
পরের মারিতে পরের কিবা লাগে ব্যথা। [৩৫]

অর্থাৎ, যাদের গলায় তুলসীমালা ছিল, তাদের বেঁধে আনা হল কাজীর কাছে। কাজী মাটির মেঝেতে তাদের মাথা রেখে তীব্রজোরে নিষ্ঠুর সহানুভূতিশূন্য হৃদয়ে কিল মারতে লাগল।

বামপন্থী ঐতিহাসিকরা  হয়তো বলে বসবেন যে কাজী ছিলেন সরকারী প্রতিনিধি, কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রূপ নন এবং কাজীর এই অত্যাচার এক শ্রেণীসংগ্রাম মাত্র।

বেশ। তাহলে কাজী কেন শুধু তুলসীমালাধারী হিন্দু আচারীদেরই নিশানা করলেন? এর উত্তর বামপন্থীদের কাছে আর নেই।

মধ্যুযুগীয় ইসলামবাদের এই অ-সর্বধর্মবাদী রূপকে শরৎবাবুর ভাষায়  ব্যক্ত করে বলি—

“একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুতঃ অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই।”

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ, রাজসিংহ প্রভৃতি বহু উপন্যাসে মুসলিম শাসনের এই পরধর্ম-অসহিষ্ণুতা এবং অত্যাচারকে তুলে ধরেছেন। আর সেই কারণেই আনন্দমঠ উপন্যাসের শেষে তাঁর উপন্যাসের বিবেক-চরিত্রটি মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী  সন্ন্যাসীদের নেতার উদ্দেশ্যে  বলেছিলেন, “তোমার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে, মুসলমানরাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। আর তোমার এখন কোন কার্য নাই। অনর্থক প্রাণিহত্যার প্রয়োজন নাই।”

সাহিত্যসম্রাট একাকী নন। অন্যান্য অনেক ঐতিহাসিক কাহিনীকারদের উপন্যাস-গল্পেও একই জিনিস ফুটে ওঠে। যেমন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যান, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বীরবাহু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অশ্রুমতী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুঙ্গভদ্রার তীরে বা শঙ্খ-কঙ্কণ সর্বত্রই মুসলমান শাসনের বিজাতিয়তাবাদী অত্যাচার ফুটে ওঠে।

বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন হিন্দুধর্মের অনুশীলন তত্ত্বে। এই তত্ত্বের আদর্শেই লিখিত হয় আনন্দমঠ এবং এই উপন্যাসের অন্তর্গত বন্দেমাতরম্  সঙ্গীত। এই তত্ত্ব কি সর্বধর্মবাদের দ্যোতনা দেয়? উত্তর দিয়েছেন বামপন্থী মুজফ্ফর আহমদ তাঁর “আমার জীবন ও ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি” পুস্তকে। তিনি লিখেছেন,

“বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্ গানের উচ্চারণ একেশ্বরবাদী (অর্থাৎ  আব্রাহামীয় মতবাদী) কোন মুসলিম ছেলের পক্ষে অসম্ভব।”

অতএব, সহজ সিদ্ধান্ত হল, বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব আর যাই হোক, সর্বধর্মবাদ নয়।

বঙ্কিমবাবুকে এই সব কারণে মার্ক্সবাদীরা সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়। এই আখ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সর্বধর্মবাদ। কিভাবে?

যদি সর্বধর্ম সত্যই সমান হয়, তবে মুসলমানরাজ্যকে অহেতুক অত্যাচারী হিসেবে তুলে ধরা অন্যায্য, মিথ্যাভাষণ এবং বঙ্কিমবাবু নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক। কিন্তু যদি সর্বধর্মবাদ সত্য না হয় এবং বঙ্গিমবাবু মিথ্যাবাদী না হন, তাহলে?

