Thursday, May 9, 2024
spot_img
HomeArchivesধর্ম, রিলিজন ও বিশ্ববীক্ষা: সব ধর্মই সমান?

ধর্ম, রিলিজন ও বিশ্ববীক্ষা: সব ধর্মই সমান?

‘একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’- ঋগ্বেদ

সহজ ভাবে বললে, এই জীবন-জগতকে একজন ব্যক্তি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন তা-ই সেই ব্যক্তির বিশ্ববীক্ষা- ‘দৃষ্টিভঙ্গিই বাস্তবতা’। একই কথা খাটে, জনগোষ্ঠী ও গণসমাজের ক্ষেত্রেও। এই প্রেক্ষাপটেই আমরা ‘ধার্মিক’ জনগোষ্ঠী ও ‘আব্রাহামীয়’ জনগোষ্ঠীর বিশ্ববীক্ষা নিয়ে আলোচনা করব এবং বর্তমানের অন্যতম প্রধান বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হবো: সব ধর্মই কি সমান?

আধুনিক ভারতে, বিশেষ করে সংবিধানোত্তর ভারতে, এটি একটা মন্ত্রস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা ঘোষণা করা যে, সব ধর্মই ‘সমান’! উদারবাদী কালবৈষম্যমূলকতার (Anachronism) পরিপ্রেক্ষিতে সব ধর্মকেই সমানভাবে উদার ও উদারনৈতিক ভাবে সমান হিসাবে দেখানোর প্রচেষ্টা চলছে। এর প্রেক্ষাপটেই ‘তুলনামূলক ও  প্রতিতুলনামূলক’ (Comparing and Contrasting) পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা ‘ধার্মিক’ ধর্মবিশ্বাস ও ‘আব্রাহামীয় বা দৈববাণীমূলক’ ধর্মবিশ্বাসের পারস্পরিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। এখানে ধার্মিক ধর্মবিশ্বাস বলতে ভারতভূমিতে উদ্ভুত ধর্মবিশ্বাস তথা ধর্মমতগুলির কথা বলা হয়েছে; আর, আব্রাহামীয়/দৈববাণীমূলক ধর্মবিশ্বাস বলতে সেই সব ধর্মমতগুলির কথা বলা হয়েছে যেগুলি মেনেছে যে ঈশ্বর (God) আব্রাহামকে প্রথম নিজের কথা ‘রিভিল’ বা ‘দৈববাণী’ করেছিলেন।

 

ধর্ম

ভাষা আর বাস্তবতা- দুইই পরস্পরকে তৈরী ও প্রভাবিত করে। প্রতিটি শব্দ/বাক্যই হলো ‘জীবনধারাগত নির্মাণ’ (Cultural construct), যেগুলির মধ্যে দিয়েই একটি ভাষা তৈরী হয়ে ওঠে, যা একটি জনগোষ্ঠীর জীবনচর্চায় তথা ‘এথনিসিটি’ ও ‘আইডেন্টিটি’ বা গোষ্ঠী-পরিচিতি নির্মাণে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই, ভাষার ভূমিকা মানুষের জীবন-জগতগত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সংস্কৃত শব্দ হিসেবে ‘ধর্ম’ শব্দটি এই ভারতভূমিতেই উদ্ভূত হয়েছিল, যার অর্থ সঠিকভাবে জীবন চর্চা এবং ন্যায়নিষ্ঠ ভাবে সত্য পথে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা। এই ধর্ম হচ্ছে ‘ঋত’র অংশ; আর ঋত হচ্ছে সেই সংস্কৃত শব্দ যা বোঝায় সর্বজনীন সর্বজাগতিক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও তার অন্তর্ভুক্ত জীবজগতেরও নিয়মবদ্ধতা। সেই জন্য এই ভারতভূমিতে ধর্মকে একটি সর্বজনীন নীতি হিসেবে দেখা হয়েছে, যার দ্বারা নিয়ম-শৃঙ্খলাসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ জাগতিক জীবনচর্চাকে বোঝানো হয়েছে। তাই ‘ঋতধর্ম’র কথা বলা হয়, যা এসেছে ‘ব্রহ্মণ/ব্রহ্ম’ অর্থাৎ ‘চরম ও পরম সত্য’ থেকে। সেই জন্য ধর্ম জড়িত সত্য (Truth)-এর সঙ্গে এবং ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে ধর্ম হচ্ছে ন্যায়নিষ্ঠ মনন-চিন্তন, কথন এবং আচরণগত জীবনচর্চা। এই ধর্মনিষ্ঠ জীবনযাপনের সঙ্গে একদিকে যেমন ‘অহিংসা’ (non-Violence) জড়িত, ঠিক তেমনি আরেকদিকে অনৃশংশতাও (non-Cruelty) জড়িত। আর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে ক্রমেই ধর্মবিশ্বাস, ধর্মমত, ধর্মতন্ত্রে বা ধর্মব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সেইভাবে এই ভারতভূমিতে বিভিন্ন ধরনের ধর্মমতের সৃষ্টি হয়েছে। তারমধ্যে প্রধান হচ্ছে সনাতন হিন্দু ধর্মবিশ্বাস, যা বৈদিক ধর্মীয় বিশ্বাসের আধারে হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলেছে। তারপরে, একে একে আরো অনেক ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মমত গড়ে উঠেছে। যেমন, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শিখধর্ম ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন জনজাতিগত ধর্মবিশ্বাসও এই ধার্মিক ভারতে বয়ে চলেছে।

