বিধাতার হাতে লেখা গান – ৫৪

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ত্রয়োপঞ্চশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৫৪

সন্দেহভাজন ৪ :মাফিয়া

কেনেডি নিহত হয়েছেন শুনে জিমি হোফফা বলেছিল, ‘ভালো হয়েছে মরেছে। চোখগুলো এবার পোকায় খাক!’

মাফিয়ার কাজই হল খুন করা। মাফিয়ার সমস্ত কর্মকাণ্ড হত্যাকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। খুনের পরিকল্পনা করাই মাফিয়ার মস্তিষ্কের কর্ষণ। মাফিয়ার দলে যেমন পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করার লোক থাকে, তেমনি থাকে দক্ষ শার্প শুটার। ধরার পড়ার ভয় নেই। ধরা পড়লেও জেলে যেতে ভয় পায় না। জেলে গেলে সমস্ত টর্চার সহ্য করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে বলে ভেতরকার খবর বাইরে আসার চিন্তা নেই। এই লেখার গোড়ার দিকে বলেছি, আমেরিকার মাটিতে ইতালিয়ান মাফিয়া একটা সাংঘাতিক সিস্টেম ডেভেলপ করে ফেলেছিল। যদি মাফিয়া চাইত, তাহলে কেনেডিকে হত্যা করা কিন্তু সত্যিই তাদের কাছে বাঁ হাতের খেলা ছিল। কিন্তু প্রত্যেক খুনের ঘটনায় যে প্রশ্নটা প্রথমেই ওঠে তা এখানেও তোলা হোক, মোটিভ কী ছিল, কেন মারবে কেনেডিকে?   

একটা বড় কারণ খাড়া করা যেতে পারে। মাফিয়ারাই কেনেডিকে মসনদে বসিয়েছিল। ভোটে জেতানোর জন্যে ছল – বল – কৌশল প্রয়োগ করেছিল। টাকা ঢেলেছিল। তারা চেয়েছিল, কেনেডি কাস্ত্রোকে খতম করে দিলেই কিউবায় নিজেদের আধিপত্য আবার তারা ফিরে পাবে। কিন্তু কেনেডি তা করতে পারেননি। আর তাই মাফিয়ারা বিধাতা হয়ে কেনেডির কপালে ‘মৃত্যু’ লিখে দিয়েছিল। সোজা হিসেব। 

কেনেডিকে মাফিয়াদের মারার আরও কারণ থাকতে পারে। ববি কেনেডি মার্কিন মাফিয়া এবং তাদের সহযোগী ইউনিয়ন লিদার জিমি হোফফার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। এফ বি আই নিজের একটি সম্পূর্ণ ইউনিট এই কাজে লাগিয়েছিল ববির নির্দেশক্রমে। ববি কেনেডি জিমিকে সেনেটে ডেকে সাংবাদিকদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে মাফিয়াদের সম্পর্কের প্রত্যেকটা সুতো সামনে এনেছিলেন। জিমির কাছে তাই এক নাম্বার দুশমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেনেডি ভ্রাতৃদ্বয়। কেনেডিকে হত্যা করার জন্যে যে লোকলশকর কিংবা অর্থ দরকার ছিল তার কোনটাই কিন্তু মাফিয়াদের কাছে কম ছিল না। 

জিমির উকিল রোগানো নিজের বইতে লিখেছেন, ‘জিমি হোফফা সান্তোস আর কার্লোস মারচেলো নামক মাফিয়া ডনদের সঙ্গে ষড় করে কেনেডিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। … ’৮৭ সালে মরার সময়ে সান্তোস নিজের অন্তিম বাক্যে বলেছিল, আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে নয়, ওঁর ভাই ববিকে মারার কথা ছিল।’

কার্লোসকে একবার গুয়াটেমালা থেকে ধরে আমেরিকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেনেট কমিটির সামনে জন আর ববি দুজনে মিলে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। 

’৬২ সালে মারচেলোকে যখন ববিকে হত্যার কথা বলা হয়েছিল, তখন সে বলে, ‘ববিকে মারলে কি ওঁর ভাই আমাদের ছেড়ে দেবে? কুকুরকে মারতে হলে তার ল্যাজ না – কেটে মাথা কাটতে হয়।’ 