মার্ক্সবাদীরা তো কখনও বলেন না যে চেঙ্গিজ খানের বা এটিলার নিন্দাকারী কোন ইতিহাসবিদ্  মোঙ্গলবিদ্বেষী বা হুনবিদ্বেষী এবং সাম্প্রদায়িক।  একইভাবে মুসলমানরাজ্যের অত্যাচারের সত্য বর্ণনার জন্য বঙ্কিমবাবুকে সাম্প্রদায়িক বলা সত্যের অপলাপ ও গোঁড়ামি মাত্র।

 

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস

সাধারণভাবে সবাই শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বধর্মবাদী হিসেবে জানে। সে কারণে একবার বর্তমানের এক প্রখ্যাত বাঙালীকে এই কালীসাধককে “সেকুলার” বলতে শুনেছিলাম। অথচ “মুসলমানরাজ্যের” স্বরূপ নিয়ে এই সর্বধর্মবাদী/ সেকুলার বাঙালীর মতের সাথে “সাম্প্রদায়িক” বঙ্কিমচন্দ্রের মতের কোন পার্থক্যই নজরে আসে না। শ্রীরামকৃষ্ণের কথাতেও মুসলমান রাজ্যের পরধর্ম-অসহিষ্ণুতা, তরবারির ডগায় ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি একইভাবে ফুটে উঠেছে।

“মুসলমানদের যখন রাজ্য হল তখন সেই ভক্তকে ধরে মুসলমান করে দিল, আর বললে, তুই এখন মুসলমান হয়েছিস, বল আল্লা! কেবল আল্লা নাম জপ কর। সে অনেক কষ্টে আল্লা, আল্লা বলতে লাগল। কিন্তু এক-একবার বলে ফেলতে লাগল ‘জগদম্বা!’ তখন মুসলমানেরা তাকে মারতে যায়। সে বলে, দোহাই শেখজী! আমায় মারবেন না, আমি তোমাদের আল্লা নাম করতে খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের জগদম্বা আমার কণ্ঠা পর্যন্ত রয়েছেন, তোমাদের আল্লাকে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছেন।”

সর্বধর্মবাদ নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের নিম্নোক্ত এই গল্পটি লোকের মুখে মুখে ফেরে:

 “যেমন ‘জল’ ‘ওয়াটার’ ‘পানি’। এক পুকুরে তিন-চার ঘাট; একঘাটে হিন্দুরা জল খায়, তারা বলে ‘জল’। একঘাটে মুসলমানেরা জল খায়, তারা বলে পানি’। আর-এক ঘাটে ইংরাজেরা জল খায়, তারা ‘ওয়াটার’। তিন-ই এক, কেবল নামে তফাত। তাঁকে কেউ বলছে ‘আল্লা’; কেউ ‘গড্‌’; কেউ বলছে ‘ব্রহ্ম’; কেউ ‘কালী’; কেউ বলছে রাম, হরি, যীশু, দুর্গা।”

উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে উক্ত গল্পে কোথাও বলা নেই যে মতবাদ হিসেবে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে ভাবের কোন প্রভেদ নেই। এই গল্পটি মতবাদীদের নিয়ে। এক সাধারণ হিন্দু কোন পরম শক্তির যে  ধারণা করে, হয়ত সেই ধারণা কোন সাধারণ মুসলমানকৃত পরম শক্তির ধারণার অনুরূপই হয়।

যখন ধর্মমত নিয়ে প্রশ্ন অসেছে, শ্রীরামকৃষ্ণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তাঁর দৃষ্টিতে হিন্দুধর্ম আব্রাহামীয় ধর্মের থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁর কথায়,

 “হিন্দুধর্মই সনাতন ধর্ম! ইদানীং যে সকল ধর্ম দেখছ এ-সব তাঁর ইচ্ছাতে হবে যাবে — থাকবে না। তাই আমি বলি, ইদানীং যে সকল ভক্ত, তাদেরও চরণেভ্যো নমঃ। নিন্দুধর্ম বরাবর আছে আর বরাবর থাকবে।”

তাঁকে যখন বাইবেল পড়ে শোনানো হয়েছিল, তখন তিনি উক্ত পুস্তকে লিখিত অংশের সঙ্গে একেবারেই সহমত হন নি—

“খ্রীষ্টানদের একখানা বই একজন দিলে, আমি পড়ে শুনাতে বললুম। তাতে কেবল ‘পাপ আর পাপ’। (কেশবের প্রতি) তোমাদের ব্রাহ্মসমাজেও কেবল ‘পাপ’। যে ব্যক্তি ‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ বার বার বলে, সে শালা বদ্ধই হয়ে যায়! যে রাতদিন ‘আমি পাপী’, ‘আমি পাপী’ এই করে, সে তাই হয়ে যায়।”

শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিগত বিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অনুভূতির সন্ধানী। একথা  তিনি স্পষ্ট করেও দিয়েছেন:

খ্রীষ্টান, ব্রহ্মজ্ঞানী, হিন্দু, মুসলমান — সকলেই বলে, আমার ধর্ম ঠিক, কিন্তু মা, কারুর ঘড়ি তো ঠিক চলছে না। তোমাকে ঠিক কে বুঝতে পারবে। তবে ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তোমার কৃপা হলে সব পথ দিয়ে তোমার কাছে পৌঁছানো যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণের এই আপন অনুভূতিকে পুস্তকে লিখিত অংশের উপর উচ্চস্থান দেওয়া কোন আব্রাহামীয় ধর্মের পক্ষে অসম্ভব এবং একমাত্র ভারতীয় ধর্মগুলিতেই সম্ভব।

 

স্বামী বিবেকানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণের সুযোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের অধিকাংশ বক্তৃতাই ছিল ইউরোপ ও আমেরিকায়। পাশ্চাত্য তখন ছিল দৃঢ়ভাবে খ্রীষ্টান এবং একমাত্র নিজের মতবাদের সত্যে বিশ্বাসী। তাই চিকাগো বক্তৃতা থেকে আরম্ভ করে সর্বত্র স্বামীজী তাঁদের পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি অবহিত ছিলেন আব্রাহামীয় মতবাদের সঙ্গে ভারতীয় ধর্মপরম্পরার পার্থক্য বিষয়ে। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে লণ্ডনের এক বক্তৃতায়   তিনি বলেন:

“ধর্ম যাহা কিছু বলে, সবই যুক্তির কষ্টিতে ফেলিয়া পরীক্ষা করা আবশ্যক। …বাস্তবিক ইহার কারণ গোড়াতেই গলদ আছে। যুক্তির মানদণ্ড ব্যতীত ধর্মবিষয়েও কোনরূপ বিচার বা সিদ্ধান্ত সম্ভব নহে। কোন ধর্ম হয়তো কিছু বীভৎস ব্যাপার করিতে আজ্ঞা দিল। উদাহরণস্বরূপ মুসলমান ধর্ম মুসলমানদের অনুমতি দেয় সমস্ত বিধর্মীদের হত্যা করতে। কোরআনে স্পষ্টই বলা আছে—মুসলমান না হতে চাইলে কাফিরদেরকে হত্যা কর। তাদের তরবারি দ্বারা নিধন কর।  যদি আমরা  কোন মুসলমানকে বলি যে তদ্রূপ কার্য অসমীচীন,  তাহাতে সেই মুসলমান স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করিবে—কি করিয়া তুমি জানিলে আদেশটি ভাল কি মন্দ? তোমার ভালমন্দের ধারণা তো তোমার শাস্ত্র হইতে! আমার শাস্ত্র বলিতেছে, ‘ইহা সৎকার্য।'”

স্বামীজী তাঁর শ্রোতাদের আব্রাহামীয় ধর্মের যুক্তিবিবর্জনের সমস্যার দিকে দৃষ্টি আরোপ করেছিলেন।  তাঁর কথায় ফুটে উঠেছে ইসলামধর্মের তীব্র অসহিষ্ণুতার সমস্যা। দেখা যাচ্ছে যে তিনি সর্বধর্মবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং ইসলামধর্মের মত তীব্র অসহিষ্ণুতা অন্য কোন ধর্মে খুঁজেও পান নি।

তবে পাঠককুল যদি বাংলা অনুবাদে এই কথাকটি খুঁজতে চান, তাঁদের হতাশ হতে হবে। কারণ, বিবেকানন্দকে সর্বধর্মবাদী করার প্রয়াসে উপরোক্ত কথাগুলিকে বাংলা অনুবাদে বাদ দেওয়া হয়েছে।

শুধু এই একবার নয়, স্বামীজী বার বার এই একই কথা <  >বলেছেন এবং বারবারই বাংলা অনুবাদে পরিকল্পিত ভাবে তা বাদ দেওয়া হয়েছে:

“The more selfish a man, the more immoral he is. And so also with the race. That race which is bound down to itself has been the most cruel and the most wicked in the whole world. There has not been a religion that has clung to this dualism more than that founded by the Prophet of Arabia, and there has not been a religion which has shed so much blood and been so cruel to other men. In the Koran there is the doctrine that a man who does not believe these teachings should be killed; it is a mercy to kill him! And the surest way to get to heaven, where there are beautiful houris and all sorts of sense-enjoyments, is by killing these unbelievers. Think of the bloodshed there has been in consequence of such beliefs!”