 

রিলিজন

এখানেই একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে, ধর্ম বলতে ভারতে যা বোঝায় পশ্চিমে রিলিজন বলতে কি তাই বোঝায়? রিলিজন বলতে ‘ঈশ্বরের’ সঙ্গে মানুষের ‘পুনঃসম্পর্ক স্থাপন’ (‘to reconnect’) করাকে বোঝায়। এছাড়াও রিলিজন বলতে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, পবিত্র জিনিসের উপর শ্রদ্ধা ইত্যাদিকেও বোঝায়। যেহেতু ঈশ্বরকে এই জগতের বাইরের আলাদা একজন হিসেবে ধরা হয়, তাই রিলিজন যেন অন্য জগৎ (other worldly) অর্থাৎ পরজাগতিক জীবনকে বোঝায়, ইহজাগতিক জীবনকে বোঝায় না। এই অর্থে পশ্চিমে রিলিজন ও সেকুলারিজমকে পারস্পরিক বিপরীতার্থক অর্থেই বোঝানো হয়। কারণ, পশ্চিমী জীবনধারায় রিলিজনের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে একেশ্বরবাদী আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচার, যেখানে ‘ডিভাইন গড’কে ‘এক এবং একমাত্র’ হিসেবে ধরা হয়েছে এবং সেই ঈশ্বরের আকার বা নিরাকার যাই হোক না কেন একটি নির্দিষ্ট ধরনের পূজাপদ্ধতি মানা হয়েছে। বিভিন্ন ধার্মিক ধর্মমতের মতো আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধর্মমতের উদ্ভব ঘটেছে। যেমন, ইহুদীধর্ম, খ্রিষ্টীয়ধর্ম, ইসলামধর্ম ইত্যাদি। তবে প্রত্যেকেরই মূল ধর্মতত্ত্ব একই অর্থাৎ আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদ।

 

তুলনা ও প্রতিতুলনা

এবারে আমরা ধর্মতত্ত্বের (Theology) বিভিন্ন দিক, যেমন, আত্মতত্ত্ব, মুক্তিতত্ত্ব (Eschatology), উদ্ধারতত্ত্ব (Soteriology), অবতারতত্ত্ব ( Incarnation theory), ঈশ্বররূপত্ব (Theophany) ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ধার্মিক ধর্মবিশ্বাস ও আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে কিছু তুলনা ও প্রতিতুলনামূলক আলোচনা করব।

 

সত্য, বাস্তবতা ও ঈশ্বর

ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে ধার্মিক ধর্মবিশ্বাস যেখানে ‘আরোহীমূলক ও উপলব্ধিমুলক’ (Inductive and Experiential), সেখানে আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাস ‘অবরোহীমূলক ও দৈববাণীমূলক’ (Deductive and Revealing)। একজন ধার্মিক ব্যক্তি সত্য ও ঈশ্বরজ্ঞানের জন্য বিভিন্ন পথ বা পদ্ধতিকে আধুনিক পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এগোতে পারেন।

ধার্মিক জ্ঞানতত্ত্বে (Epistemology) ধর্ম একটি সর্বজনীন ধারণা (Concept) যা সমস্ত কিছুকে, সমস্ত জনকেই একসূত্রে ধরে রাখার কথা বলে। ধার্মিক পরম্পরায় সত্যের স্বরূপকে দেখা হয় এইভাবে: ‘একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ অর্থাৎ সত্য যা অস্তিময়, যা আছে, যা নিত্য, তা একই; কিন্তু তা বিভিন্ন জনের কাছে পর্যবেক্ষণ ও অনুভবের সাপেক্ষে বিভিন্ন ভাবে প্রতিভাত হয়। সত্যের এই অবস্থান আধুনিক বিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনুসারী। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ধার্মিক তত্ত্ব ও পরম্পরাগত বিশ্বাসে ধার্মিক ব্যক্তিরা সত্য, বাস্তবতা এবং জীবনের বিভিন্নতাকে শুধুমাত্র সহ্যই করে না, সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে গ্রহণও করে। ধার্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম হচ্ছে ‘যা ধরে রাখে’; যেমন, জলের ধর্ম ‘জলত্ত্ব’, তেমনি মানুষের ক্ষেত্রে ‘মনুষ্যত্ব’। সেই ধর্মের সাপেক্ষেই জগত-জীবনকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। ধার্মিক পরম্পরায় ইহজীবন ও পরজীবন যেন একই ‘জীবনের, বাস্তবের দুই পিঠ’, পরস্পর সম্পৃক্ত, অবিভাজ্য; তাই, ইহজগত ‘অভিশপ্ত’ নয়।

কিন্তু আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদের সাপেক্ষে রিলিজন এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে; যেখানে সত্য, জগত, বাস্তবতা ও জীবন- এ সবের ক্ষেত্রেই এক নির্দিষ্ট ধারণা পোষণ করা হয়। আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসে এই ইহজগতকে ‘অভিশপ্ত’ ধরা হয় এবং পরজগত হচ্ছে ডিভাইন বা ‘ঐশ্বরিক’। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্যকে এমন নির্দিষ্ট ভাবে দেখা হয়, যা আব্রাহামীয় ব্যক্তি-ঈশ্বর ‘গড’ দৈববাণীর মাধ্যমে বলেছেন এবং পুরো মানবজাতিকে ‘বিশ্বাসী’ ও ‘অবিশ্বাসী’- এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন।