ববি কেনেডি নিজের দাদার হত্যার পরে একবার বলেছিলেন, ‘আমি মাফিয়াদের পেছনে লাগার ফলেই দাদার মৃত্যু ঘটল। ওরা আমায় মারলে বরং ভালো করত।’ তবে আফসোস বৃথা যায়নি, পরে এই কার্লোসের লোকেদের হাতেই ববি নিহত হন। 

জিমি হোফফার সহযোগী ফ্র্যাঙ্ক শিরন বলেছিল, ‘কেনেডি নিহত হওয়ার আগে তিনটে রাইফেল আমি ডাল্লাসে পৌঁছে দিয়েছিলাম। জানি না ওই রাইফেলগুলোর একটাকে দিয়েই কেনেডিকে মারা হয়েছিল কিনা, তবে হুবহু একই দেখতে ছিল।’

অসওয়াল্ডের এক আত্মীয়ের সঙ্গে মাফিয়াদের সম্পর্ক ছিল। এবং অসওয়াল্ড নিজেও মাফিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত। তবে মাত্র বছর চব্বিশের এই ছেলেটি কিন্তু কোনও ডন – টন ছিল না। কোনও গ্যাং-এর সদস্য ছিল বলেও প্রমাণ মেলেনি। সোভিয়েত থেকে ফিরে ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাত। কেনেডি নিহত হওয়ার সময় সে বইয়ের গুদামে কাজ করছিল। 

অসওয়াল্ডকে যে খুন করেছিল, দিনেরবেলায় সবার চোখের সামনে মেরেছিল, সে কিন্তু গ্যাংস্টার ছিল। জ্যাক রুবি। তিনের দশকে সে ছিল আল কাপোনের গ্যাং –এর সক্রিয় সদস্য। পরে শিকাগোর মাফিয়া গতিবিধিতে তার উপস্থিতি প্রামাণ্য ছিল। ডাল্লাসে জুয়োখেলার নেটওয়ার্ক তৈরি করার দায়িত্ব তার কাঁধেই দেওয়া হয়েছিল তার গ্যাং –এর পক্ষ থেকে। এই জ্যাক রুবিই দায়িত্ব নিয়ে নিকেশ করে দিয়েছিল অসওয়াল্ডকে। মুখ খোলার আগেই দিনেদুপুরে তিভি ক্যামেরার সামনে গুলি করে মেরেছিল তাকে। মাফিয়ারা এভাবেই মারে। নির্ভয়ে।

যখন কেনেডি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তার ঠিক পনেরো মিনিট পরে জ্যাক রুবি মাত্র পাঁচশো মিটার একটি খবরের কাগজের অফিসে বসে ছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি অনুসারে হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগে একটা পিক – আপ ভ্যানে করে বেশ কিছু জিনিসপত্র জ্যাক রুবি (ভাবী) অকুস্থলে নামিয়ে রেখে যায়। এরই পাশ দিয়ে কেনেডির শোভাযাত্রা যাওয়ার কথা ছিল। ওয়ারেন কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে কেনেডি -হত্যার ঠিক আগে জ্যাক রুবি একজনকে বলেছিল, ‘দেখবে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজী ফাটবে।’

অসওয়াল্ড গ্রেফতার হতেই পুলিশ হেড কোয়ার্টারে এই জ্যাক রুবিকে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে দেখা গিয়েছিল। সম্ভবত সেদিনেই সে অসওয়াল্ডকে খতম করতে চেয়েছিল। কিন্তু মজার কথা হল ওয়ারেন কমিশন জ্যাক রুবিকে তলবই করছিল না। শেষে যখন জ্যাক রুবির বোন আর্জি জানায়, তখন তাকে ডাকা হয়। 

জ্যাক কমিশনের সামনে কী বলেছিল? কিংবা আদৌ কিছু বলেছিল কি?

আজ্ঞে, বলেছিল। তার বক্তব্য ছিল, ‘আমি অনেক কিছুই জানি, কিন্তু ডাল্লাসে আমার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। আমাকে ওয়াশিংটনে নিয়ে চলুন।’

কমিশন জ্যাকের আর্জি শোনেনি। এবং সম্ভবত কোনও চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার আগেই জ্যাকের মৃত্যু ঘটে। জেলেই মারা যায় সে। 

এসবের মাঝেই জ্যাক একটা অদ্ভুত কথা বলে গিয়েছিল। তার কথানুসারে, অসওয়াল্ড একটি কাস্ত্রো – বিরোধী দলের সদস্য ছিল। সেই দলের উদ্দেশ্য ছিল কিউবাকে কাস্ত্রোর হাত থেকে মুক্তি দেওয়া। 

কী ভাবছেন, এই ব্যাটা কলমচি এমন সব তথ্য দিচ্ছে যা পরস্পরবিরোধী?

