বিধাতার হাতে লেখা গান – ৫৭

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ষড়পঞ্চাশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৫৭

ওয়ারেন কমিশনের শেষ রিপোর্ট:

১৯৬২ সালের জুন মাসে লি হার্ভে অসওয়াল্ড সপরিবারে মস্কো থেকে টেক্সাসে চলে আসে। পরের মাসে সে একটি মেটাল ফ্যাক্টরিতে কাজে ঢোকে। সোভিয়েত থেকে ফিরে এসেছিল বলে এফ বি আই জুলাই – আগস্ট মাসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সে আশ্বস্ত করে যে, সে সোভিয়েতের গুপ্তচর ছিল না। অক্টোবর মাসে ডাল্লাসের একটি ফটোগ্রাফি কোম্পানিতে সে চাকরি পায়। সেই সময়ে রুথ পেন নামক এক মহিলার সঙ্গে তার আলাপ হয়, ওই মহিলা রাশিয়ান শিখতে আগ্রহী ছিল। সে (ওই মহিলা) অসওয়াল্ডের রাশিয়ান স্ত্রী এবং বাচ্চাদেরকে নিজের ইরভিন শহরের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল।

২০শে মার্চ, ১৯৬৩ সে শিকাগোর একটি কোম্পানি থেকে ডাকযোগে একটি রাইফেল অর্ডার করে। অর্ডার করার সময়ে সে ‘হিডেল’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিল, যা সম্ভবত ফিদেল (কাস্ত্রো) নাম থেকে উদ্বুদ্ধ ছিল। ১৯৬৩ সালের ৬ই এপ্রিল তার চাকরি চলে যায়।  

১০ই এপ্রিল, ১৯৬৩ সে নিজের স্ত্রী’র জন্যে একটি চিঠি লিখে যায়, সেখানে যাবতীয় কথার শেষে এটাও লেখা ছিল যে, যদি আমি না – ফিরি তাহলে জেলে খোঁজ নিও। সেদিনই সে একজন দক্ষিণপন্থী নেতা তথা রিটায়ার্ড সেনা আধিকারিক এ বাখারকে গুলি চালিয়ে হত্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তদন্তে এই কথা উঠে এসেছিল।

১৯৬৩ সালের মে মাসে সে নিউ অরলিন্সের একটি কফি কোম্পানিতে কাজ পায়। হিডেল ছদ্মনামের আড়ালে কাস্ত্রো – সমর্থক একটি সংগঠন তৈরি করে। নাম রাখে ‘ফেয়ার প্লে ফর কিউবা’। ওই সংগঠনের একমাত্র সদস্য সে একাই ছিল। জুলাই মাসে আবার তার চাকরি চলে যায়।  

১৯৬৩ সালে কাস্ত্রোর সমর্থনে লিফলেট বিলি করার সময়ে সে এফ বি আই –এর হাতে গ্রেফতার হয়। সে দুবার রেডিও ইন্টারভিউও দিয়েছিল। সেখানে সে নিজেকে ‘কমিউনিস্ট নই, মার্ক্সবাদী – লেনিনবাদী’ বলে দাবী করে। তার বক্তব্য ছিল দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার।

২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ সে নিজের পরিবারকে আবার রুথ পেনের কাছে ইরভিন, টেক্সাসে পাঠিয়ে দেয়। চারদিন পরে নিজে মেক্সিকো সিটির সোভিয়েত আর কিউবা দূতাবাসে গিয়ে দেখা করে। কিন্তু কোনও দেশের ভিসাই মেলে না।

অক্টোবর মাসে সে আবার টেক্সাসে ফিরে যায়। রুথ পেনের একজন প্রতিবেশী ডাল্লাসের একটি বই গুদামে চাকরি করত, ১৪ই অক্টোবর থেকে সে সেখানেই কাজে লাগে। ওই জায়গাতেই পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতে শুরু করে এবং সপ্তাহান্তে নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ইরভিনে যেতে থাকে। ২০শে অক্টোবর তার দ্বিতীয় কন্যার জন্ম হয়।

২১ তারিখে (বৃহস্পতি বার) সে নিজের সহকর্মীর সঙ্গে পরিবারের সাথে দেখা করতে ইরভিনে যায়।

সহকর্মী জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি তো শুক্রবার বাড়ি যেতেই, তাহলে একদিন আগে কেন?’