কিন্তু, ধার্মিক বিশ্ববীক্ষাতে ঐশ্বরিকতার নির্যাস হচ্ছে সর্বব্যাপী সর্বানুভূ ‘ব্রহ্মণ/ব্রহ্ম’ (Brahmn/Brahman), যা হচ্ছে ‘চরম এবং পরম’ সত্য, যা ‘সৎ’ (Truth), যা একইসঙ্গে সীমায়িত ও সীমাহীন, ব্যক্তিগত ও ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, সাকার ও নিরাকার, রূপ ও অরূপ- তাই তিনি ‘অবাঙমনসগোচরম’, তাকে মন-বুদ্ধি-বাক্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি ব্যাখ্যাতীত। এই ব্রহ্মণ যেমন নিজেকে প্রকাশ করেন, আবার অন্যদিকে অপ্রকাশিত থাকতে পারেন। ধার্মিক ঐশ্বরিকতা সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যে এক যোগসূত্রের কথা বলে। সেই জন্য হিন্দু ধর্মবিশ্বাসকে সহজ কোনো তত্ত্বের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ হিন্দু ধর্মতত্ত্বে একদিকে যেমন সর্বেশ্বরবাদের (Pantheism) কথা বলা হয়েছে, ঠিক একই ভাবে বিশ্বত্তোরবাদ (Panentheism), একেশ্বরবাদ (Monotheism), বহুদেববাদ (Polytheism), এমন কি নিরীশ্বরবাদের (Atheism) কথাও বলা হয়েছে।

পরম সত্য হিসাবে যে ব্রহ্মণের কথা বলা হয়েছে, তাকেই আবার ‘পরমাত্মা’ও ধরা হয়েছে, যা ‘পরম ও সর্বময়’ আত্মা, যা চিৎ-স্বরূপ (Consciousness)। এই পরমাত্মারই অংশ হচ্ছে ‘জীবাত্মা’, যা প্রতিটি জীবের দেহ-মন ছাড়িয়ে ‘আত্ম-স্বরূপ’ (Self)। তাই, জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ একই এবং অবিচ্ছেদ্য। এই ব্রহ্মণকেই সীমায়িত রূপে ব্যক্তিগত স্তরে যখন অনুভব করা হয়, তখন ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘পরমেশ্বর’ হিসাবে বিষ্ণু, শিব, শক্তি ইত্যাদি দেব-দেবীরূপে ব্যক্তি তথা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ধারা অনুযায়ী পূজা করা হয়। তাই, ভগবান হিসাবে ব্রহ্মণ ‘আনন্দ-স্বরূপ’ (Blissful)। অতএব, ধার্মিক হিন্দু ধর্মবিশ্বাসে ঈশ্বরতত্ত্ব হচ্ছে পরমসত্যের ‘এক অদ্বয় তত্ত্ব’- ‘ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবান ইতি শব্দতে’- যিনি ব্রহ্ম তিনিই পরমাত্মা, তিনিই আবার ভগবান। তাই ‘তিনি’ ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ-স্বরূপ’ (Truth-Consciousness-Blissful)

বিভিন্ন দেব-দেবীরূপে একই ‘ব্রহ্মশক্তি’ এই জগত সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কারণস্বরূপ। ‘তিনি’ রূপে শুধুমাত্র পুরুষ নন, তিনি নারীও। তাই, এক তিনিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হন। তাই, বহুদেববাদ তত্ত্ব দিয়ে ধার্মিক হিন্দু ধর্মবিশ্বাসকে অতি সরলীকরণ করা যায় না। কারণ, হিন্দু ধর্মতত্ত্ব মূলতঃ এক অদ্বয় তত্ত্ব।

কিন্তু, আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদী তত্ত্বে গড বা ঈশ্বর তার সৃষ্ট এই জগত ও তার বিভিন্ন সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণই পৃথক থাকেন এবং তার সৃষ্টির মধ্যে কোনো ঈশ্বরীয় গুণ থাকতে পারে না। তিনি সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান পুরুষ সৃষ্টিকর্তা। অবশ্য, এই তত্ত্বে ধর্মমত ভেদে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন, ইহুদীধর্মে ঈশ্বর ‘জিহোভা’র কোনো দ্বিত্ব/ত্রিত্ব নেই এবং ‘তোহরা’ অনুযায়ী তিনি এক ব্যক্তি। কিন্তু, খ্রিষ্টীয়ধর্মে একেশ্বরবাদী ত্রিত্ববাদের (Trinity) কথা মানা হয়েছে, যেখানে ত্রিত্বের একদিকে পিতা ঈশ্বর, আরেকদিকে পুত্র খ্রীষ্ট, ও অন্যদিকে ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা (Holy Spirit) এবং নাজারাথের খ্রীষ্টকে ঈশ্বরের মানবীয় অবতার হিসাবে মানা হয়েছে। তবে, ইসলামধর্মে গড অর্থাৎ ‘আল্লাহ’ কঠোরভাবে এক (Tawhid) এবং খ্রীষ্ট কখনোই ঈশ্বর নন, বরং একজন ‘প্রফেট’ এবং পয়গম্বর হজরত হচ্ছেন শেষ পয়গম্বর।

তাই, সত্য, বাস্তবতা ও ঈশ্বরকে হিন্দু ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা আব্রাহামীয় ধর্মতত্ত্বের থেকে প্রায় সম্পূর্ণই আলাদা।