(আমার অনুবাদ)

মানুষ যত স্বার্থপর হয়, ততটাই সে নীতিহীন হয়। একই কথা খাটে জাতির ক্ষেত্রেও। যে জাতি কেবল নিজের কথা ভাবে, সেই জাতি সমস্ত জগতে সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুর ও দুষ্ট প্রকৃতির হয়। আরবের পয়গম্বরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে ধর্ম সেই ধর্মের মতন  আর কোন ধর্মই দ্বৈতবাদকে এত  গভীরভাবে জড়িয়ে ধরেনি এবং অন্য কোন ধর্মও নেই যার দ্বারা এত রক্তপাত এবং এত নিষ্ঠুরতার অনুষ্ঠান হয়েছে। কোরআনের নীতিই হল যে কোরআনে অবিশ্বাসীকে হত্যা করতে হবে। তাকে হত্যা করাটাই পুণ্য।  কাফিরদের হত্যা করলেই  নিশ্চিত হয় জান্নাত-গমন,  যেখানে আছে সুন্দরী হুরীরা (ষোড়শী রমণীরা) এবং ইন্দ্রিয়ভোগের অন্যান্য আয়োজন। ভাবুন তো এই ধর্মবিশ্বাসের জন্য পৃথিবীতে হয়েছে কি নিদারুণ রক্তপাত।

তাহলে কি স্বামীজীও ছিলেন সাম্প্রদায়িক? না একেবারেই নন। বরং এক মানবতাবাদী হিসাবে  (যাঁর মূল মন্ত্র ছিল “শিবজ্ঞানে জীব সেবা”) তিনি তুলে ধরেছেন সাম্প্রদায়িক ধর্মমতের সাথে মানবতার বিরোধকে। তাঁকে উদ্ধৃত করে বলি:

“Now, some Mohammedans are the crudest in this respect, and the most sectarian. Their watchword is: “There is one God, and Mohammed is His Prophet.” Everything beyond that not only is bad, but must be destroyed forthwith; at a moment’s notice, every man or woman who does not exactly believe in that must be killed; everything that does not belong to this worship must be immediately broken; every book that teaches any thing else must be burnt. From the Pacific to the Atlantic, for five hundred years blood ran all over the world. That is Mohammedanism! Nevertheless, among these Mohammedans, wherever there has a philosophic man, he was sure to protest against these cruelties. In that he showed the touch of the Divine and realised a fragment of the truth; he was not playing with his religion; for it was not his father’s religion he was talking, but spoke the truth direct like a man.”

সর্বধর্মবাদের Propagandaর স্বার্থে এই অনুচ্ছেদের বাংলা অনুবাদটি অঙ্গরহিত হওয়ায় একে অঙ্গযুক্ত করার জন্য আমি আমার সীমিত প্রয়াস করেছি:

এমন সময় ছিল, যখন মুসলমানগণ এই বিষয়ে সর্বপেক্ষা অপরিণত ও সম্প্রদায়িক-ভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁহাদের মূলমন্ত্রঃ আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, মহম্মদই একমাত্র রসুল। যাহা কিছু তাঁহাদের এই মূলমন্ত্রের অনুগামী নয়, তাহা কেবল হীনই নহে, বরং তাহাদের ধ্বংসসাধনই একান্ত কর্তব্য। যেসকল নরনারী এই ঠিক এই মূলমন্ত্রটিতে বিশ্বাসী নহেন, তাঁদের  মূহুর্তের মধ্যে  নিধন করা কর্তব্য। যাহা কিছু তাঁহাদের উপাসনা-পদ্ধতির বর্হিভূত, সে-সমস্তই ভগ্ন করিতে হইবে এবং যে-কোন গ্রন্থে অন্যরূপ মত প্রচারিত হইয়াছে, সেগুলি পুড়াইয়া ফেলিতে হইবে। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলাণ্টিক মহাসাগর পর্যন্ত সুবিস্তৃত ক্ষেত্রে  পাঁচশত বৎসর  ধরিয়া রক্তের ধারা প্রবাহিত হইয়াছে। ইহাই মুসলমানবাদ। তথাপি সেই যুগেও মুসলমানদের মধ্যেও যেখানেই কোন দার্শনিক মনোভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন, তিনি এইসমস্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। ইহার দ্বারা তিনি তাঁর মধ্যস্থ দৈব সত্ত্বার  প্রমাণ রাখিয়াছিলেন এবং আংশিকভাবে হইলেও অনুভব করিয়াছিলেন সত্য সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন। তাঁর এই প্রতিবাদের উৎস তাঁর জন্মসূত্রে লব্ধ ধর্মমত হইতে আসে নাই, বরং তাঁর অন্তর্নিহিত মানবসত্ত্বা হইতে উদ্গত হইয়াছিল।

