অভীক মুখোপাধ্যায়
(ত্রয়োচত্বারিংশত্তম পর্বের পর)
পর্ব – ৪৪
‘পরমাণু বোমা হল কাগুজে বাঘ। আমাদের দেশ বিশাল। যদি কেউ আমাদের দেশে প্রমাণু বোমা ফেলেও যায়, তাহলে খুব বেশি হলে দশ লাখ লোক মরবে, তারপরেও আমাদের দেশের কোটি – কোটি মানুষ যুদ্ধ করার জন্যে বেঁচে থাকবে।’
- মাও ৎসে তুং।
ওপরের উক্তির লক্ষ্য ছিলেন পণ্ডিত নেহরুজি। এটা ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসের কথা।
আমেরিকা আর সোভিয়েত একে অপরকে চমকেছে, ধমকেছে, কিন্তু সেভাবে সামনাসামনি লড়েনি। কেনেডি অবশ্য প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন, আসল বিপদের নাম চিন।
কারণ?
চিন আমেরিকাকে মাত দিয়েছিল। প্রথমে কোরিয়া যুদ্ধে, পরের বারে ভিয়েতনামে। কালের প্রকোপে সোভিয়েত ভেঙে গেছে, কিন্তু চিন রয়ে গেছে স্বমহিমা নিয়ে। এখন সে আরও শক্তিশালী। সম্ভবত বিশ্বের তিনটি সর্বোচ্চ শক্তিধর দেশের মধ্যে চিনের গণনা করা হয়। চিন এখন অস্ত্রের দিক থেকেও শক্তিশালী, অর্থের দিক থেকেও তা-ই। অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশের মতো, বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির শাখাগুলির মতো চিন কিন্তু সোভিয়েতের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকেনি, সঠিক সময়ে পৃথক ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সোভিয়েত বিশ্ববাসীকে লেনিনবাদ, স্টালিনবাদ দিয়েছে, চিন দিয়েছে মাওবাদ। লেনিন কিংবা স্টালিনের মতবাদে তবুও রাজনীতি, কূটনীতির অবকাশ আছে, মাওবাদে তা নেই। মারাত্মক অ্যাগ্রেসিভ একটা পলিসি। মেরে দাও, উড়িয়ে দাও গোছের নীতি।
ভারত – চিন যুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার দেলভি চিনের হাতে যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন। তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন চিন কীভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিল। তিনি লিখছেন, ‘এটা অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি যে, আমরা চিনকে উত্তেজিত করায় চিন আমাদের আক্রমণ করেছিল। ওদের প্রস্তুতি একেবারে সাজানোগোছানো ছিল, দীর্ঘ সময় ধরে ওরা নিজেদের প্রস্তুত করে তুলেছিল। প্রত্যেকটা চৌকি আর রাস্তাঘাট একেবারে পাকা, এসব করতে অন্তত তিনবছর সময় লাগার কথা।’
এবার একটা প্রশ্ন জাগে। ভারতকে আক্রমণ করার জন্যে চিন এত দীর্ঘ প্রস্তুতি কেন নিয়েছিল? এদিকটা নিয়ে কথা শোনাই যায় না। শোনা যাওয়ার অবকাশই বা কই? ইতিহাসে ১৯৬২ সালের চিন যুদ্ধ নিয়ে পরিষ্কার দুটো ন্যারেটিভ চলে। একপক্ষ পণ্ডিত নেহরুকে ছোট, হেয় প্রতিপন্ন করতে উদগ্রীব, আর অন্য পক্ষ নেহরুজিকে বড় করে তুলতে ব্যাকুল। চিন কিংবা আমেরিকার দিকে থেকে দেখার ইচ্ছে মনে হয় কারো হয় না। অবশ্য চিনকে নিয়ে বলে লাভ নেই, সেদেশে ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি করতে গেলে ভ্যানিশ হয়ে যেতে হবে — পি সি সরকার জুনিয়রের ম্যাজিক, গিলি গিলি গে!
চাউ এন লাই বললেন, ‘নেহরু নিজেকে ইংরেজদের উত্তরাধিকারী মনে করেন, এবং চিন্তাভাবনাও ওদেরই (ব্রিটিশদের) মতো। আর তাই তিনি তিব্বতীয়দের ওসকান। এটা ভারতীয় মানসিকতা নয়, ব্রিটিশদের শেখানো বিচ্ছিন্নতাবাদ।’
কিন্তু চাউ এন লাই কি সত্যি বলছেন? তাঁকে কাউন্টার করার মতো কিছুই কি নেই?