 

জীবন, আত্মা ও শয়তান

ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে যে ‘আত্মতত্ত্ব’ আছে সেখানে মানুষ হচ্ছে সেই জীব যার আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা আছে এবং সেই জীবাত্মা হচ্ছে দেহ-মন-ছাড়িয়ে এক ‘সত্তা’ যা মূলতঃ পরম সত্তা পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত। তাই জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ বিশেষ। সেই জন্য প্রতিটি মানুষ ‘অমৃতস্য পুত্রা’! মানুষ মাত্রেই অমৃতের সন্তান। মানুষ মাত্রেই পূণ্যময় এবং জন্মগতভাবেই মুক্ত। তাই মানুষ ‘জন্মগত পাপী’ নয়। যদিও সে অজ্ঞানে ও ‘মায়া’র প্রভাবে বদ্ধ হয়ে থাকে।

কিন্তু, আব্রাহামীয় ধর্মতত্ত্বে মানুষ জন্মগতভাবে মুক্ত নয়, বরঞ্চ জন্মগতভাবে পাপী। কারণ, মানুষ ‘আদি মানব-মানবী’ আদম ও ইভের উত্তরসূরী। আর আদম ও ইভ ‘শয়তানের’ প্ররোচনায় পাপকর্ম করে ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে এই পাপপূর্ণ পৃথিবীতে এসেছিল। তাই উত্তরসূরী হিসাবে সমস্ত মানবজাতি ‘জন্মপাপী’!

যদিও ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে এই শয়তানের কোন তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই, অস্তিত্বও নেই; তবে আব্রাহামীয় ধর্মতত্ত্বে শয়তান এক চরম বাস্তব অস্তিত্ব। যেহেতু প্রতিটি জীবই মূলতঃ পূণ্যময়, তাই ধার্মিক তত্ত্বে কোন শয়তানের অস্তিত্বই নেই। ধার্মিক তত্ত্বে ভগবান সদা কৃপাময় এবং নিরপেক্ষ। তাই তিনি কাউকে অভিশাপ দিতেই পারেন না এবং সেই জন্য কোন জীব সারা জীবনের জন্য স্বর্গ বা নরকপ্রাপ্ত হয় না। তবে, বহু জন্মের মধ্যে দিয়ে সাধনার মাধ্যমে জীব মুক্তি পেতে পারে। এইখানেই আরেকটি মূল পার্থক্যের কথা আসে। তা হল, হিন্দু ধর্মতত্ত্বে  জীবের ‘অনেক জন্ম’ হতে পারে। কিন্তু, আব্রাহামীয় মতে, মানুষের ‘একটাই জন্ম’ এবং এই মতে ‘বিচারের দিনে’ (The Day of Judgement) ‘বিশ্বাসীরা’ হয় আনন্দময় স্বর্গে বা যন্ত্রণাময় নরকে চিরজীবনের মতো স্থান পায়।

 

মুক্তি, উদ্ধার ও সময়কাল

মুক্তিতত্ত্বের ক্ষেত্রেও ধার্মিক ও আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে এক মূলগত পার্থক্য আছে। এবার, সেই নিয়ে আলোচনা করা যাক।

জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি? ধার্মিকতত্ত্বে জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হচ্ছে ‘মোক্ষ’, ‘জীবমুক্তি’, ‘কৈবল্য’, ‘নির্বাণ’ বা ‘সমাধি’। এ সমস্ত কিছুকে একসঙ্গে ইংরেজিতে ‘লিবারেশন’ অর্থাৎ মুক্তি শব্দ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। এখন এই মুক্তিকে বিভিন্ন ধার্মিকমতে বিভিন্ন ভাবে ধরা হয়েছে: ঈশ্বরের সঙ্গে সাযুজ্য, ঈশ্বর সম্বন্ধীয় জ্ঞান প্রাপ্তি, ঈশ্বরের সঙ্গে পরম সম্বন্ধস্থাপন, জীবজগতের সঙ্গে ঐক্য সম্বন্ধস্থাপন, চরম নিঃস্বার্থপরতা ও আত্মজ্ঞান লাভ, পরম মানসিক স্থিতি বা ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ, সমস্ত জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্তি ইত্যাদি। কর্মযোগ অর্থাৎ সঠিক ন্যায়নিষ্ঠ কর্মের মাধ্যমে যোগ, ভক্তিযোগ অর্থাৎ ভগবানের প্রতি পরম নিষ্ঠা, জ্ঞানযোগ অর্থাৎ জ্ঞানের ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে ঈশ্বরকে জানা, বা রাজযোগ অর্থাৎ ধ্যানের মাধ্যমে ধার্মিক মানুষ এই সংসার থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন, যে সংসার জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়। যোগ অর্থে যেমন পরম সত্যের সঙ্গে মিলন বোঝায়, তেমনি একটা পন্থা বা পদ্ধতিও বোঝায়। জীবাত্মার ‘অমরতা’ ও ধ্বংসহীনতায় বিশ্বাস- ধার্মিক তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি বৈশিষ্ট্য। ধরা হয়, বিভিন্ন মনুষ্যেতর জন্মের মধ্য দিয়ে ‘বিবর্তনের’ শেষে জীব এই মানুষজন্ম পায়।

