Monday, May 20, 2024
spot_img
Homeপশ্চিমবঙ্গপশ্চিমবঙ্গ দিবসের ভাবনা : পূর্ববঙ্গ – পশ্চিমবঙ্গ – প্রবাস

পশ্চিমবঙ্গ দিবসের ভাবনা : পূর্ববঙ্গ – পশ্চিমবঙ্গ – প্রবাস

– পৌলমী রক্ষিত

 

সাম্প্রদায়িক হিংসা, ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের (অধুনা পূর্ববঙ্গ) লেখিকা তসলিমা নাসরিন। মৌলবাদীদের চোখরাঙানি সহ্য করেও কলম থামিয়ে দেননি। কিন্তু যে ধর্মে গোঁড়ামি প্রবল, যে ধর্মের ধ্বজাধারীরা বিজ্ঞান উপেক্ষা করে ধর্মের নামে, বাল্য বিবাহকে সমর্থন করে ধর্মের অজুহাতে, বিধর্মীকে হত্যা করাকে পুণ্য মনে করে, সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থকে সংশোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তসলিমা। তাঁর এই স্পর্ধা সমূলে তাঁকে উৎপাটিত করেছিল বাংলাদেশ থেকে।

১৯৯৩ সালে তাঁর লেখা ‘লজ্জা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়, তাতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু একটি হিন্দু পরিবারের উপর মুসলিমদের নির্যাতনের কাহিনি বর্ণিত হয়। তারপরেই মুসলিম মৌলবাদীরা তসলিমার উপর আক্রমণ করেন এবং তাঁর বই নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। একই পরিস্থিতির শিকার হন ভারতেও, মুসলিম ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্য ২০০৭ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতা শহরে দাঙ্গা শুরু করে ‘অল ইন্ডিয়া মাইনরিটি ফোরাম’। সাধের কলকাতা শহর থেকে তাঁকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্বাসিত হন বাংলার মাটি থেকে দূর প্রবাসে।

যে দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি, লিঙ্গসমতা নিয়ে কথা বললে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়তে হয়, দেশত্যাগ করতে হয়, সেই দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা অনুমানযোগ্য। বহুযুগ ধরে ধর্মের গোঁড়ামিকে প্রশ্রয়, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, মুক্তচিন্তকদের নির্মমভাবে হত্যা করে আসছে এক সম্প্রদায়। তাঁদের মনের বিষ বহুদিন আগে বুঝতে পেরেছিলেন আশুতোষ-পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তৎকালীন মুসলিম লিগ-কংগ্রেস সরকারের ইতিহাস সকলের জানা। ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট বাংলার তথা দেশের রাজনীতিতে সেই কালো দিন, মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামে’র ডাক দিল। শুরু হল হিন্দুদের উপর অত্যাচার, খুন, গণধর্ষণ, ডাকাতি। ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন নোয়াখালীতে হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাশেমের ফৌজ। শুরু হল বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কতম অধ্যায়। হিন্দুদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, নারীদের গণধর্ষণ থেকে খুন, কিছুই বাদ গেল না। নোয়াখালীর খবরে বিচলিত হলেন স্বয়ং গাঁধিজী, হিন্দুদের অবস্থা দেখতে ছুটে গেলেন সেখানে। নোয়াখালীর হিংসার প্রতিক্রিয়ায় ২৬ অক্টোবর বিহারে হিন্দুরা ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানকার মুসলমান অধিবাসীদের উপর। হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ল উত্তরপ্রদেশের গড়মুক্তেশ্বর। ইতিমধ্যে এল শ্রীহট্টের গণভোট, হিন্দুদের ভিটেমাটি ছাড়া করতে শ্রীহট্টকে তুলে দেওয়া হল পূর্ব পাকিস্তানের হাতে। দলে দলে হিন্দুরা পূর্ববঙ্গের ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিতে শুরু করলেন শরণার্থী শিবিরে।

বাঙালি হিন্দুদের জন্য আলাদা বাসভূমির দাবি জানালেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার তারকেশ্বর অধিবেশনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশভাগকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরেন। শ্যামাপ্রসাদের পাশে এসে দাঁড়ান শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, শ্রী নলিনীরঞ্জন সরকার, শ্রী যাদবেন্দ্রনাথ পাঁজা, শ্রী বিধানচন্দ্র রায়, ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা, ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার, ইতিহাসবিদ ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে তৈরি হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। জন্ম হল আমাদের আজকের পশ্চিমবঙ্গের।