আবার দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ধর্মমতের বিভিন্নতা ও সীমাবদ্ধতা বিষয়ে স্বামীজী ছিলেন সম্যক অবহিত। আমার তিনি কোন ব্যাক্তির সুকর্মের জন্য তাঁর জন্মের ধর্মমতকে স্বতঃই কৃতিত্ব প্রদান করেন নি বরং সেই ব্যাক্তির অন্তর্নিহিত মানবতাকে সম্মান করেছেন।

যদি সর্বধর্মবাদ হয় সত্য তাহলে ধর্মান্তরকরণ এক নগণ্য বিষয় কারণ তা এক মানুষের পোশাক বদলানোর মতই তুচ্ছ। কিন্তু ভারতে স্বামীজী দৃঢ়স্বরে জানান, হিন্দুধর্ম থেকে একটি মানুষ অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার অর্থ হিন্দুধর্মাবলম্বীর সংখ্যার হ্রাসমাত্র নয়, বরং হিন্দুধর্মের শত্রুসংখ্যার এক বৃদ্ধি। স্বামীজীর এই কথা প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন সর্বধর্মবাদের বিরোধী। পূর্বের মতই স্বামীজীর এই কথার প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি  সার্থক নয়।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিদগ্ধ চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথ  ছিলেন সাধারণভাবে একদেশদর্শিতার বিরোধী। এই মৃদুভাষী দার্শনিক তাঁর অনুজপ্রতিম ঐতিহাসিক কালিদাস নাগকে লেখা এক চিঠিতে ১৯২২ সালে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার বিষয়ে আপন অভিমত ব্যক্ত করেছেন । তাঁর কথায় ফুটে উঠেছে আব্রাহামীয় অসহিষ্ণুতার সমস্যার কথা।

পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমানধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই। খৃস্টানধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটি সুবিধার কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন; তাদের মন মধ্যযুগের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবনকে পরিবেষ্টিত করে নেই। এইজন্যে অপরধর্মাবলম্বীদেরকে তারা ধর্মের বেড়ার দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা দেয় না। য়ুরোপীয় আর খৃস্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। ‘য়ুরোপীয় বৌদ্ধ’ বা ‘য়ুরোপীয় মুসলমান শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে-জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। ‘মুসলমান বৌদ্ধ বা ‘মুসলমান খৃস্টান’শব্দ স্বতই অসম্ভব।

স্পষ্টতঃই রবি ঠাকুর কোন কাল্পনিক সর্বধর্মবাদের রাজত্বে বিচরণ করতেন না। বরং তিনি আব্রাহামীয় বিশ্বাসবাদের সাথে ভারতীয় ধর্মগুলির পার্থক্য নিয়ে ছিলেন সম্যক ওয়াকিবহাল।

Times of Indiaতে ১৮ এপ্রিল ১৯২৪এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে কবিগুরু বলেছিলেন,

“A very important factor which is making it almost impossible for Hindu-Muslim unity to become an accomplished fact is that the Muslim can not confine their patriotism to any one country. I had frankly asked the Muslims whether in the event of any Mohammedan power invading India, would they [Muslims] stand side by side with their Hindu neighbors to defend their common land or join the invaders. I was not satisfied with the reply I have obtained from them… Even such a man as Mr. Mohammed Ali has declared that under no circumstances is it permissible for any Mohammedan, whatever be his country, to stand against any Mohammedan.”

কবিগুরুর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে মুসলমানদের মধ্যে দেশবাসী অপেক্ষা আপন মতাবলম্বী বিদেশীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এই আবেগের ফলশ্রুতিতে শেষাবধি হয় ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম। তাই ভারতীয় সংবিধান প্রণেতা ভীমরাও রামজী আম্বেদকর তাঁর Pakistan or The Partition of India পুস্তকে  কবির এই বাণীকে উদ্ধৃত   করেছেন  ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও ইসলামবাদের অসামঞ্জস্যের নিদর্শন হিসাবে।