সেই কারণে ‘অবতার ও অবতারতত্ত্ব’ ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাহলে তিনি কেন নিজে এই ধরাধামে ‘অবতার’ হিসাবে বিভিন্ন রূপে ‘অবতরণ’ করতে পারবেন না? সেই কারণেই ‘দশাবতার তত্ত্ব’ হিন্দু ধার্মিক তত্ত্বের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বররূপ তত্ত্ব (Theophany) সে কারণেই এই ধার্মিক তত্ত্বে মান্যতা পেয়েছে, যা ঈশ্বরের ‘সর্বশক্তিময়তাকে’ স্বীকার করেছে।

তাই, কাল অর্থাৎ সময়কে ধার্মিক তত্ত্বে শাশ্বত ও আবর্তনমূলক হিসাবে ধরা হয়েছে। ‘পরমাণু’- সেকেন্ডের ভগ্নাংশ থেকে ‘কল্প’- কয়েক বিলিয়ন বছরের যুগ- এমন বিশাল সময়কালের কথা বলা হয়েছে, যা আত্মা, অবতার, মোক্ষ ইত্যাদির বাস্তবতাকে স্বীকার করেছে। তাই, ধার্মিক জীবনচর্চায় ‘মুক্তি’ আব্রাহামীয় ‘উদ্ধার’ ধারণার মতো নয়।

আব্রাহামীয় ধর্মতত্ত্বের ‘উদ্ধারতত্ত্বে’ (Soteriology) যে উদ্ধারের (Salvation) কথা বলা হয়েছে, সেখানে মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করার কথা বলা হয়েছে। এই ধর্মতত্ত্বে যেহেতু মানুষ মাত্রই জন্ম-পাপী, তাই মানুষকে উদ্ধার করবেন ঈশ্বর। ইহুদিধর্মে ইহুদিদের ঈশ্বর-কর্তৃক উদ্ধার পেতে  ব্যক্তি তথা সমষ্টিকে ‘দশ আজ্ঞা’ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টধর্মে এই উদ্ধারের কর্তা হচ্ছেন ঈশ্বরপুত্র খ্রীষ্ট। কারণ ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘আদমের পতনের’ পরে ‘বিশ্বাসী’ মানুষজাতিকে বিশ্বের ‘শেষ বিচারের দিনে’ (Day of Judgement) উদ্ধার করতে হবে। আবার, ইসলামধর্মে উদ্ধার বলতে মুসলিমদের স্বর্গ বা জান্নাতে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে; তারা সেই বিশ্বাসী যারা এক আল্লাহকে এবং তার বাণী সম্বলিত কুরআনকে বিশ্বাস করে পাঁচ নীতি মেনে চলে। উদ্ধার পর্ব আব্রাহামীয় ধর্মে সেই শেষ বিচারের দিনেই করা হবে এবং যা দিনের হিসেবে একটা সরলরৈখিক সময় হিসেবে ধরা হয়।

তাই সংক্ষেপে বলা যায়, ধার্মিক বিশ্বাসে মানুষের মুক্তি হচ্ছে মূলতঃ পূণ্যময় জীবাত্মার পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। সেই আত্মার মুক্তি ধার্মিক তত্ত্বে অবশ্যই জীব সাধনার মাধ্যমে প্রাপ্ত হবে। এই মুক্তিকে হিন্দু পরম্পরায় মোক্ষ, জৈন পরম্পরায় সিদ্ধা, থেরাবাদী বৌদ্ধ পরম্পরায় বোধীসত্ত্ব প্রাপ্তি বলা হয়। কিন্তু, আব্রাহামীয় তত্ত্বে মানুষকে মূলতঃ পাপী ধরে শুধুমাত্র বিশ্বাসীদেরকেই ঈশ্বর উদ্ধার করবেন এবং স্বর্গে স্থান দেবেন।

 

দৈববাণীপ্রকাশ, ঈশ্বরের জ্ঞান ও ধর্মগ্রন্থ

ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে “পবিত্র বাণী-সম্বলিত পুঁথি” যা স্মৃতির মধ্যে দিয়ে মুখে মুখে পরম্পরাগত ভাবে প্রাপ্ত হয়েছে এবং শেষে প্রাচীন কালে শিলালিপি, তালপাতা, পার্চমেন্ট ইত্যাদিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

ধার্মিক ধারায় ‘ঋগ্বেদ’, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ, তাকেই মূলভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। বেদ অর্থে জ্ঞান। এই জ্ঞানকে ইংরেজি পরিভাষায় কিছু অর্থে নলেজ বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে, জ্ঞান হচ্ছে সেই পরম সত্যকে জানা; আর বিদ্যা হচ্ছে জাগতিক বিষয় সম্বন্ধে জানা। চার বেদ ও উপনিষদকে ‘অপৌরুষেয়’ অর্থাৎ ‘যা মানুষের রচিত নয়’ বলা হয়, যা ‘সরাসরি প্রকাশিত’ হয়েছে; এগুলিকে বলা হচ্ছে ‘শ্রুতি’, যা হচ্ছে সেই পরম সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান। শ্রুতি ছাড়াও পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি বিভিন্ন ‘স্মৃতি’, যা বিভিন্ন শাস্ত্রের আধারে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, রামায়ণ, মহাভারত মহাকাব্য দুটি, বিভিন্ন পুরান, তন্ত্রশাস্ত্র, যোগসূত্র, বিভিন্ন আগম শাস্ত্র, এবং বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র। আবার ‘ভগবতগীতা’ মহাভারতের অন্তর্গত, তাকে বলা হয় সমস্ত বেদের সার। অন্যান্য ধার্মিক বিশ্বাসধারাতেও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ আছে। যেমন, জৈনদের ‘অঙ্গ’ ও ‘সময়সার’, বৌদ্ধদের ‘ত্রিপিটক’; আবার শিখদের ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’।