আছে তো। দলাই লামার বক্তব্য রয়েছে। দেখি, তিনি কী বলেছেন?
দলাই লামা লিখছেন, ‘নেহরু তো আমাকে তিব্বতে ফেরত পাঠাতে চাইছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল চিন আমাদের (তিব্বতীয়দের) কদর করতে জানে। ১৯৫৯ সালে যখন আমি পালিয়ে এলাম, তখনও নেহরু বলেই চলেছিলেন যে তিব্বতে চিনেরই অধিকার আছে।’
অর্থাৎ, প্রতি – বক্তব্য ছিল বা আছে। কিন্তু মুশকিল হল চাউ এন লাই আর দলাই লামা একে অন্যকে এসব বলেননি। যদি এঁরা মুখোমুখি বসে নিজেদের মধ্যে একটা সমাধান করে নিতেন কতই না ভালো হতো। ভালোর দিন আর আজকাল নেই, তাই সেই পথে কেউ পা – বাড়ালেন না। সবাই ভালো কাজ করতে বসলে আর যুদ্ধ কী করে হবে?
১৯৬২ সালে সোভিয়েত পণ্ডিত নেহরুকে জানাল যে তারা ১২ খানা মিগ – ২১ ফাইটার জেট বিক্রি করতে চায়। খবরটা কেনেডি যেই না পেলেন, তিনি অমনি ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টারকে ফোনে ধরলেন — আপনি একটু দাম কমসম করে বন্দোবস্ত করে দিন, সোভিয়েত যেন কোনওভাবেই এই ডিলটা না পায়।
বাস্তবে অবশ্য একটু আলাদারকমের ডিল হল। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত একেবারে বিনামূল্যে ভারতকে প্লেনগুলো উপহার দেবে বলল। একটা সন্ধিও হল। সোভিয়েত ভারতের সৈন্যশক্তি বাড়ানোর জন্যে সম্ভাব্য সাহায্য করবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। কেবল এটুকুই নয়, আরও একটা কাজ করল সোভিয়েত। ওই বছরেই ইউনাইটেড নেশনস – এ কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে আবার সমর্থন জানিয়ে ভেটো করল তারা। তবে এগুলোর কোনটাই কিন্তু চিনের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি করার জন্যে করা হয়নি। এগুল সব পাকিস্তানকে ভয় দেখানোর জন্যে করা হচ্ছিল। কারণ তদ্দিনে পাকিস্তান আমেরিকার সাহায্য নিয়ে বিশাল সেনাবাহিনী, আধুনিক ফাইটার জেট, প্যাটন ট্যাঙ্ক এসব জোগাড় করে ফেলেছিল।
১৯৬২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর। ভারতীয় সেনাদল থাং – লা পাস দখল করার জন্যে এগোলো। ইতিহাসে এটাই অপারেশন লেগহর্ন। থাং –লা পাস ভারত – চিন সীমান্তে একটি বিবাদিত এলাকা। চিন এই জায়গাটাকে নিজের বলেই মনে করে। অপারেশন লেগহর্নের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার দেলভি। অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে লিখলেও বলতে হয় সেদিন দেলভি সাহেবদের অবস্থা ছিল ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার গোছের। শীতের সঙ্গে যুঝবার মতো দরকারি পোশাকটুকুও ছিল না। উত্তর পূর্বের সীমান্তের কমান্ড ছিল নেহরুজির এক আত্মীয় ব্রজমোহন কৌলের হাতে। বি এম কৌলকে ‘বিজ্জি’ কৌল বলতেন নেহরুজি। দেলভি নিজের বইতে চিনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের জনেয় এই বিজ্জি কৌলকেই অনেকাংশে দায়ী করেছেন। বিজ্জি কৌল নাকি পদোন্নতির ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রমের বদলে ঊর্দ্ধতনকে তৈলাক্তকরণ করাটাই বেশি পছন্দ করতেন।
৬ই অক্টোবর, ১৯৬২ মাও বললেন, ‘নেহরু পুরোনো বন্ধু। যদি সে আমাদের এলাকায় নিজের বাহিনী পাঠায়, তাহলে সেই বাহিনীর সঙ্গে লোড়ে এবং তাকে হারিয়েই আমিও বন্ধুত্বের প্রতিদান দেব।’
৮ই অক্টোবর, ১৯৬২। মাও ক্রুশ্চেভকে ফোন করলেন। বললেন, ‘আমরা ভারতকে আক্রমণ করতে চলেছি।’
