Thursday, May 9, 2024
spot_img
HomeArchivesহীনমূল্য হিন্দুজীবন

হীনমূল্য হিন্দুজীবন

বেশ কিছুদিন যাবৎ অ্যামেরিকা উত্তাল বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে। জর্জ পেরি ফ্লয়েড জুনিয়র, বা জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু থেকে মূলত এইবারের আন্দোলনের সূত্রপাত। মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে তিনি চাকরি করতেন। মূলত করোনা সংক্রান্ত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের চাকরি হারান। এই অবস্থায় একটি জাল কুড়ি ডলারের নোট ব্যবহার করে তিনি ধরা পড়েন, এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এই গ্রেফতারির সময়ে ডেরেক শোভিন নামে এক পুলিশ অফিসার তাঁর ঘাড়ে হাঁটু চেপে রাখে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে, এবং ফলত তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনার ফেরে পুলিশের হাতে বা অন্যান্য ভাবেও অ্যামেরিকার বর্ণবাদের অসংখ্য ঘটনা আবার সামনে চলে আসে, এবং গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে।

বর্ণবাদের ইতিহাস অ্যামেরিকায় দীর্ঘদিনের। অ্যামেরিকার আদি বাসিন্দাদের উপর গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি দাসপ্রথাও সে দেশে চলেছিল বহুদিন। অ্যামেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান ব্যক্তি এবং সে দেশের তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা পিতারাও অনেকে দাস রাখতেন। ১৮৬০ সালের আব্রাহাম লিঙ্কনের বিজয় এবং তাঁর দাসপ্রথা বিলোপের অঙ্গীকারের দরুন সেখানে গৃহযুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধে অবশ্য জয় হয় ইউনিয়নের, এবং ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন এম্যান্সিপেশন প্রোক্লেমেশন করেন। তবে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান অ্যামেরিকান এবং অ্যামেরিকান আদি অধিবাসী নেটিভ অ্যামেরিকানদের উপর অত্যাচার চলতেই থাকে। এছাড়া এশিয় বংশোদ্ভূত অধিবাসীদের উপরও অনেক বৈষম্যমূলক আইন এবং আচরণের উদাহরণ আছে অ্যামেরিকায়। মার্টিন লুথার কিঙয়ের কথা আমরা সকলেই জানি, এবং তাঁর ওয়াশিংটন মার্চের কথা। আইনগত দিক দিয়ে এমন অসংখ্য আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্য দূর হলেও এখনো অ্যামেরিকায় বর্ণবৈষম্যের অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চোখে আসে। কু ক্লুক্স ক্লান এবং আরো বর্ণ আধিপত্যবাদী দল এখনো সে দেশে অবস্থান করে, আইনের বাইরে।

বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনও অ্যামেরিকাই একটি চলতে থাকা প্রক্রিয়া, এবং জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনা আবার সেই স্রোতে তরঙ্গ এনেছে বর্তমানে। অ্যামেরিকা ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় উইনস্টন চার্চিলের কথা, যার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে ন্যক্কারজনক ভূমিকা কোন বাঙ্গালীর ভোলার কথা নয়। এই মনুষ্যকৃত দুর্ভিক্ষে ২০-৩০ লক্ষ মানুষের জীবনহানি হয়। স্বাভাবিকভাবে চার্চিলের তাতে হেলদোল ছিল না কারণ ভারতীয়(হিন্দু)দের তিনি এক বর্বর ধর্মপালনকারী বর্বর মানুষ বলে মনে করতেন।

তবে এই বর্ণবিদ্বেষ যে শুধু সাদা চামড়ার মানুষের একচেটিয়া এমন নয়। ইসলামের ইতিহাসে দাসপ্রথা সুবিদিত, এবং অমুসলিমদের দাস হিসাবে গণ্য করার বিস্তীর্ণ ইতিহাস আছে। এর মধ্যে শুধু আরব নয়, আফ্রিকা এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা দাসও আছে। আধুনিক কালে আইসিসের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে ইয়াজিদি এবং অন্যান্য নারীদের দাসী হিসাবে ক্রয় বিক্রয় করার নজির আবার সেই ইতিহাসের কথা মনে করিয়েছে আমাদের। ভারতবর্ষে ইসলামিক শাসনেও এরকম দাসপ্রথার নজির আছে। আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস ছাড়াও ভারতের অমুসলিমদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাস হিসাবে ক্রয় বিক্রয় করা হয়েছে। তাই এই প্রসঙ্গে অনেক ভারতীয় তথাকথিত প্রগতিশীলদের এই বর্ণবাদ বিরোধী ‘Black Lives Matter’ আন্দোলনকে ভারতে ‘Muslim Lives Matter’ হিসাবে ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর ঠেকে।