কিন্তু, এই সমস্ত ধার্মিক ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলি মূলত ‘বর্ণনামূলক ও অ-বিচারমূলক’ (Descriptive and non-Judgemental)। অপরপক্ষে, আব্রাহামীয় বিশ্বাসধারার ধর্মগ্রন্থগুলি, যেমন, ইহুদিদের ‘তানাক/ হিব্রু বাইবেল’ এবং ‘তোহরা’, খ্রিস্টানদের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ ও ‘নিউ টেস্টামেন্ট’, মুসলমানদের ‘কুর়্আন’ ও ‘হাদিস’ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থগুলি মূলতঃ ‘নিদানমূলক ও বিচারমূলক’ (Prescriptive and Judgemental), যেখানে সব সময় ‘এটা করো, ওটা করবে না’ এই ভাবেই বলা হয়েছে। কারণ‌, এই ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের ‘প্রকাশিত বাণী’ হিসেবে ধরা হয়, যা দৈববাণীমূলক। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি-ঈশ্বর তার সম্বন্ধে, তার ইচ্ছা সম্বন্ধে, তার ক্ষমতা সম্বন্ধে যেন মানুষকে প্রকাশ করছেন। তাই আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্থগুলি মানুষের পক্ষে পরম সত্য জ্ঞানলাভের কথা বলে না, যা বলা হয়েছে ধার্মিক বিশ্বাসধারার ধর্মগ্রন্থগুলিতে।

ধার্মিক বিশ্বাসধারায় একজন ঈশ্বর সম্বন্ধীয় জ্ঞানের তথা জ্ঞানার্জনের পথের ব্যাপারে বা পদ্ধতির ব্যাপারে ‘প্রশ্ন’ করতে পারেন এবং এই পদ্ধতি যেহেতু মূলতঃ আরোহীমূলক ও অনুভবমূলক, তাই এই ঈশ্বরীয় জ্ঞানকে বলা হয় ‘অনুভববেদ্য জ্ঞান’, তা শ্রুতির ঋষিরা বলে গেছেন। এই ঋষিদের অনেকটা আব্রাহামীয় প্রফেটদের মতো বলা যায়। তবে, এই ঋষিরা সেই চরম ও পরম সত্যকে অনুভব করে সেই ‘ঈশ্বরীয় জ্ঞান’ প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও, ধার্মিক বিশ্বাসধারায় ‘ধারাবাহিক প্রকাশের’ (Continuos Revelation) ধারণাকে স্বীকার করা হয়েছে। কারণ ঈশ্বর সবসময়ই প্রকাশমান এবং ধারাবাহিকভাবে এই জগত-জীবনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন। অপরপক্ষে, আব্রাহামীয় বিশ্বাসধারায় এই ‘রিভিলেশন’ একেবারেই নির্দিষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে এবং তার আর কোন পরিবর্তন হতে পারে না।

 

প্রতিমা, আইডল ও পূজা

আব্রাহামীয় বিশ্বাসধারার সাপেক্ষে অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে, ধার্মিক বিশ্বাসধারা মতে প্রতিমা বা মূর্তি পূজা, যাকে আব্রাহামীয়রা বলেন ‘পুতুল পূজা’! কিন্তু, প্রথমেই বোঝা দরকার যে, ধর্ম যেমন রিলিজন নয়, বা গুরু যেমন মেন্টর নয়; ঠিক তেমনি প্রতিমা পুতুল (Idol) নয়। আব্রাহামীয় ধারায় ‘পুতুল পূজা’ বলতে যা বোঝায়, ধার্মিক ধারায় তা বোঝায় না। সংস্কৃত শব্দ প্রতিমার ইংরেজি পারিভাষিক শব্দ হচ্ছে ইমেজ, লাইকনেস ইত্যাদি; যদিও ওই শব্দগুলো দিয়ে প্রতিমার মর্মার্থ ও ব্যঞ্জনাকে ধরা যায় না। ঈশ্বর/দেবতার ‘পবিত্র প্রতিমূর্তি’র কথা ভাবা হয়েছে ‘প্রতিমা’র মাধ্যমে, যা  সেই একই ঈশ্বরের বিভিন্ন ভাব, রূপ ও শক্তির ব্যঞ্জনাকে ফুটিয়ে তোলে। তাই কোন প্রতিমাকে পূজা করার আগে ‘পবিত্র মন্ত্র’ দ্বারা তাতে সেই ঈশ্বরকল্পকে আহ্বান করে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করা হয়। তাই ধার্মিক ধারায় প্রতিমাপূজা বলতে যা বোঝায়, তা আব্রাহামীয় ধারার পুতুলপূজার মতো নয়।

যদি ঈশ্বরকে সর্বব্যাপী সর্বানুভূ সর্বশক্তিমান ভাবা হয়, তাহলে সেই ঈশ্বর কেন নিজেকে প্রতিমা বা মূর্তি বা বিগ্রহ এমনকি অবতার হিসেবে প্রকাশ করতে পারবেন না! হিন্দু ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বরকে ও তার শক্তি, ক্ষমতাকে সীমায়িত করা হয় নি। তাই প্রতিটি জীব, প্রতিটি দেবদেবী সেই এক ব্রহ্মশক্তির অংশমাত্র- প্রতিটি সৃষ্টিই ‘অংশ অবতার’।