 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শরৎবাবুর ছিলেন উদারচিত্ত এবং মানবতাবাদী। তাঁর একটি গল্প মহেশে তিনি তুলে ধরেছেন এক দরিদ্র মুসলমান কৃষকের আপন গরুর প্রতি সন্তানসম মমত্ব এবং এর বিপরীতে সেই গ্রামের হিন্দু জমিদারের অত্যাচার। এমন বাঙালী  বিরল যাঁদের ছোটবেলায় এই গল্পটি পড়ে চোখ আর্দ্র হয় নি।

শরৎবাবু ছিলেন সমাজ-সচেতন। তিনি ছিলেন দীর্ঘদিন  স্বাধীনতাপূর্ব কালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য। ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শিরোনামের এই ভাষণটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ সালে বাংলা প্রাদেশিক সম্মেলনে দেন।  পরে হিন্দু সংঘ পত্রিকায় ১৯৩৩ সালে ছাপা হয়। এই প্রবন্ধে  সন্নিবেশ ঘটেছে কথাসাহিত্যিকের হৃদয়বত্তার সাথে তীক্ষ্ণ যুক্তিবোধের।

তিনি তুলে ধরেন দেশব্যাপী মুসলমান সমাজের জাতীয়তবাদের অভাব এবং তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের প্রতি অসহিষ্ণুতার সর্বব্যাপী পদচিহ্নকে। তিনি লিখেছেন,

“পাবনার বীভৎস ব্যাপারে অনেককেই বলিতে শুনি, পশ্চিম হইতে মুসলমান মোল্লারা আসিয়া নিরীহ ও অশিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের উত্তেজিত করিয়া এই দুষ্কার্য করিয়াছে। কিন্তু এমনিই যদি পশ্চিম হইতে হিন্দু পুরোহিতের দল আসিয়া, কোন হিন্দুপ্রধান স্থানে এমনি নিরীহ ও নিরক্ষর চাষাভূষাদের এই বলিয়া উত্তেজিত করিবার চেষ্টা করেন যে নিরপরাধ মুসলমান প্রতিবেশীদের ঘরদোরে আগুন ধরাইয়া সম্পত্তি লুঠ করিয়া মেয়েদের অপমান অমর্যাদা করিতে হইবে, তাহা হইলে সেই-সব নিরক্ষর হিন্দু কৃষকের দল উহাদের পাগল বলিয়া গ্রাম হইতে দূর করিয়া দিতে একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করিবে না।”

ইসলাম মতবাদের ধর্মনেতারা যেভাবে ধর্মের নামে বর্বরতার ইন্ধন দিয়েছেন, তা হিন্দুদের ক্ষেত্রে অসম্ভব, শরৎচন্দ্রের এটাই অনুভব। স্পষ্টতঃই তিনি সর্বধর্মবাদের ধারণাকে অলীক মনে করতেন। তিনি সর্বধর্মের সমানতাকে সরাসরি খারিজ করে বলেছেন যে এই সমানতা চিরদিনই অসম্ভব।

“মিলন হয় সমানে সমানে। শিক্ষা সমান করিয়া লইবার আশা আর যেই করুক আমি ত করি না। হাজার বৎসরে কুলায় নাই, আরও হাজার বৎসরে কুলাইবে না।”

না নীচের কথাগুলি নয় কোন হিন্দুত্ববাদী নেতার উক্তি, বরং কংগ্রেসকর্মী এই সাহিত্যিকের উক্তি যাঁর লেখার কেবল  বাঙালী নয়, সারা ভারত গুণমুগ্ধ। তিনি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের অভাবকে সোজা ভাষায় ব্যক্ত করেছেন:

“হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে,—এ দেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কি, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে! আজ এই কথাটাই একান্ত করিয়া বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে, এ কাজ শুধু হিন্দুর,—আর কাহারও নয়।”

সর্বধর্মবাদের প্রচেষ্টার অসার্থকতার বিষয়ে আমি শরৎবাবুকে উদ্ধৃত  ক’রে সমাপ্ত করছি এই পরিচ্ছেদ—

“হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে এতক্ষণ যাহা বলিয়াছি তাহা অনেকের কানেই হয়ত তিক্ত ঠেকিবে, কিন্তু সেজন্য চমকাইবারও প্রয়োজন নাই, আমাকে দেশদ্রোহী ভাবিবারও হেতু নাই। আমার বক্তব্য এ নয় যে, এই দুই প্রতিবেশী জাতির মধ্যে একটা সদ্ভাব ও প্রীতির বন্ধন ঘটিলে সে বস্তু আমার মনঃপূত হইবে না। আমার বক্তব্য এই যে, এ জিনিস যদি নাই-ই হয় এবং হওয়ারও যদি কোন কিনারা আপাততঃ চোখে না পড়ে ত এ লইয়া অহরহ আর্তনাদ করিয়া কোন সুবিধা হইবে না। আর না হইলেই যে সর্বনাশ হইয়া গেল এ মনোভাবেরও কোনও সার্থকতা নাই।…ভারতের মুক্তিতে ভারতীয় মুসলমানেরও মুক্তি মিলিতে পারে, এ সত্য তাহারা কোনদিনই অকপটে বিশ্বাস করিতে পারিবে না। পারিবে শুধু তখন যখন ধর্মের প্রতি মোহ তাহাদের কমিবে, যখন বুঝিবে যে-কোন ধর্মই হউক তাহার গোঁড়ামি লইয়া গর্ব করার মত এমন লজ্জাকর ব্যাপার, এতবড় বর্বরতা মানুষের আর দ্বিতীয় নাই। কিন্তু সে বুঝার এখনও অনেক বিলম্ব। এবং জগৎসুদ্ধ লোক মিলিয়া মুসলমানের শিক্ষার ব্যবস্থা না করিলে ইহাদের কোনদিন চোখ খুলিবে কিনা সন্দেহ।”

 

লোকসমাজ

বাঙালী জাতির সংস্কৃতি এবং বাঙালী সত্ত্বা উপরোক্ত মনীষীদের ব্যতিরেকে অভাবনীয়। নিশ্চিতভাবে বাঙালী  জাতির ঐতিহ্যে সর্বধর্মবাদ নেই। তবু তর্কের খাতিরে উত্থাপন করি অন্য এক মত।

উপরের সবকিছুই কি কেবল কিছু বাঙালী ভদ্রলোকের অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথা? বৃহত্তর লোকসমাজে কি আদতে দেখা যেত সহিষ্ণুতা? মার্ক্সবাদীরা এরকম সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে চান কারণ তাঁরা বলেন বিত্তই নির্ধারণ করে মানুষের সংস্কৃতি। অতএব দরিদ্র হিন্দু এবং দরিদ্র মুসলমান একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তাঁদের আচরণে ফুটে উঠবে সর্বধর্মবাদ।

এই মার্ক্সীয় ধারণাকে সমূলে নস্যাৎ করেছেন শরৎ বাবু। তিনি বলেছেন ,

“শিক্ষা মানে যদি লেখাপড়া জানা হয়, তাহা হইলে চাষী-মজুরের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানে বেশি তারতম্য নাই। কিন্তু শিক্ষার তাৎপর্য যদি অন্তরের প্রসার ও হৃদয়ের কাল্‌চার হয়, তাহা হইলে বলিতেই হইবে উভয় সম্প্রদায়ের তুলনাই হয় না।”

আসা যাক বিংশ শতকের প্রথমার্ধে এলোকেশীর সঙ্গে প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়ের এক কথোপকথনে। এলোকেশী ছিলেন নমঃশূদ্র জাতির (বর্তমান পরিভাষায় Scheduled caste)  এক প্রতিভাবান মহিলা যিনি তন্ত্রধর্মের অনুশীলন করতেন। তন্ত্রধর্ম বাংলার নিজস্ব ধর্মমত এবং সমাজের অন্ত্যজ মানুষের মধ্যে এই ধর্ম উচ্চবর্গ অপেক্ষা অধিকতর জনপ্রিয়।  প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর “তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ” গ্রন্থে  (বিশ্ববাণী প্রকাশনী; ১৯৮৩; পৃষ্ঠা ৪০০—৪০৩) এই কথোপকথন সুবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এই কথোপকথনটি দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয়।  বিষয়ানুগত হওয়ার তাড়ণায় আমি কেবল প্রাসঙ্গিক অংশগুলি উদ্ধৃত করছি।

এলোকেশী প্রমোককুমারবাবুকে বলেছিলেন:

“আমাদের গ্রামে মুসলমানেরা হিন্দুর ঘরের মেয়েদের জোর করেই ধরে নিয়ে যেভাবে অত্যাচার করে তা আপনাদের কলকাতার বাবুভায়াদের জানা নেই।…ঘর জ্বালানো, ধন-লুণ্ঠন, হিন্দুনারী ধর্ষণ ত ওদের ধর্মের নাম ক’রে একথা ত জানেন।…”