আমি কী করি বলুন তো? কেউ চাইছিল অসওয়াল্ডকে সোভিয়েত এজেন্ট, কমিউনিস্ট, কাস্ত্রোর লোক হিসেবে প্রমাণ করতে, আবার কেউ বলছিল সে কাস্ত্রো – বিরোধী ছিল। 

জ্যাকের বন্ধুরা বলেছিল, জ্যাক নাকি কেনেডির হত্যার ফলে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল, তাই সে খুনি অসওয়াল্ডকে গুলি মেরেছিল। কিন্তু আপনারাই বলুন তো, কোনও মাফিয়া গ্যাংস্টার, নাইটক্লাবের মালিক এসব এমনি – এমনি দুঃখী মনে করে দেবে? বিশ্বাস হয়? সে তো অসওয়াল্ডকে আগে থেকেই চিনত। খুনটা সে খুন করবে বলেই করেছিল। একেবারে ঠাণ্ডা মাথার খুন যাকে বলে। 

আরেকটা সম্ভাবনাও ছিল, হতে পারে অসওয়াল্ডই একমাত্র শুটার ছিল না। আরেকজন বন্দুকবাজ নিশানায় গুলি করেছিল সেদিন। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, সেদিন গুলি চলেছিল পথের ধারে বেড়ার আড়াল থেকে। কেনেডির গাড়ি সেইসময় ওখান দিয়েই যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগেই সেখানে জ্যাক রুবিকে একটি পিক – আপ ভ্যান নিয়ে দেখা গিয়েছিল। ছ’সাতটা গুলি চলার কথাও শোনা যায়। দুটো কেনেডির লেগেছিল। তিনটে লেগেছিল কোনোলির। একটা গুলি একজন দর্শকের কানমুতো ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল।  

মাফিয়ার পক্ষে এইসব কাজ করা অসম্ভব কিছুই ছিল না, কিন্তু মাফিয়ার লাভ? টাকা ছাড়া তারা শ্বাসটুকুও নিতে চায় না। কে দিল এত টাকা? 

জিমি হোফফা? হতে পারে। জিমি কেনেডি – হত্যার এক দশক পরে আশ্চর্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। আজ অবধি তাঁর কোনও হদিশ মেলেনি। তদন্ত চলেছিল। জানা যায় ইউনিয়ন পেনশন ফান্ড থেকে তিনি কয়েক মিলিয়ন ডলার সরিয়ে ছিলেন। তাহলে কি ওই টাকার কিছুটা বাঁ পুরোটা দিয়েই? জানা নেই।  

এখানে আরেকটা প্রশ্নও ওঠে। এতকিছু জানা সত্ত্বেও মাফিয়ার ভূমিকা নিয়ে কমিশন কিছুই করল না কেন? এত থিওরি খাড়া করা আর তাদের নিরসন করার চেয়ে সহজ ছিল মাফিয়ার দিকে আঙুল তুলে দাও। বলো, ওরা মেরেছে। কাজ মিটে যেত। কিন্তু তা না – করে গোটা ঘটনা পরম্পরা থেকে মাফিয়া নামক সম্প্রদায়কে একেবারে গায়েব করে দিল কমিশন। ঠারেঠোরে কমিশন বুঝিয়েও দিয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মাফিয়ার কোনও প্রকার সম্পর্কই নেই। ববি কিন্তু মাফিয়ার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন। এবং তাঁর হত্যাও মাফিয়াই করেছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক হাজার দস্তাবেজ সার্বজনীন করেন। সি আই এ এবং এফ বি আই তখন বলে, এরপরেও বেশ কিছু দলিল সবার সামনে আনা সম্ভব হল না। সেগুলো বাইরে এলে পরে আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কাদের কথা বলছিল এরা? কেনেডি – হত্যার পরে পাঁচ দশক কেটে গেছে, তারপরেও কার কী বিপদ হবে এইসব কাগজপত্র জনসমক্ষে এলে? তাহলে কি মাফিয়া কিংবা অসওয়াল্ড আসলে অন্যের ক্রীড়নক রূপে কাজ করছিল?

কার হাতের পুতুল ছিল তারা?

(ক্রমশ)