এই প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। একটি ঘটনা ঘটেছে কাশ্মীরের বুকে। কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দুদের কাশ্মীর থেকে বহিষ্কারের ইতিহাস আমাদের কারো অজানা নয়। এই মুহূর্তে কাশ্মীরের কোন সাংসদ বা বিধায়ক কাশ্মীরি পণ্ডিত নন। কাশ্মীর উপত্যকায় যে অল্প সংখ্যক হিন্দু এখনো টিকে আছেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অজয় পণ্ডিতা ভারতী। তিনি বর্তমান কাশ্মীরের ২% যে হিন্দু তাদের একজন ছিলেন, এবং সাথে সাথে তিনি ছিলেন কাশ্মীরের একজন হিন্দু সরপঞ্চ। সেই তিনিও খুন হন আততায়ীদের হাতে। সামান্য পঞ্চায়েত প্রধানের পদেও একজন হিন্দুর অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য ছিল না এই সন্ত্রাসবাদীদের কাছে। কংগ্রেস দলের সাথে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে একজন মুখবীর হিসাবেই গণ্য হলেন কাশ্মীরের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের কাছে। এই ইতিহাস শুধু কাশ্মীরের নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের চিত্র ইসলামি শাসনকালে।

একই ভাবে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয় যা আমাদের নিতান্ত আপন, অখণ্ড বঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি অংশের। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার  কোটালিপাড়া উপজেলার রামশীল গ্রামের নিখিল তালুকদার ছিলেন এক সামান্য কৃষক, ধর্মে হিন্দু। তিনি কয়েকজনের সাথে বসে তাস খেলছিলেন। এমত অবস্থায় স্থানীয় পুলিশের এএসআই শামীম হাসান এবং তার সোর্স রেজাউল সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ধরে ফেলে। এরপর শামীম হাসান তাঁর পিঠের উপর হাঁটু চেপে তাঁর শিরদাঁড়া ভেঙ্গে ফেলে। এর ফলে মৃত্যু হয় নিখিলের। নিখিল থেকে যাবে বাংলাদেশে ধুঁকতে ধুঁকতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পথে চলতে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেক প্রতিনিধি হিসাবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যাই নয়, বা দেশভাগ নয়, বহু যুগ ধরে চলতে থাকা বঙ্গভূমির সন্তানদের রুধিরধারা এই ভাবেই রঞ্জিত করতে থাকবে এই বাংলার রাতুল ধরাকে, যার অনেক কিছুরই কোন স্বীকৃতি মেলেনি উন্নত সমাজের ধ্বজাধারীদের থেকে।

কি আশ্চর্যজনক সমাপতন না? তাও এই ভারতীয় উপমহদেশের বুকে। অথচ ‘Hindu Lives Matter’ শব্দবন্ধটি আশ্চর্য হবে অনুপস্থিত এই ভারতের সমস্ত প্রধান প্রগতিশীলদের মুখে। বরং এই স্থানের এককালীন শাসনকর্তাদের তারা দেখাতে চায় শোষিত হিসাবে। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকে ব্যঙ্গ করা ছাড়া আর কিছুই না এই ‘Muslim Lives Matter’ আন্দোলনের কথা, কারণ ইতিহাস থেকে বর্তমান বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে এখনো স্পষ্ট যে ধর্মীয়(বর্ণ)বিদ্বেষের আঘাত মূলত নেমে আসে কাদের উপর।

বঙ্গদেশ বারবার চেষ্টা করছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে না আসা খবরগুলো আপনাদের সামনে আনার। আমরা আপনাদের খবর করি, আপনাদের কথা লিখি। আমাদের এই প্রচেষ্টা ভালো লেগে থাকলে ১০ থেকে ১০,০০০ যে কোন মূল্যের ডোনেশন দিয়ে বঙ্গদেশের পাশে দাঁড়াতে পারেন। আমাদের আরও ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। ধন্যবাদ।

রুদ্রদেব
রুদ্রদেব
রুদ্রদেব স্বভাবকবি সে বলতে গেলে জন্ম থেকেই।কলম ধরার আগে থেকেই হয়তো কথা আর ছন্দের সঙ্গে তাঁর জন্মেছিল নিবিড় বন্ধন।তাই হয়তো অন্নপ্রাশনেই বেছে নেন কলমকে, পুস্তক কাঞ্চন বাদ রেখেই। গদ্য-প্রবন্ধেও তাঁর আগ্রহ আছে সমানতালে। কাজের ফাঁকে লেখালিখি ছাড়াও তিনি চিত্রকলা এবং ফটোগ্রাফিতেও আগ্রহ রাখেন।

Most Popular