সেই কারণে ধার্মিক বিশ্বাসধারায় কোন একটি বিশেষ পূজাপদ্ধতি, নির্দিষ্ট পথের কথা বলা হয়নি। সীমায়িত প্রকাশিত দেবতাকে আরাধনা থেকে সীমাহীন অপ্রকাশিত ব্রহ্মণকে ধ্যান করা পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে তার নিজের নিজের ভাব ও ক্ষমতা অনুযায়ী পূজা করার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু, আব্রাহামীয় ধারায় সেই ধরনের অধিকার দেওয়া হয়নি। বিশ্বাসীদের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতেই ঈশ্বরকে ভজনা করা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।

 

ঋষি, গুরু ও প্রফেট

প্রশ্ন হল, ঈশ্বর ও ভক্তের মধ্যে কোন মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তির ভূমিকা আছে কি? এখানেই ধার্মিক ধারায় ঋষি ও গুরু এবং আব্রাহামীয় ধারায় প্রফেট বা পয়গম্বরের ভূমিকার কথা আসে। ঋষিরা হলেন ‘আত্মোপলব্ধিকারী ব্যক্তি’ (Self-realised person)। ধার্মিক ধারায় বহু ঋষি, বিশেষত সপ্তর্ষি ও তাদের শিষ্য-প্রশিষ্যরা, নারী ও পুরুষ উভয়ই, হাজার হাজার পবিত্র মন্ত্র বলেছেন, যা বেদ-উপনিষদে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তারা সেই পরমশক্তিকে উপলব্ধি করেই এইসব মন্ত্র বলেছেন। সেই ধারা থেকেই গুরু-শিষ্য পরম্পরা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। সেইসঙ্গে এসেছে দীক্ষাকরণ, গুরুকরণের ব্যবস্থা। এখানেই প্রশ্ন হল, মানুষের মুক্তির যাত্রায় কি গুরু অপরিহার্য? ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে এর উত্তর- হ্যাঁ এবং না – দুইই। কারণ, যেহেতু জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মূলতঃ যুক্ত থাকেন, তাই মানুষ গুরুর নির্দেশিত পথে বা ঈশ্বরের কৃপায় স্ব-সাধনায় নিজের মুক্তি পেতে পারেন।

কিন্তু আব্রাহামীয় ধারায় একজন প্রফেট ধার্মিক ধারার ঋষির মতো নন। কারণ, প্রফেট একজন ‘আত্মোপলব্ধিকারী ব্যক্তি’ নন, বরং তিনি ঈশ্বরের ‘পছন্দের একজন ব্যক্তি’, যার মাধ্যমে ঈশ্বর দৈববাণীর মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। আর, তাই ‘শেষ বিচারের দিনে’ বিশ্বাসীদের হয়ে প্রফেট ঈশ্বরের সামনে সওয়াল করেন। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে খ্রীষ্ট হচ্ছেন একমাত্র উদ্ধারকর্তা, যিনি মানুষরূপে এসেছেন মানুষকে উদ্ধার করতে।

অন্তর্ভুক্ততা ও বর্জনীয়তা

ধার্মিক ধারা ও আব্রাহামীয় ধারা কতোটা অন্তর্ভুক্তকামী (Inclusionary) বা বর্জনকামী (Exclusionary)? ধার্মিক ধারা, বিশেষত হিন্দু ধর্মবিশ্বাস, কখনোই মানবজাতিকে ‘বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী’- এই দুই ভাগে ভাগ করেনি, যা আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেহেতু সমস্ত সৃষ্টিই পরম ব্রহ্মণ থেকেই এসেছে; তাই কোন কিছু, কোন মানুষ অপবিত্র বা অবিশ্বাসী নয়। তাই ধার্মিক ধারায় ‘বৈধর্ম্য’ (Heresy)-এর প্রশ্নই নেই। ধর্ম মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে নৈতিক জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এইজন্যে ধার্মিক ধারায় কোন মানুষকে ধর্মবিরুদ্ধ কথা বললে তাকে খুব বেশি হলে ‘ভ্রান্ত’ বলা হয়েছে; কিন্তু কখনোই আব্রাহামীয় ধারায় ‘ধর্মদ্রোহী’ (Heretic) বলা হয়নি।

যে কেউ কোন ধার্মিক ধর্মবিশ্বাসকে ত্যাগ করতে পারে; তার জন্য তাকে ‘ধর্মত্যাগী’ (Apostate) লেবেল দেওয়া হয় না এবং তার জন্য আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসের মতো শাস্তিবিধানের কথাও নেই। কিন্তু, খ্রিস্টধর্মে অবিশ্বাসীদের বলা হয়েছে ‘হিদেন’; আবার ইসলামধর্মে অবিশ্বাসীদের ‘কাফির’ বলা হয়েছে এবং এই অবিশ্বাসীদের কখনোই ‘উদ্ধার’ হবে না। আব্রাহামীয় ধারায় ‘ঈশ্বরনিন্দা’ ও ‘ধর্মনিন্দা’র (Blasphemy) শাস্তি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু, ধার্মিক ধর্মতত্ত্বে বা জীবনধারায় এইধরনের ‘ধর্মনিন্দাকারীদের’ কোনো শাস্তিবিধানের  কথা নেই।