‘পর্দা টাঙানোর জন্যে ক’টা রড নিয়ে আসব।’

পর্দা টাঙানোর রড নয়, সে রাইফেল আনতে গিয়েছিল। সন্ধেবেলায় রুথ পেনের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলেছিল, রাতেরবেলায় রাইফেল খুলে প্যাক করেছিল।

২২শে নভেম্বর, মানে হত্যাকাণ্ডের দিন সকালে নিজের সহকর্মীর গাড়িতে করে পর্দার রডগুলোকে (রাইফেল) একটা বাদামী ব্যাগে ভরে সে অফিসে নিয়ে যায়।

১২:৩০ নাগাদ কেনেডির কনভয় তার বিল্ডিং – এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, ছ’তলার জানলা থেকে সে তিনটে বুলেট ফায়ার করে। তার মধ্যে একটা গুলি কেনেডির গলা চিরে গাড়ির সামনের দিকে বসে থাকা গভর্নর কোনোলিকে আঘাত করে। দ্বিতীয়টা কেনেডির মাথায় লেগেছিল।  

সে রাইফেল ওখানেই রেখে দোতলার খাওয়ার ঘরে চলে আসে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিল্ডিং পরীক্ষা করে দেখার দেখার জন্যে আসা একজন পুলিশকর্মী তাকে দেখে। বাইরে যখন হইহই চলছে, সে তখন কোলা কিনে খাচ্ছিল। তাকে দেখে সন্দেহ হয়নি।  

১২:৩৩-এ সে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে আসে, ১টায় নিজের ঘরে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে হাঁটতে থাকে। ততক্ষণে কোনো এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ দিয়েছিল যে, ষষ্ঠ তল থেকে একজন শ্বেতাঙ্গ যুবক গুলিটা চালিয়েছিল। এই কথা রেডিওতেও সম্প্রসারিত হচ্ছিল।

১:১৬ নাগাদ এক কিলোমিটার দূরে পুলিশ অফিসার টিপিট তাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে। সে তাকে গুলি করে মারে। তারপরে সেখান থেকে হেঁটে টেক্সাস থিয়েটারে যায়, যেখানে রিভলভার সমেত তাকে গ্রেফতার করা হয়।  

কিছুক্ষণের মধ্যেই গুদাম থেকে রাইফেলটাকে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু তার ওপরে আঙুলের কোনও ছাপ পাওয়া যায়নি। অসওয়ালদের স্ত্রী’র কাছ থেকে তার হাতে রাইফেল নিয়ে থাকা একটা ছবি মেলে, যা উদ্ধার হওয়া রাইফেলটির সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। এক জেল থেকে অন্য জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় জ্যাক রুবি নামক এক কেনেডি – সমর্থকের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।  

এই হত্যাকাণ্ডে কোনও বাহ্যিক কিংবা আভ্যন্তরীন এজেন্সি, অথবা কোনও মাফিয়া গ্যাং –এর কোনও ধরণের যোগসাজশ প্রমাণিত করা যায়নি। অন্য কোনও শুটারের গুলি চালানোর প্রমাণও মেলেনি। খুন একলা লি হার্ভে অসওয়াল্ড-ই করেছিল।

কেনেডির সঙ্গে একই গাড়িতে বসে থাকা জ্যাকলিন এবং দুটো গাড়ি পরে থাকা লিন্ডন জনসন সুরক্ষিত ছিলেন। গুলি লাগার আধঘণ্টা পরে হাসপাতালে কেনেডির মৃত্যু হয়, লিন্ডোন জনসন রাষ্ট্রপতির পদের দায়িত্ব নেন।

***

কেনেডির মৃত্যু সংবাদ শুনে নাস্তিক, কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত নিজেদের গির্জাঘরে ঘণ্টাধ্বনি জানিয়ে শোক জ্ঞাপন করেছিল। ক্রুশ্চেভ নিজেও শোকবার্তা জানান।  

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুজি বলেন, ‘একশো বছর আগে আজকের দিনেই আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গ ভাষণ দিয়েছিলেন, যা দাসত্ব প্রথার ইতি টানে। আজ, একশো বছর পরে, তাঁরই অনুগামী রাষ্ট্রপতি কেনেডিকে তাঁরই মতো হত্যা করা হল। কিন্তু এই শান্তি এবং মুক্তির প্রতীক বিশ্বে অমর হয়ে থাকবে।’

(সমাপ্ত)