তবে বাঙালির এই শরণার্থী হওয়ার ইতিহাস এখানেই থেমে যায়নি, এরপর ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ দশকের দাঙ্গা, রাম মন্দির বিতর্ক, যাই হোক ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে হিন্দুরা। কিন্তু এত গেল বাংলাদেশের কথা। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে ধুলাগড়, ডায়মন্ড হারবার, দত্তপুকুর,ক্যানিং, ভাঙ্গর, ভদ্রেশ্বর একের পর এক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়েছে হিন্দুরা। যে হিন্দুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ গঠন হয়েছিল, সেখানেই এখন মার খাচ্ছেন হিন্দুরা। কারণ পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যাঁদের জন্য এই ভূমি গড়ে উঠেছিল তাঁরা আবারও ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এই জনবিন্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটার ক্ষেত্রে দায়ী সীমান্তে ব্যাপক অনুপ্রবেশ। নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য একের পর এক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক অনুপ্রবেশে বাধা দেয়নি। সমানে চলেছে সংখ্যালঘু তোষণ। সেই তোষণ এতদুর পৌঁছে গিয়েছে যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু স্কুলে বাগদেবী সরস্বতী পুজো করতে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের বাধা দিয়েছে এক সম্প্রদায়। চুপ করে তোষণ চালিয়ে গিয়েছে সরকার। বাংলায় অনগ্রসর জাতিদের সংরক্ষণে আবার ভাগ করা হয়, ওবিসি ‘এ’ কোটা নির্ধারিত হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য। এবার পরবর্তীকালে এল আরও এক নতুন খেলা, তোষণের অন্য মাত্রা, বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা যেতে লাগল, ওবিসি ‘বি’ কোটার তুলনায় সংরক্ষিত আসন বেশি ‘এ’ কোটায়। ফল স্বরূপ যে হিন্দু ছেলেটির বেশি নম্বর এবং আকাদেমিক স্কোর ভাল ছিল সে চাকরি পেল না, পেল অন্যজন। হিন্দু ছেলেটি তখন আবার অন্য চাকরির খোঁজে বাধ্য হয়ে পাড়ি দিল অন্য রাজ্যে। সে হল ‘পরিযায়ী’ বা ‘উদ্বাস্তু’।

দেশভাগের সময় উদ্বাস্তু হয়ে একদল বাঙালি দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে, একদল বাঙালি উত্তর-ভারতের পার্বত্য উপত্যকায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গ থেকে নির্যাতিত হয়ে তাঁদের প্রথমে ঠাঁই হয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনে। যারা কলকাতার দমদম, যাদবপুরে বাসা করতে পেরেছিল, তাঁরা থেকে গেল। বাকিরা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের নানা রাজ্যে। বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যে (তৎকালীন বিহারের অন্তর্গত) বাস গড়ে তুলেছিল অনেকগুলি পরিবার। বর্তমান ছত্তিশগড়, ওড়িশা, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশের কিছু অঞ্চলেও তাঁরা বসতি স্থাপন করেন। ছত্তিশগড়, ওড়িশায় যাঁদের নির্বাসন হয়েছিল, তাঁরা সেখানে ওই বন জঙ্গলের মধ্যেই ঘর তৈরি করে, জীবনযাপন শুরু করে, যেভাবেই হোক করতে হয়েছিল। নদীমাতৃক, জলে পরিপূর্ণ বাংলার জীবন ছেড়ে কীভাবে তাঁরা ছত্তিসগড়ের শুখা মাটিতে বেঁচেছিল তা আমরা জানি না। জানতে চাওয়া হয়নি। তবে এইভাবেই কিছু পরিবার এখনও বেঁচে আছে সেখানে। অনেক পরিবার কাজুবাদাম গাছের বাগান করেছে, সংসারে কিছু হাল ফিরেছে। কিন্তু তাঁদের ঘরগুলি দেখলে আলাদা করে কোনও বাঙালির গৃহস্থ বাড়ি বলে মনে হয় না। বাড়িগুলিতে সুস্পষ্ট দক্ষিনী বা ওড়িশি ছাপ। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে আর বাঙালি বোধ, আচার, সত্ত্বা কোনটাই পরিলক্ষিত হয় না। উত্তর ভারতের হরিদ্বার, দেহরাদুন এই অঞ্চলে প্রচুর বিশ্বাস, সাহা পদবীর বাঙালি রয়েছেন, তাঁরা এখন শুধু ওই পদবিতেই বাঙালি পরিচয়টুকু বহন করছেন।

দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা, পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে রাজধানীর এক কোনে ঠাই পেয়েছিলেন কিছু মানুষ। সেখানে আজও রয়েছে ‘ইস্ট বেঙ্গল ডিসপ্লেসড্ সোসাইটি’। আগামিদিনে যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে না পারি, তাহলে কোনও একদিন আমরাও ওই ‘ডিসপ্লেসড্’ হয়ে যাব। বহু বাঙালি হিন্দু পরিবারের পূর্বপুরুষেরা ভিটেছাড়া হয়েছিলেন, সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমরা হতে দিতে পারি না, আমাদেরও যেন তসলিমার মত পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রবাসে না যেতে হয়। আসুন, ২০ জুনের পুণ্যলগ্নে সেই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করুন।

বঙ্গদেশ বারবার চেষ্টা করছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে না আসা খবরগুলো আপনাদের সামনে আনার। আমরা আপনাদের খবর করি, আপনাদের কথা লিখি। আমাদের এই প্রচেষ্টা ভালো লেগে থাকলে ১০ থেকে ১০,০০০ যে কোন মূল্যের ডোনেশন দিয়ে বঙ্গদেশের পাশে দাঁড়াতে পারেন। আমাদের আরও ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। ধন্যবাদ।

Most Popular