 

ধর্মান্তরকরণ, প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষ

সহজভাবে বললে বলা যায়, সমস্ত ধরনের ধর্মবিশ্বাস দুই ধরনের: ধর্মান্তরকামী ও অ-ধর্মান্তরকামী। কোন সন্দেহ নেই যে, প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসই ‘এথনিক’; যদিও প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই একই সঙ্গে বিশেষমূলক (Particularistic) ও সর্বজনীনমূলক (Universalistic) বৈশিষ্ট্য আছে। সেই বৈশিষ্ট্য নিয়েই, বিশেষ করে, হিন্দুধর্ম কখনোই ধর্মান্তরকামী নয়। অপরপক্ষে, আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাস, বিশেষ করে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামধর্ম, বস্তুতপক্ষেই ধর্মান্তরকামী এবং এই দুটো ধর্মবিশ্বাস মনে করে পৃথিবীর সমস্ত ‘অবিশ্বাসী’ মানবজাতিকে উদ্ধার পেতে হলে তাদের ধর্মমতে ‘বিশ্বাসী’ হতে হবে।

তবে হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, শুধুমাত্র জন্মসূত্রেই হিন্দু হওয়া যায়। এটি একটি আংশিক সত্য। কারণ, হাজার হাজার বছর ধরে সারা ভারতে, এমনকি ভারতের বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে, যে হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের প্রচার হয়েছিল, তাতে বোঝা যায় যে, মানুষ হিন্দু ধর্মাচারকে বিশ্বাস করে মেনে চলে হিন্দু হয়ে উঠেছিল। তবে, হিন্দু ধর্মাচার, জীবনচর্চা ও সাংস্কৃতিক উপাদানের এই মেলবন্ধনকে কখনোই আব্রাহামীয় ধর্মান্তরকরণের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। 

আমরা জানি যে, প্রত্যেকটা ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই অনেকগুলো সম্প্রদায় আছে। যেমন, হিন্দু ধার্মিক বিশ্বাসে বৈষ্ণব ধারা, শৈব ধারা, শাক্তধারা ইত্যাদি।  তবে হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে সেই সম্প্রদায়গুলির নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক সংঘর্ষমূলক নয়, বরং প্রতিযোগিতামূলক। প্রতিটি সাম্প্রদায় নিজেদের উপাস্য দেবতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্থান দিয়ে, তার নিচে পিরামিডের মতো অন্যান্য সম্প্রদায়ের দেবতাদের স্থান দিয়েছে। কারণ, হিন্দুধর্মে বিশ্বাসীরা অপর মত ও পথকে সবসময়ই স্বীকার করেন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন, যা হিন্দু ধর্মতত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। 

কিন্তু, আব্রাহামীয় ধার্মিক ধারায় এই সহাবস্থানের তত্ত্বগত স্থান নেই। প্রতিটি আব্রাহামীয় বিশ্বাস মাত্রই সংঘর্ষমূলক। শুধু তাই নয়, তাদের নিজেদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সংঘর্ষমূলক সম্পর্ক দেখা যায়। পারস্পরিক মতের গ্রহণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসে বিশ্ববীক্ষার পরিপন্থী।

 

শেষ কথা

পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাস ব্যবস্থাগুলির যে ব্যাপ্তি তথা স্পেক্ট্রাম, তার একদিকে আমরা পাই হিন্দু ধর্মবিশ্বাস, আর অন্যদিকে পাই একেশ্বরবাদী আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাস। স্পেকট্রামের একদিকে হিন্দু ধর্মবিশ্বাস ঘোষণা করে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’- ‘সারা পৃথিবী এক পরিবার’, যা আধ্যাত্মিক, দার্শনিক তথা বিশ্বাসের জায়গা থেকে মনুষ্যজাতির সকলের, জগতের সকলের কল্যাণের কথা বলে; অন্যদিকে, আমরা পাই আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসগুলি, যারা সমস্ত মানবজাতিকে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী ভাগে বিভক্ত করেছে।

তাই শেষে বলতেই হয়, বিশ্ববীক্ষার সাপেক্ষে সব ধর্ম অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস তথা ধর্মমত সমানভাবে উদার নয়, বা উদার ভাবেও সমান নয়।

বঙ্গদেশ বারবার চেষ্টা করছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে না আসা খবরগুলো আপনাদের সামনে আনার। আমরা আপনাদের খবর করি, আপনাদের কথা লিখি। আমাদের এই প্রচেষ্টা ভালো লেগে থাকলে ১০ থেকে ১০,০০০ যে কোন মূল্যের ডোনেশন দিয়ে বঙ্গদেশের পাশে দাঁড়াতে পারেন। আমাদের আরও ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন। ধন্যবাদ।

সুজিৎ রায়
সুজিৎ রায়
কবি, লেখক, নিবন্ধকার, গণসমাজ ভাষ্যকার, রিসার্চ অ্যানালিস্ট। 'নুড়ি-পাথরের দিনগুলি' কাব্যগ্রন্থ। 'সোশিওলজি অফ মাদারহুড এ্যান্ড বিয়ন্ড' বইটির যৌথ-সম্পাদনা। ব্লগ http://drsujitroy.blogspot.com

Most Popular