ক্রুশ্চেভ তখন কিউবা নিয়ে পাগলা হয়ে আছেন। কিছুদিন আগেই ভারতের সঙ্গে সন্ধি করেছেন। কিন্তু চিনকে কিছুই বলতে পারলেন না। ওদিকে মাও তখন ভারতকে টার্গেট করলেও আমেরিকা এবং সোভিয়েতকে দেখিয়ে দিতে চাইছিলেন যে এশিয়ার দাদার নাম মাও ৎসে তুং, ক্রুশ্চেভ বা কেনেডি নয়।
১১ই অক্টোবর, ১৯৬২। জেনারেল কৌল নেহরুজির সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘এখুনি কেনেডিকে ফোন করুন। বাঁচালে ও –ই বাঁচাতে পারবে।’ ১২ তারিখে নেহরুজির কলম্বো যাওয়ার কথা ছিল। তাড়াহুড়োর মধ্যে প্রেসকে কেবল এটুকুই বলে গেলেন যে, সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার তা আমাদের সেনাই নেবে, এবং যা সিদ্ধান্ত তারা নেবে আমি তা মেনে নেব। আমরা শুধু আমাদের এলাকা ফেরত পেতে চাই।
আমেরিকান মিডিয়া এখান থেকে একটা অ্যাঙ্গেল তুলে নিল। ছেপে দিল তারা — Nehru Declares War On China. এই হেডলাইন বেজিং –এর হাতে একটা শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দিল। বিশ্ববাসীকে চিন বলল, ভারত আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
২০শ অক্টোবর, ১৯৬২। চিন একইসঙ্গে পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্তে বোমা বর্ষণ শুরু করে দিল। ব্রিগেডিয়ার দেলভির ফৌজ মাত্র দুদিন টিকেছিল। তারপর হার মানতে বাধ্য হল। দেলভিকে বন্দি করা হয়। আটদিনে ভারত যতটা এগিয়েছিল, ঠিক ততটাই পিছোতে বাধ্য হল।
২৮শে অক্টোবর নেহরুজি কেনেডির চিঠি পেলেন, ‘কিউবা সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন চিনের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াইতে তোমরা আমেরিকাকে সঙ্গী পাবে।’
নেহরুজি আমেরিকান রাজদূত গালব্রেথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘সোভিয়েত ধোঁকা দিয়েছে। চিনের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে ওরা। মিগ বিমান পাঠানোর কথা, পাঠাল না। এখন আপনি আমাদের সাহায্য করুন।’
আমেরিকার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা ভারতের, সময়ে – অসময়ে আমেরিকা বিরোধ করতে থাকা নেহরুজির কাছে এ এক অত্যন্ত লজ্জাজনক অবস্থা উপনীত হয়েছিল। সোভিয়েত তথা চিনের তরফ থেকে এই বিশ্বাসঘাতকতা দেখে এবং নীতিগত বিরোধের জায়গা থেকে সরে এসে আমেরিকার কাছে এই আত্মসমর্পণ নেহরুজিকে আঘাত দিয়েছিল। অন্তর থেকে ভেঙে দিয়েছিল পণ্ডিতজিকে। এই ঘটনার সাত মাস পরে কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরজি একটি অনুষ্ঠানে গাইলেন, ‘অ্যায় মেরে ওয়াতনকে লোগোঁ, জরা আঁখ মে ভর লো পানি…’, সেদিন পণ্ডিত নেহরু কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে হার্ট অ্যাটাক হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
কেনেডি চিঠি দিয়েছিলেন একথা সত্য, কিন্তু সেই চিঠির পরে কি সত্যিই সাহায্য এসেছিল? আমরা কি চিনের বিরুদ্ধে লড়তে পেরেছিলাম? প্রাথমিক ভাবে বোমা বর্ষণ করলেও চিন কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে একটা গুলিও চালায়নি। ঝড় থেমে গিয়েছিল। না, ঝড় বললে ভুল হবে। হাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কালবৈশাখীর আগে ঠিক যেমন চারদিক একেবারে নিথর হয়ে যায়। পাতাটিও নড়ে না।
তারপর ১৪ই নভেম্বর মাও ৎসে তুং পণ্ডিত নেহরুকে জন্মদিনের উপহার দিলেন। চিন ভারতকে আক্রমণ করল। দ্বিতীয় বার যুদ্ধ শুরু হল।
(ক্রমশ)