প্রমোদকুমারবাবুর একসময় বলেন যে

“…কিন্তু এটাও তো ঠিক, দেশের সমস্ত মুসলমানই তো এর জন্য দায়ী নয়? এ কাজ করে একদল লোক—তারা নিম্নস্তরের।”

পরবর্তী অংশ আমি হুবহু গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত  করছি। নিম্নের উদ্ধৃত অংশের উত্তমপুরুষ, বলা বাহুল্য, প্রমোদকুমারবাবু।

“আবার রুষ্ট হইয়া এলোকেশী বলিলেন, ওসব পুরনো ছেঁদো কথা রেখে দিন, শুনলে আমার গা জ্বলে যায়; —ওদের সমাজের সমর্থন নেই, প্রশ্রয় নেই তো এ-কাজ চলছে কেমন করে, বন্ধ হয়েছে কী এতদিনে? ও সমাজের মোল্লারা কি দস্তুরমত শিক্ষা দেয়না ওদের—যে রকমেই হোক হিন্দুদের সর্বনাশ করতে পারলেই ওদের ধর্মে খুব উঁচু স্থান, স্বর্গে যাবে ওরা? যেমন হিন্দু গোঁড়া-ব্রাহ্মণ সমাজের জাতিগত পবিত্রতার দম্ভ, তাদের সমাজের সমর্থন না থাকলে কি একজন স্ত্রী ত্যাগ করে? মুসলমান ধরেচে ছুঁয়েছে তাতেই তার জাত গেছে চলে? আপনাদের মূঢ় ব্রাহ্মণসমাজ কি শেখায়নি, কোন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলমানে ধরলেই তার জাত যায়, আর সে হিন্দুসমাজে থাকতে পারবে না, এ সমাজ এতই পবিত্র?

“আমি বলিলাম,—ওদের সমাজের মধ্যে হিন্দুদের উপর শ্রদ্ধা, প্রীতি রাখে, কখনই বিরোধ করেনা এমন দৃষ্টান্তও তো দেখা যায়—আমি তাইত বলতে  চাইছিলাম।

“এলোকেশী একটু ব্যঙ্গ ভাবেই আমার সুর অনুকরণ করিয়া বলিলেন, —হিন্দুদের মধ্যেও তো সাম্যবাদী আধুনিক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মুসলমানদের উপর তিলমাত্র ঘৃণার ভাব পোষণ করেনা কিন্তু তাতে ক’রে হিন্দুর ঘরের মেয়ে ধরারও কোন ব্যতিক্রম হয়নি এতাবৎ কাল। আর ধর্ষিতা মেয়েরাও তাদের স্বামীঘরে অথবা সমাজে স্থানও পায়নি তো।”

পাঠকের কাছে পরিষ্কার যে এলোকেশী হিন্দুধর্ম এবং মুসলমানধর্ম  এই দুই ধর্মকে (বা দুই সমাজকে) ভিন্ন ভিন্ন কারণে নিন্দা করেছেন। কিন্তু একবারও এই দুই সমাজের বা দুই ধর্মের মধ্যে কোন সমভাব দেখতে পাননি। তিনি মুসলমান সমাজ ও ধর্মনেতাদের মধ্যে তীব্র পরধর্ম-অসহিষ্ণুতা খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর অভিমত এই যে ঐ সমাজ হিন্দুনারীধর্ষণে নিম্নস্তরের মানুষকে উৎসাহদানই করে।  অপরপক্ষে হিন্দু সমাজ নিজ সমাজের নারীদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল নয়। পরিশেষে তিনি মার্ক্সবাদী ভদ্রলোক বাঙালীদেরকে অভিমতকে  হাস্যাস্পদ জ্ঞান করেছেন।

 

শেষ কথা

শুরুতেই শরৎবাবুকে উদ্ধৃত করেছি। তিনি সেখানে লিখেছেন যে  propagandaর বিরুদ্ধে  ব্যাক্তিবিশেষের প্রতিবাদের ফল সেই  ব্যাক্তির সীমাহীন লাঞ্ছনা ও নির্যাতন।  কিন্তু সত্যকে ভুলে propaganda কে মেনে নেওয়ার অর্থও সমাজের সীমাহীন লাঞ্ছনা ও নির্যাতন।  ব্যাক্তি ও সমষ্টির এই দ্বন্দ্বে আমাদের একটা দিক বেছে নিতেই হবে। নান্যপন্থা বিদ্যতে।